২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশ কি ধর্ষকদের অভয়ারণ্য?

বাংলাদেশ কি ধর্ষকদের অভয়ারণ্য? - ছবি সংগৃহীত

ভাবতেও বেদনাহত হচ্ছি আমি নিজে আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের লোক। সমগ্র বাংলাদেশে সিলেটের মানুষ সম্বন্ধে একটি বিশেষ ধারণা ছিল। ধর্ম-কর্ম ও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে সিলেটের সুনাম সর্বজনবিদিত। কিন্তু কিছু নরপিশাচ, কিছু মানুষরূপী হায়না আমাদের এই গৌরবের জায়গাকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছে।

গত শুক্রবার সন্ধায় সিলেটের এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ দেখতে এসেছিলেন এক নবদম্পতি। দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষ সিলেটে বেড়াতে এলে ঘুরে যান অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং ১২৮ বছরের এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ। নবদম্পতি এমসি কলেজ হোস্টেলের কাছে এলে রাত ৮টায় কয়েকজন বখাটে যুবক স্বামীকে মারধর করে তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় কলেজের হোস্টেলে। এ সময় স্ত্রীকে বাঁচাতে স্বামী এগিয়ে এলে বখাটে সন্ত্রাসীরা স্বামীকে রশি দিয়ে বেঁধে গাড়ির মধ্যে আটকে রেখে ওই মহিলাকে উপর্যুপরি গণধর্ষণ করে। মহিলার চিৎকারে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠলেও একটুও মন গলেনি পিশাচদের।

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তারা পালিয়ে যায়। ঘটনার সাথে জড়িত যাদের নাম পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দেখেছি, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। শাহজালাল ও শাহপরাণসহ অসংখ্য ওলি-আওলিয়ার স্মৃতিবিজড়িত সিলেট নগরীতে এই অমানবিক ঘটনা দেশে বিদেশে সর্বত্র সচেতন মানুষের মনকে আহত করেছে। এই কলেজে আমার অধ্যয়ন করার সুযোগ না হলেও কলেজটি দেশের নন্দিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত। জাতীয় নেতা মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, মরহুম এম সাইফুর রহমান, মরহুম জেনারেল এম এ জি ওসমানী, মরহুম ফরিদ গাজী, মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, ড. এ. কে. আবদুল মোবিন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, ইলিয়াস আলীসহ অসংখ্য রাজনীতিবিদ, সচিব, মন্ত্রী, এমপি, চিকিৎসক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীসহ জ্ঞানী-গুণী মানুষ তৈরিতে এই প্রতিষ্ঠান রেখেছে অনবদ্য ভূমিকা। অনেক সফল মানুষরা এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসেবে গর্ব অনুভব করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কয়েক বছর যাবৎ ক্রমেই যেন এই প্রতিষ্ঠান তার গৌরব হারাতে বসেছে। সরকারি দলের ছত্রছায়ায় শতাব্দীর সর্বতুল্য এই প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে খুনি, ছিনতাইকারী, ধর্ষক, মাস্তান ও মাদকসেবী তৈরির কারখানায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গায়ের জোরে ও ক্ষমতার দাপটে বন্ধ রাখা হয়েছে রাজনৈতিক সহ-অবস্থান। শুনেছি, শাসক দল ব্যতীত ভিন্ন আদর্শের রাজনীতি চর্চার সুযোগ নেই এখানে। শুধু এই কলেজেই নয়, দেশের প্রায় সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে এখন পেশি শক্তির দৌরাত্ম্য। ফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নেই স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার সুযোগ। এই সুযোগে সমাজের চিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসীরা ঢুকে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনে।

আওয়ামী লীগ দেশের ক্ষমতায় আছে এক যুগ ধরে। এই এক যুগে শুধু এমসি কলেজ ও টিলাগড় পয়েন্টে দলটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে মারা গেছেন একডজন নেতাকর্মী। এমসি কলেজ যে স্থানটিতে অবস্থিত সেই টিলাগড় পরিণত হয়েছে সিলেট শহরের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকায়। আমরা দেখেছি, এক সময় হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কলকাকলিতে মুখরিত থাকত যে টিলাগড় পয়েন্ট তা পরিণত হয়েছে নগরীর সব অপরাধীচক্র এবং আন্ডার ওয়ার্ল্ডের অভয়ারণ্যে। রাত্রে তো দূরের কথা, দিনেও সাধারণ মানুষ সে এলাকায় যেতে ভয় পায়। ফলে একের পর এক বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এবার ঘটেছে স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে স্ত্রীকে কেড়ে নিয়ে গণধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনা। এই ঘটনা দেশের কোটি কোটি মানুষের মনকে চরমভাবে আহত করেছে।

বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়। এর আগে আরো বহুবার আমাদের দেখতে হয়েছে এমন পাশবিকতা। ক্রমে যেন ধর্ষণ আমাদের দেশে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় কলেজ ছাত্রী তনুকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। তনু হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক গৃহবধূকে গণ ধর্ষণ করে আওয়ামী লীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসী। কিছু দিন আগে রাজধানীতে একটি মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। ফেনীতে মাদরাসার সুপার কর্তৃক শ্লীলতাহানির পর গায়ে আগুন ধরিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তারই ছাত্রী নুসরাত জাহানকে। নারায়ণগঞ্জে মাদরাসাসুপার একে একে ধর্ষণ করে ১২জন শিক্ষার্থীকে।

রাজধানীর ওয়ারীতে সাত বছরের শিশু সায়মাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। নেত্রকোনার এক শিক্ষক আবুল খায়ের গত এক বছরে ধর্ষণ করেছে ছয়জন শিশুকে যাদের বয়স ৮ থেকে ১১ বছর। ধর্ষণের পর অপবিত্র অবস্থায় ধর্ষিতা শিশুদের পবিত্র কুরআন শরীফ স্পর্শ করিয়ে প্রতিজ্ঞা সে করাতো যেন এই লোমহর্ষক ঘটনা কাউকে না বলে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর মারা গেছে ১৬ জন শিশু। অপর দিকে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের হত্যা ও নির্যাতনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গত ছয় মাসে ৮৯৫ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে যৌন হয়রানিসহ নানা কারণে ১০৪ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ৪০ জন আত্মহত্যা করেছে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৯ জন।

দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি না থাকায় অন্যায় অপকর্ম কেবল বেড়েই চলছে। ঘটনার পর দেশ-বিদেশে সর্বত্র জনসাধারণ দেখাচ্ছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু যাদের হাতে রিমোট সেই ক্ষমতাসীন মহল যদি দেখেও না দেখার ভান করেন, তাহলে আমাদের ক্ষোভ বিক্ষোভ হবে কেবলই অরণ্যে রোদন। সিলেটের এই সব নরপশুর গডফাদার হিসেবে যে ব্যক্তির নাম আলোচিত হচ্ছে সে নিজেও বিচার চেয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতি দিয়েছেন জেলার দায়িত্ব প্রাপ্তমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন।

আমরা মনে করি এই চরম খারাপ সময়ে দেশের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিকট থেকে দেশ ও জাতি কাগজে শুধু বিবৃতি কিংবা সান্ত্বনাবাণী প্রত্যাশা করে না। প্রয়োজন ত্বরিত উদ্যোগ। চিহ্নিত অপরাধী এবং তাদের আশ্রয়দাতা গডফাদারদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। গডফাদারদের নিরাপদে রেখে শুধু চুনোপুঁটিদের গ্রেফতার করা হলে এটা হবে বিচারের নামে প্রহসন। গাছের গোড়া কেটে দিয়ে আগায় আমরা যত পানি ঢালি না কেন, কোনো লাভ হবে না। অপরাধী চক্রের কয়েকজন গ্রেফতার হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। কিন্তু এমন ‘গ্রেফতার নাটক’ তো অতীতে কম দেখিনি। কেউ যদি এই সব অপরাধীকে বাঁচিয়ে রেখে লোক দেখানো বিচার করতে চান এটা হবে আত্মঘাতী। এক সময় হয়তো আমরা দেখব, এই লম্পটগুলো তাদের আশ্রয়দাতাদের পরিবারের মেয়েদের দিকেও হাত বাড়িয়েছে। তাই সময় থাকতে আমাদের সবার আরো সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। বহু কষ্টে অর্জিত এই দেশ ধর্ষকদের অভায়ণ্যে পরিণত হোক, সচেতন মানুষ এটা দেখতে চায় না।

লেখক : সংগঠক ও কলামিষ্ট, নিউ ইয়র্ক


আরো সংবাদ



premium cement