২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা

দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা - ছবি সংগৃহীত

ইয়া চণ্ডী মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী
ইয়া মাহিষ্ণেমালিনী
ইয়া ধূম্রেক্ষণচণ্ড মুণ্ডমথনি
ইয়া রক্তবীজাশনী
শক্তি শুণ্ডনিশুডম্ভ দৈত্যদলনী।
ইয়া সিদ্ধিদাত্রী পরা
যা দেবী নবকোটি মূর্তি সহিতা

আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতিময়ী জগম্মাতার আগমন বার্তা।
আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি। অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।
তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়তে আহ্বান আজ চিচ্ছক্তি রূপিণী বিশ্বজননীর শ্বারদশ্রী বিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে
মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।

“সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রেক্ষা চতুর্তিভুজৈঃ।
শখং চক্রদনুঃশরাংশ্চ দেতা নেতৈস্ত্রিত্তিঃ শোভিতা।।
আমুক্তাঙ্গদাহার কঙ্কনরণহ কাঞ্চাক্কনুন্নুপুরা।
দুর্গা দুর্গতহারিণী ভবুত নো রত্মোপ্লসৎকুণ্ডলা।
মহামায়া সনাতনী, শক্তিরূপা, গুণময়ী
তিনি এক, তবু প্রকাশ বিভিন্ন দেবী নারায়নী; আবার ব্রহ্মশক্তিরূপ
ব্রাহ্মণী কখনো মহেশ্বরীরূপে প্রকাশমানা, কখনো বা নির্মলা।
কৌমারী রূপধারিণী কখনো মহাবজ্র রূপিনী ঐন্দ্রি, উগ্র-শিব
দুতিনী- নমুণ্ডমালিনী- চামুণ্ডা- তিনি আবর তবময়ী নিয়তি
এসব প্রকাশমান মহাশক্তি পরমা প্রকৃতির
আবির্ভাব হবে সপ্তলোক তাই আনন্দমগ্ন।
‘বাজলো তোমার আলোর বেনু
মাতাল যে ভুবন
আজ প্রভাতে সে সুর শুনে খুলে দিনু মন
অন্তরে যা লুকিয়ে রাজে
অরূপ বীনায় সেই সুর বাজে
এই আনন্দ যজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ
আজ সমীরণ আলোয় পাগল, নবীন সুরের বীণায়
আজ শরতের আকাশ বীণায় গানের মালা বিলায়
তোমায় হারা জীবন মম, তোমারি আলোয় নিরূপম
ভোরের পাখি উঠে গাহি তোমারি বন্দন।’

দেবী চণ্ডিকা সচেতন চিন্ময়ী, তিনি নিত্য, তাঁর আদি নেই, তাঁর প্রকৃত মূর্তি নেই, এই বিশ্বের প্রকাশ তার মূর্তি। নিত্য হয়েও অসুর-পিঁড়িতে দেবতা রক্ষণে তার আবির্ভাব। দেবীর শাশ্বত অভয়বাণী- ‘ইলখং যদা যদা বাধা, দানবোলখা ভবিষ্যতি। তদা তদাবর্তীযাহং, করিষ্যাম্যারি সংক্ষয়ম। পূর্বকলা অবসানের পর প্রেমময়কালে সমস্ত জগৎ যখন কারণ সলিলে পরিণত হলো। ভগবান বিষ্ণুর অখিল শক্তির প্রভাব সংহত করে। সেই কারণে সমুদ্রে রচিত অনন্ত শয্যাপরে, যোগ নিদ্রায় হলেন অভিভূত বিষ্ণুর যোগ নিন্দ্রার অবসান কালে তার নাভিপদ্ম থেকে জেগে উঠলেন ভাবিকলোর সৃষ্টি বিধাতা ব্রহ্মা, কিন্তু কর্ণমলজাত মধুকৈটও অদুুরদ্দয়, ব্রহ্মার অস্তিত্ব বিনাশে উদ্ধত হতে, পদ্মযোনি ব্রহ্মা যোগ নিদ্রায় মগ্ন সর্বশক্তিমান বিশ্ব বিধাতা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য, জগতের স্থিতি সংহারকারিণী বিশ্বেশ্বরী জগজ্জননী
হরিনেত্র-নির্বাসিনী নিরূপমা ভগবতীকে স্তব মন্ত্রে করলেন উদভূদিত-
এই ভগবতী বিষ্ণু নিদ্রারূপা মহারাত্রি, যোগ-নিদ্রা দেবী

‘তব অচিন্ত্য রূপ চরিত মহিমা
নব শোভা- নব ধ্যান রূপায়িত প্রতিমা,
বিকশিল জ্যোতি প্রাতি মঙ্গল বরণে
তুমি সাধন ধন ব্রহ্ম বোধন সাধনে
তব প্রেমনয়ন ভাতি নিখিল তারণী
কনককান্তি ঝরিছে কান্ত বদনে।।
হে মহালক্ষ্মী জননী গৌরী শুভদা।
জয় সংগীত ধ্বনিছে তোমারই ভুবনে।।’

অপূর্ব স্ত্রীমূর্তি মহাশক্তি দেবগণের অংশ সম্ভুতা, দেবগণের সমষ্টিভূত তেজপিণ্ড এক বরবর্ণিনী শক্তি স্বরূপিণী দেবীমূর্তি ধারণ করলেন। এই দেবীর আনন শ্বেতবর্ণ, নেত্র কৃষ্ণবর্ণ অধর পল্লব আরক্তিম ও করতলদ্বয় তম্রাও। তিনি কখনোবা সহস্রভুজা, কখনো বা অষ্টাদশ ভূজারূপে প্রকাশিত হতে লাগলেন। এই ভামকান্তরূপিণী দেবী ত্রিগুণা মহালক্ষ্মী। তিনিই আদ্য মহাশক্তি মহাদেবীর, মহা মহিমায় আবির্ভাবে বরণগীত ধ্বনিত হয়ে উঠল।

‘আখিল বিমানে তব জয়গানে যে সামবর,
বাজে সেই সুরে সোনার নূপুরে নিত্যে নব।
হে আলোর আলো, তিমির মিলাল।
তবজ্যোতি সুধা চেতনা বিশাল।
রাগিনী সে ছিড়ে গাহিল মধুরে সে বৈভব।
‘জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিণী।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্ত তে ॥
দেবীর আবির্ভাবের এই শুভ বার্তা প্রকাশিত হলো।’
সব দেবদেবী মহাদেবীকে বরণ করলেন গীতিমাল্যে, সেবা করলেন রাগচন্দনে।
জগৎমাতা চণ্ডিকা উপাসকের ধনদাত্রী, ব্রহ্মা চৈতন্যস্বরূপা
সর্বোত্তম মহিমা। মহাদেবী অন্তর্যামীরূপে ব্যক্ত হয়ে আছেন দ্যুলোক ভূলোক।
ভুবনমোহিনী সর্ববিরাজমান জগদীশ্বরী, আপন মহিমায় দ্যাবপৃথিবী ও সৃষ্টির মধ্যে পরিব্যক্ত হয়ে অবস্থান করেন পরমচৈতন্যরূপ। মানবের কল্যাণে সর্বমঙ্গলা হোন উদ্বুদ্ধা।

‘শুভ্র শঙ্খরবে সারা নিখিল ধ্বনিত।
আকাশতলে অনিল জলে, দিকে দিগঞ্চলে,
সকল লোকে, পুরে বনে বনান্তরে
নিত্যগীত ছন্দে নন্দিত।
শরৎ প্রকৃতি উল্লসি তবগানে, চিরসুন্দর চিরসুন্দর, চিরসুন্দর বন্দনদানে,
ত্রিলোকে যোগে সুরনয়ী আনন্দে।
মহাশক্তিরূপা মঞ্জুজুলশোভা জাগে আনন্দে,
মা কল্যাণী সদা রাজ্যে, সদা সুখদা, সদা বরদান, সদা ভয়দা ক্ষেমঙ্করী সুধা হ্রদে।
অসুরদর্শন দশ প্রহরণ ভুজা রাগে।
রণিত বীণাবেণু, মধু ললিত শমিত তানে, শুভ আরতি ঝতকৃত ভুবনে নবজ্যোতি রাগে।
জ্যোতি অলঙ্কারে তানে তানে উঠে গীতি,
সুধারসঘন শান্তি শান্তি ঝন ঝন জয়গানে ॥

দেবী নিত্য, তথাপি দেবগণের কার্যসিদ্ধ হেতু সর্বদেবশরীরজ তেজঃপুত্র থেকে তখন প্রকাশিত হয়েছেন বলে তাঁর এই অভিনব প্রকাশ বা আবির্ভাবেই মহিষমর্দিনার উৎপত্তিরূপে খ্যাত হল। দেবী সজ্জিত হলে অপূর্ব রণচণ্ডী মূর্তিতে হিমাচল দিলেন সিংহবাহন, বিষ্ণু দিলেন চক্র। পিনাকপানি শঙ্কর দেলিন শ্রম, যম দিলেন তাঁর দণ্ড। কালদেব সুতাক্ষ্ম খড়গ। চন্দ্র, অষ্টচন্দ্র, শোষা চর্ম দিলেন। ধনুবান দিলেন সূর্য, বিশ্বকর্মা অভেদ বর্ম, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা কমডুলু, কুবের রত্নহারা সকল দেবতা মহাদেবীকে নামা অলঙ্কারে অলঙ্কৃত ও বিবিধ প্রহরণে সুসজ্জিত করে। অসুর বিজয় যাত্রায় মেতে প্রার্থনা করলেন। রণদুদুম্ভি ধ্বনিতে বিশ্ব সংসার নির্মাদিত হতে লাগল। যাত্রার পূর্বে সুর-নরলোকবাসী সকলে দশপ্রহরণধারিণী দশভুজা মহাশক্তিকে ধন্যমন্ত্রে করলেন ধ্যানমন্ত্রে করলেন অতিবন্দনা।

নমো দৈবো, মহাদৈবো শিবায় সততং নমঃ।
নমঃ প্রকৃতৈ ভদ্রায়ে নিয়তাঃ প্রণতা স্মাতাম ॥
রৌদ্রায়ে নম নিত্যায়ে গৌর্যে ধাত্রৈ নমো নমঃ।
জ্যোৎস্নায়ে চেন্দুরূপিণ্যে সুখায়ে সততঃ নমঃ।
কল্যাণ্যে প্রণতা ব্রদ্ধৌ কুর্মো নমো নমঃ।
নৈঝত্য ভুভুতাং লক্ষ্যে শর্বান্যে তে নমো নমঃ॥
দুর্গায়ে দুর্গপারায়ে সারায়ে সর্বকারিণ্যে-
খ্যাত্যে যৈব কৃষ্ণয়ে ধুয়ে সততঃ নমঃ।
অতি যৌক্ষাতি রৌদ্রয়ে নতাস্তস্য নমো নমঃ।
নমো জগৎ প্রতিষ্ঠায় দৈব্যে কৃত্যে নমো নমঃ ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণু মায়েতি শতিা।
নমস্ত স্যে নমস্তসে নমস্তসে নমো নমঃ
যা দেবী সর্বভূতেষু চৈতনেত্য ভিধয়িতে।
নমস্তস্যে নমস্তস্যে নমস্তসে নমো নমঃ ॥

বাণী মহাবর অম্লান মনে
জননী গো নমি রাতুল চরণে,
পূজায় উল্লাসে ধরণী যে হাসে সুরভিত রাতে।
নমো চণ্ডী, নমো চণ্ডী, নমো চণ্ডী, জাগো রক্তবীজ নিকৃন্তিনী, জাগো মহিষাসুর বিমদিনী
উঠে শঙ্খমন্ত্রে অভ্রবক্ষ শঙ্কাশননে চণ্ডী।
এর খড়গশক্তি কৃতকৃান্ত শত্রু শাত্তন তন্ত্রী, নত সিংহবাহিনী ঘন ণ্ডংকারে ইন্দ্রাদি চমুতন্দ্রী
তুমি রণ কন্ত্র টাক্কার হানো খর কলম্ব জলে।
নাচো ধূমনেত্র সমুজমুণ্ড চক্রপাতনে খণ্ডী, তব তাতার্থে তাতার্থে প্রলয় নৃত্য ধ্বংসে বাঁধন গণ্ডী।
দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরের প্রবল সংগ্রাম আরম্ভ হলো। দেবীর অস্ত্র প্রহারে দৈত্যসেনা ছিন্ন ভিন্ন হতে লাগল। মহিষাসুর ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করে নানা কৌশল বিস্তার করলে। মহিষ হলে হস্তীরূপ ধারণ করলো। আবর সিংহরূপী দৈত্যের রণোন্মণ্ডতা দেবী প্রশমিত করলেন। পুনরায় নয়নবিমোহন পুরুষ বেশে আত্মপ্রকাশ করল ওই ঐন্দ্রজালিক। দেবীর রূঢ় প্রত্যাখ্যান পেয়ে আবার মহিষ মূর্তি গ্রহণ করলেন। রণবাদ্যে দিকে দিগন্তরে নিনাদিত। চতুরঙ্গ নিয়ে অসুরেশ্বর দেবীকে পরাজিত করবার মানসে উল্লসিত।

দেবীবাহন সিংহরাজ দাবাগ্নির মতো সমস্ত রণক্ষেত্র শত্রু নিধনে দুর্নিবার হয়ে উঠল। নানা প্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা মধু পান করতে করতে করতে মহিষরূপকে সদম্ভে বললেন,

‘গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু বাকা নিবামাহম্, ময়া ত্বয়ি হতৈছত্রেব গর্জিষ্যান্ত্যাশু দেবতা।’
দেবতাগণ সানন্দে দেখলেন, দুর্গা মহিষাসুরকে শুলে বিদ্ধ করেছেন আর খড়গনিপাতে দৈত্যের মস্তক ভূলুণ্ঠিত। তখন অসুরনাশিনী দেবী মহালক্ষ্মীর আরাধনা গীতি সুষমা দ্যাব্যা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হলো।
মাগো, তবধানে সঙ্গীত প্রেম ললিত, নিখিল প্রাণের বীণা তারে তারে রণিত।
সকল রোদন সেই সুরে গেল মরিয়া, কালি কালি যত জমছিল সুখসামিনী
ঊষার মুরতি ধরিয়া বাহির রাগিণী, জীবন ছিল আলোক সুধায় ধরি তাই।

msnislamtransport@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement