১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের বিপন্ন শিল্প খাত

-

শিল্পখাত ও জাতীয় উন্নয়ন পরস্পর সম্পৃক্ত। শিল্পের উন্নয়ন দক্ষতা, পারিপার্শ্বিকতা ও পুঁজির সুষম ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। পরিবেশ ও পুঁজির সুষম সমন্বয়ে শিল্পের উন্নয়ন ঘটে থাকে। আমরা জানি, আমাদের দেশে আগে পাট, চা ও চামড়াশিল্প যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। পৃথিবীর মধ্যে পাটশিল্পে বাংলাদেশ ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। বর্তমানে পারিপার্শ্বিকতা ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের পাটশিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি। এশিয়ার বিখ্যাত পাটকল আদমজী জুটমিল বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের পথে। আন্তর্জাতিকভাবে পাটশিল্প বর্তমানে ভারত নিয়ন্ত্রণ করছে। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে বাংলাদেশের এ শক্তিশালী শিল্প খাতটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। চা-শিল্পে বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে চা-শিল্প ধ্বংসপ্রায়। চামড়াশিল্পে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন চামড়াশিল্পে ধ্বংস নেমেছে। পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশে চামড়াশিল্প বর্তমানে নাজুক। চিংড়িশিল্পকে একসময় ‘সাদা সোনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। চিংড়িশিল্পের সুদিন শেষ হয়ে গেছে। গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিল। সরকারি অব্যবস্থাপনা, দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব, পুঁজির স্বল্পতা ও শ্রমিক অসন্তোষ তথা পারিপার্শিক নানা কারণে গার্মেন্টস শিল্পে ধস নেমেছে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের রেমিট্যান্স বা আয় দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা সচল রয়েছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেশির ভাগ মুসলিম বিশ্বে কর্মরত। সরকারি অব্যবস্থাপনায় মুসলিম বিশ্ব থেকে অবিরত আমাদের দেশের শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস সীমিত হয়ে আসছে। অথচ মুসলিম দেশগুলোর শ্রমবাজারে প্রতিনিয়ত অমুসলিম শ্রমিকের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি দায়ী।

মূলত আমরা শ্রমিকদের মাধ্যমে অর্থ আয় করতে রাজি, অথচ তাদের সুযোগ-সুবিধা দেখতে রাজি নই। বিদেশী বাজারে আমাদের দেশীয় শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হারানোর কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শ্রমবাজারে দক্ষতার বিকল্প নেই। অথচ আমরা প্রশিক্ষণ না দিয়ে সাধারণত অদক্ষ শ্রমিকদের বিদেশের শ্রমবাজারে পাঠিয়ে থাকি যে কারণে তারা বিদেশ গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় ফিরে আসে। খ. বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা দেখভাল করার জন্য আমাদের দেশের দূতাবাস রয়েছে। অথচ দূতাবাসের কর্মকর্তারা দেশের শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় তৎপরতা দেখান না। এ কারণে আমাদের দেশের শ্রমিকরা প্রায়ই বিদেশে নাজেহাল হয়ে থাকেন। অনেকে প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসেন। ফলে দেশ ক্রমান্বয়ে বিদেশী রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা ‘সোনার ডিম’ খেতে আগ্রহী অথচ হাঁস লালন পালন করতে রাজি নই। ইচ্ছা করলে আমরা বিদেশের শ্রমবাজারে শ্রমিক পাঠানোর জন্য দেশে পর্যাপ্ত কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি। এ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষিত শ্রমিকরা দক্ষতার সাথে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিদেশের শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান করতে সমর্থ হবে। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে দেশে বেকারত্বের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রছাত্রীরা দেশে ও বিদেশে কর্মক্ষেত্রে সহজেই নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের শ্রম খাত অব্যবস্থাপনায় ভরপুর। আমাদের পাশর্^বর্তী রাষ্ট্রগুলোতে সরকারিভাবে অত্যন্ত সহজ শর্তে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা বিদেশে পাঠানো শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় সদা তৎপর। আমাদের দেশে বেসরকারি খাতে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার শেষ নেই। সরকার সদিচ্ছাপরায়ণ হলে সহজ শর্তে বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে পারে। আমরা জানি, মুসলিম শ্রমবাজারে ৭০ শতাংশ অন্য ধর্মীয় শ্রমিক কর্মরত। কর্মদক্ষতা ও সরকারি সুব্যবস্থাপনার কারণে তারা মুসলিম দেশগুলোর শ্রমবাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। আমাদের দেশের আলিয়া ও কওমি মাদরাসাগুলোতে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পৃক্ত করা একান্ত জরুরি। মাদরাসায় শিক্ষা লাভ করা ছাত্ররা আরবি ভাষায় অনেকটা দক্ষতা অর্জন করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে ভাষা সমস্যা প্রকট। মাদরাসায় শিক্ষিত ছাত্ররা সহজেই মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারবে।

করোনা সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হচ্ছে যার বিরূপ প্রভাবে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনুভূত হচ্ছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে ধস নামতে শুরু করেছে। মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বিদেশী রেমিট্যান্স। সে খাতকে কিভাবে চাঙ্গা রাখা যায় সে দিকে দৃষ্টিপাত করা সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের শিল্প খাতগুলো সরকারি অব্যবস্থাপনার দরুন এবং দক্ষ উদ্যোক্তার অভাবে ক্রমাগত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে শিল্প খাতে ব্যাংকের লগ্নিকৃত অর্থ কুঋণে পরিণত হচ্ছে। খেলাপি ঋণের তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমাদের দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একান্ত জরুরি। মূলত সরকারি অব্যবস্থাপনা এর জন্য দায়ী। অভ্যন্তরীণ বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের অদক্ষতা শিল্প খাতগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তদুপরি দক্ষ উদ্যোক্তাদের ঋণ না দিয়ে অদক্ষ ফটকাবাজ ও সরকারের মদদপুষ্ট ব্যক্তিদের শিল্প খাতে ঋণ দেয়া হয়েছে। তাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতার কারণে শিল্পঋণের অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়নি। তারা কিছু পরিমাণ অর্থ শিল্পখাতে ব্যয় করে বাকি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ফলে শিল্পখাত ক্রমান্বয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। দক্ষ উদ্যোক্তা চিহ্নিত করে সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দিলে তাদের মাধ্যমে শিল্প খাতগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ব্যাংকের লেনদেন বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট মুক্ত হবে। দক্ষ উদ্যোক্তারা সাধারণত পণ্যের গুণগত মান নির্ধারণে সচেষ্ট থাকে। এ কারণে উন্নতমানের পণ্য সহজে দেশে ও বিদেশের বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করে নেয়। অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় নিম্নমানের পণ্য উৎপাদিত হলে দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা হারায়। আমাদের দেশে যার জ¦লন্ত প্রমাণ রয়েছে। একসময়ের শক্তিশালী চিংড়ি শিল্প খাত দুর্নীতিপরায়ণ উদ্যোক্তাদের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। আমরা জানি, চিংড়ির সাথে বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর উপাদান মিশ্রিত করে অসাধু উদ্যোক্তারা বিদেশের বাজারে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় চিংড়ি খাত বিদেশের বাজার হারিয়েছে। চা, পাট, চামড়া, পোশাকসহ সব শিল্পের একই অবস্থা। আমাদের দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের এক বিশেষ ঐতিহ্য আছে। সাধারণত সরকারসমর্থক ও অদক্ষ উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে শিল্পঋণ দেয়া হয়। যখন যে দলের সরকার ক্ষমতায় আসে তখন তারা তাদের চাটুকারদের মধ্যে শিল্পঋণ বিতরণ শুরু করে। এ সব অদক্ষ উদ্যোক্তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিল্পে অর্থায়ন না করে সেই অর্থ বিদেশে পাচার করে থাকে। এ কারণে আমাদের দেশে দক্ষ শিল্প উদ্যোক্তার বিকাশ ঘটছে না। ভারত ও চীনে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ শিল্প উদ্যোক্তার বিকাশ ঘটেছে। তারা দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রীয় প্রাণশক্তি। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক নন। বংশানুক্রমিকভাবে তারা উন্নত শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে চলেছেন। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে দক্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের হয়রানি করা হয়। ফলে আমাদের দেশের শিল্প খাত কখনো মজবুত কাঠামোর ওপরে দাঁড়াতে সমর্থ হয়নি। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ও চীন তাদের পণ্য উৎপাদনে প্রতিযোগিতামূলকভাবে গুণগত মান বৃদ্ধি করে চলেছে। ফলে তাদের পণ্য অতি দ্রুত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্থান করে নিচ্ছে। আমাদের দেশের জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী মহলে এখনই শিল্প খাতের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement