১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হৃৎপিণ্ড : অলৌকিক পাম্প মেশিন

হৃৎপিণ্ড : অলৌকিক পাম্প মেশিন - ছবি সংগৃহীত

মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর একত্ববাদ, অসীম জ্ঞান, প্রতিপত্তি ও সৃষ্টি ক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে আমাদের চার পাশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টির দিকে মানুষকে মনোনিবেশ করতে বলেছেন। উট, মানুষ, আকাশসমূহ, পাহাড়-পর্বত, পৃথিবীর গঠন, দিন রাতের আবর্তন, চাঁদ-সূর্য ইত্যাদি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করতে তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের নিজেদের শরীরে তিনি অনেক অলৌকিক জিনিস স্থাপন করেছেন।

‘দৃঢ়বিশ্বাসীদের জন্য জমিনে অনেক নিদর্শন রয়েছে। তোমাদের নিজেদের মধ্যেও। তোমরা কি চক্ষুষ্মান হবে না?’ (আল কুরআন ৫১ : ২০-২১)

আমাদের নিজেদের মধ্যে তাঁর এরকম একটি নিদর্শন হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। আসলে আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই আল্লাহ তায়ালার একেকটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। আমাদের ব্রেন হচ্ছে সুপার কম্পিউটার, কিডনি হচ্ছে অপূর্ব ডায়ালাইসিস মেশিন, হার্ট হচ্ছে বিস্ময়কর পাম্প মেশিন। কোনো কোনো গবেষক আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজের মূল্যমান ধরেছেন ৬ মিলিয়ন ডলার (৫০ কোটি টাকা প্রায়)। আসলে আল্লাহর দেয়া কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরই সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

মানুষের হৃৎপিণ্ডের আয়তন প্রত্যেকের মুষ্টিবদ্ধ হাতের সমান। ওজন ২৫০-৩০০ গ্রাম। এর ২/৩ ভাগ বুকের বাম পাশে আর ১/৩ ভাগ বুকের ডান পাশে থাকে। এর মাংসপেশি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এটা হাত ও পায়ের মাংসপেশির মতো কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে এর ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হৃৎপিণ্ডের চারটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। উপরের দুটি হচ্ছে অলিন্দ, Atrium (ল্যাটিন শব্দ, অর্থ হচ্ছে প্রবেশদ্বার বা Entrance Hall)। নিচের দুটি প্রকোষ্ঠ হচ্ছে নিলয়, (Ventricle (ল্যাটিন শব্দ, অর্থ Little Belly বা ছোট পেট)। এই প্রকোষ্ঠগুলোতে ঠধষাব বা দরজা আছে, যা শুধু একদিকে রক্ত প্রবাহে সহায়তা করে থাকে। এই প্রকোষ্ঠগুলোর মাঝখানে পর্দা হৃৎপিণ্ডকে ডান ও বাম অংশে বিভক্ত করে। ডান অংশে সমস্ত শরীর থেকে দূষিত রক্ত জমা হয় যা হৃৎপিণ্ডের সাহায্যে ফুসফুসে পাঠিয়ে বিশুদ্ধ করা হয়। ফুসফুস থেকে রক্ত বিশুদ্ধ হয়ে বাম পাশে জমা হয় যা হৃৎপিণ্ডের সাহায্যে সমস্ত শরীরে পৌঁছানো হয়। হৃৎপিণ্ড গড়ে ১ মিনিটে ৭০ বার সঙ্কোচন করে থাকে। এই হচ্ছে হার্টের সাদামাটা বর্ণনা যা আমাদের মেডিক্যাল কলেজে পড়ানো হয়। এর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার যেন কোনো ভূমিকা নেই। Evolution বা বিবর্তন থিউরি দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলে।

প্রাণিজগতের দিকে দৃষ্টি ফেরালে আমরা নানারকম হৃৎপিণ্ডের সন্ধান পাই। নীল তিমির হার্ট হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যার ওজন হচ্ছে ১৫০০ পাউন্ড। জিরাফের হার্টের বাম পাশের অংশ ডান পাশের তুলনায় অনেক মোটা। কারণ তাকে অনেক উঁচুতে অর্থাৎ জিরাফের মাথায় রক্ত সরবরাহ করতে হয়। আমেরিকার Pygmy Shrew (এক ধরনের ইঁদুর) হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী কিন্তু তার হার্ট হচ্ছে দ্রুততম। মিনিটে ১২০০ বার কাজ করে থাকে। অথচ মানুষের হৃৎপিণ্ড ১২০০ বার কাজ করলে এক মিনিটও মানুষ তা সহ্য করতে পারবে না। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুর হার্ট ১৪০-১৬০ বার সঙ্কোচন করে থাকে যা তার জন্য স্বাভাবিক। অথচ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হার্ট এ গতিতে কয়েক সপ্তাহ চলতে থাকলে হার্ট আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে বাধ্য। হৃৎপিণ্ডের কাজের এই বৈচিত্র্যতা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
এটা মহান আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি ক্ষমতার অপূর্ব নিদর্শন।

‘আল্লাহ প্রতিটি প্রাণীকেই পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ বুকে হামাগুড়ি দিয়ে চলে, আবার কেউ চার পায়ে ভর করে। তিনি যা কিছু চান সৃষ্টি করেন। তিনি প্রতিটি বস্তুর ওপর শক্তিমান।’ (আল কুরআন ২৮ : ৪৫)

মাতৃগর্ভে তৃতীয় সপ্তাহের শেষে হার্ট হঠাৎ কাজ করা শুরু করে এবং বিরতিহীনভাবে জীবনের ৭০-৮০ বছর কাজ করে চলে। আল্লাহ তায়ালার আদেশেই সে কাজ করা শুরু করে এবং তাঁর আদেশেই সে থেমে যেতে বাধ্য হয়। হার্ট মিনিটে ৭০ বার, ১ বছরে সাড়ে তিন কোটি বার এবং জীবনে ২ ট্রিলিয়ন(২০০০০০০০০০০০০ কোটি) বার কাজ করে থাকে। জীবনে হার্ট ১৫ লাখ ব্যারেল রক্ত সঞ্চালন করে থাকে।

প্রতিদিন হার্ট যে শক্তি (Energy) উৎপন্ন করে থাকে তা দিয়ে একটি ট্রাক ২০ মাইল যেতে পারবে এবং সারাজীবনে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চাঁদে যাওয়া এবং ফিরে আসা সম্ভব। আমাদের শরীরে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন (১০০০০০০০০০০০০০০ কোটি) কোষ রয়েছে। হার্টের মাধ্যমে প্রতিটি কোষে দিনে ১০০০ বার রক্ত সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এর ব্যতিক্রম শুধু চোখের কর্নিয়া। এর মধ্যে কোনো রক্তনালী নেই। কাজেই হার্ট তাকে অক্সিজেন সরবরাহ করে না। বাতাস থেকে এবং চোখের অশ্রু থেকে সে অক্সিজেন পেয়ে থাকে। এখানেও মহান আল্লাহ তায়ালার অসীম প্রজ্ঞা ক্রিয়াশীল। কর্নিয়ায় যদি সূক্ষ্মতম রক্তনালীও থাকত, তাহলে আমাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেত। এটি আল্লাহরই একত্ববাদের নিদর্শন। হৃৎপিণ্ডের জন্য একজন দেবতা আর চোখের জন্য অন্যজন হলে সৃষ্টি কর্মে গরমিল দেখা দিত।

‘পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোনো অসামঞ্জস্য দেখতে পাবে না। তুমি আবার দৃষ্টি ফেরাও, কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি দৃষ্টি ফেরাও একের পর এক। সেই দৃষ্টি অবনমিত ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে।’ (আল-কুরআন ৬৭ : ৩-৪)

হার্টের বদৌলতে রক্ত প্রতিদিন আমাদের শরীরে ১২০০ মাইল ভ্রমণ করে থাকে। হার্টের রক্ত সরবরাহ প্রক্রিয়া অদ্ভুত। আমাদের প্রতিটি অঙ্গে, যেমন ব্রেন, লিভার, কিডনি ইত্যাদিতে রক্তনালী ভিতরে প্রবেশ করে শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে প্রতিটি কোষকে রক্ত সরবরাহ করে থাকে। হার্ট হচ্ছে একমাত্র ব্যতিক্রম। এর প্রধান রক্তনালী ও শাখা-প্রশাখাগুলো হার্টের ভিতরে প্রবেশ না করে এর পৃষ্ঠে অবস্থান করে থাকে যা হার্টকে মুকুটের মতো আবৃত করে রাখে, এ জন্য এ রক্তনালীগুলোকে Coronary Artery বলা হয়। (Corona ল্যাটিন ভাষায় মুকুট)। কেন এই ব্যতিক্রম? হার্ট হচ্ছে আমাদের শরীরে একমাত্র অঙ্গ যা প্রতি সেকেন্ডে অন্তত একবার সঙ্কোচন ও সম্প্রসারণ করে থাকে। বড় বড় রক্তনালীগুলো হার্টের ভিতরে থাকলে, হার্টের ঘন ঘন সঙ্কোচনের কারণে এর রক্ত সরবরাহে চরম ব্যাঘাত ঘটত।

হার্ট থেকে দূষিত রক্ত ফুফফুসে গিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশুদ্ধ হয়ে থাকে। ফুসফুসে প্রায় ৩৩ কোটি Alveoli (ফুসফুসের ক্ষুদ্রতম ভাগ) আছে যা ৩৩ কোটি ক্যাপিলারির (ক্ষুদ্রতম রক্তনালী) সাথে যুক্ত। হার্ট ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে প্রতি মিনিটে 56×10^21 অক্সিজেন এটম আমাদের শরীরের কোষে সরবরাহ করে থাকে। হার্ট হচ্ছে একমাত্র অঙ্গ যাকে অক্সিজেন ও খাদ্য সরবরাহ করলে শরীরের বাহিরেও কাজ করতে থাকে।
হার্টের রয়েছে বিশেষ ইলেকট্রিক সার্কিট। SA Node, AV Node, Bundle of His, Purkinje fibre।

SA Node হচ্ছে টিম লিডার। তার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় যার কারণে হার্ট ৬০-১০০ বার সঙ্কোচন করে থাকে। সে কাজে অক্ষম হয়ে পড়লে, AV Node নেতৃত্ব গ্রহণ করে থাকে। তার কার্যক্ষমতা ৪০-৬০ বার। সেও দুর্বল হয়ে গেলে, Bundle of His দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে যার কার্যক্ষমতা আরো কম। আর এভাবেই আল্লাহ তায়ালা কয়েক স্তরে হার্টের তথা জীবন-সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এই ইলেকট্রনিক সিস্টেমের কারণে হার্টের কর্মকাণ্ডে ছন্দময়তা আছে। হার্টের অলিন্দ যখন সঙ্কুচিত হয়, নিলয় তখন সম্প্রসারিত হয়। একই সময়ে অলিন্দ-নিলয় সঙ্কুচিত হলে শরীরে রক্ত সরবরাহে চরম ব্যাঘাত ঘটত।

SA Nodeকে প্রাকৃতিক পেসমেকার বলা হয় যা ডান অলিন্দে অবস্থিত এবং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ০.৫ ইঞ্চি। প্রতি ৬০০ জনের মধ্যে একজনের বৃদ্ধ বয়সে এটির কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। বাকিদের ক্ষেত্রে এটি সারাজীবন কর্মক্ষম থাকে।

পেসমেকার অকার্যকর হলে আমাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের জন্য কৃত্রিম পেসমেকার বুকের চামড়ার নিচে সংস্থাপন করা হয়। এটি আয়তনে অনেক বড় এবং ১০০% ক্ষেত্রে ১০-১২ বছর পরপর এটি প্রতিস্থাপন করতে হয়। আল্লাহর তৈরি পেসমেকারের চেয়ে এটি কত দুর্বল! আসলে আল্লাহর অসীম জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত।
‘তোমাদেরকে খুব কমই জ্ঞান দান করা হয়েছে।’ (আল কুরআন ১৭ : ৮৫)

হার্টের কার্যক্রমে আরো ব্যতিক্রম রয়েছে। এর একেকটি Cardiac Cycle-এর দৈর্ঘ্য ০.৮ সে.। মিনিটে ৭০ বার গড়ে এই Cycle-এর পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকে। ০.৮ সে. এর মধ্যে ০.৩ সে. সে কাজ করে আর ০.৫ সে. বিশ্রাম নেয়। অর্থাৎ কাজের চেয়ে সে বেশি বিশ্রাম করে থাকে। যাকে বিরতিহীনভাবে সারাজীবন কাজ করতে হবে, তার শক্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা এভাবেই করে দিয়েছেন।

এবার মানুষের তৈরি সর্বাধুনিক মেশিনের কথা চিন্তা করুন। কোনো মেশিনই লাগাতার বিরতিহীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাকে বিশ্রাম দিতে হয়। ১০-১৫ বছরের বেশি সাধারণত কোনো মেশিন টেকে না। তার মধ্যে এটিকে অনেক বার সার্ভিসিং করাতে হয়। অথচ হৃৎপিণ্ড ৭০-৮০ বছর অনবরত কাজ করে চলে, কোনো সার্ভিসিং করাতে হয় না, কোনো মরিচাও পড়ে না। মানুষের তৈরি পাম্প মেশিন কত শব্দ করে থাকে, অথচ হার্ট শব্দহীন (ডাক্তাররা অবশ্য হার্টের শব্দ শুনতে পায়)।

‘তিনি পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলকে সত্যতার ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন আর তোমাদের আকার-আকৃতি বানিয়েছেন এবং অতীব উত্তম রূপ দিয়েছেন।’ (আল কুরআন ৬৪ : ৩)

লেখক : অধ্যাপক কর্নেল, মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ

 


আরো সংবাদ



premium cement
জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত গোয়ালন্দে প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তানকে মারধর, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন সিরিয়ায় আইএস-এর হামলায় সরকার সমর্থক ২০ সেনা সদস্য নিহত

সকল