নিউ মিডিয়া : সামাজিক প্রভাব ও তাৎপর্য
- ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
- ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:০৪
মূলধারার মিডিয়া তথা সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা বেতার, একই সাথে হালের অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো ব্যতিরেকে অন্য যে মাধ্যমগুলো থেকে আমরা তথ্য পাচ্ছি বা তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহার করছি তাই নিউ মিডিয়া, ‘বিকল্প মাধ্যম’ হিসেবেও এগুলো পরিচিত। নিউ মিডিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো ইন্টারনেট-নির্ভর ও ডিজিটাল মিডিয়া। ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করা ফেসবুক ও ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা টুইটার সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত নিউ মিডিয়ার উদাহরণ। এর সাথে রয়েছে ইনস্টাগ্রাম, লিংকড ইন, ইউটিউব আর লাখ লাখ ব্লগ। আসলে মিডিয়া সমাজেরই আয়না। আজকের সমাজ যে পথে ধাবিত, মিডিয়া তার উল্টো পথে চলবে, তা তো সম্ভব নয়। যুগের পরিবর্তন একেবারে বদলে দিয়েছে মিডিয়ার চালচিত্র। আমাদের চোখের সামনেই দেখা গেল প্রিন্ট থেকে টেলিভিশন, সেখান থেকে ওয়েব মাধ্যম। প্রযুক্তির কল্যাণে অর্থাৎ ইন্টারনেট আসায়, দুনিয়াও এসে গেল হাতের মুঠোয়। মুক্ত অর্থনীতি, পণ্য সংস্কৃতি এবং দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি মিডিয়াকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে- সেটা স্বাভাবিক। সেই প্রভাবের তালে তালেই সখ্য গড়ে উঠল অন্ধকার দুনিয়ার সাথেও। মোট কথা, একদা যে আদর্শের ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যম জন্ম নিয়েছিল, তার সংস্করণ, নতুন রূপ বা বিকল্প এখন কিছু এমন মানুষের হাতে, যাদের সাথে প্রতিষ্ঠিত নীতি ও আদর্শেও কোনও সম্পর্ক নেই।
নিউ মিডিয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন হলো এখানে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান কি প্রিন্ট মিডিয়ার মতো শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত? কিংবা প্রচলিত অর্থে যে ‘গেট কিপার’ প্রথা থাকে, তা কি আছে এখানে? আর সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার কারণে কি সংবাদের কনটেন্টের উপর সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ কমছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন এই মিডিয়ার সম্পাদকরাই। তবে এ কথা তো মানতেই হবে- প্রচলিত মিডিয়ার চেয়ে নিউ মিডিয়ায় মানুষের অংশীদারিত্ব অনেক বেশি। সে অর্থে তা বেশি ‘গণতান্ত্রিক’। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, পত্রিকাগুলোর অনলাইন পাঠক প্রচলিত সার্কুলেশন পাঠকের চেয়ে অনেক বেশি। পশ্চিমা বিশ্বে ইনটারনেটের ব্যাপক বিস্তারে বেশ কিছু জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে। তথ্য আজ শুধু কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষের সম্পদ নয়। অনলাইনের জনপ্রিয়তায় এমন একটি সময় আসবে যখন ম্যাস মিডিয়া আর ক্লাস মিডিয়া থাকবে না, হয়ে উঠবে সত্যিকারের গণমাধ্যম। আজ যা ঘটল, তার জন্য পরদিন পর্যন্ত আর অপেক্ষা নয়। মানুষ এখন তাৎক্ষণিকভাবে খবর চায়। টেলিভিশন আর রেডিও আসার পর পত্রিকা ধাক্কাটা সামলেছিল সম্পাদকীয় আর বিশ্লেষণী দক্ষতার জোরে। কিন্তু নিউ মিডিয়া দ্রুততার সাথে কেবল তথ্যই দিচ্ছে না, সমাজের নানা স্তর থেকে নিয়ে আসছে বহুমুখী বিশ্লেষণ। এই যে বদলে যাওয়া সেটা কি শুধু সাংবাদিকদের বদলে যাওয়া? মানুষের তথ্য চাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া? তা নয়। বদলে গেছে সমাজের তথ্য চাহিদার ধরন।
বর্তমানে সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানকে কেবল নিউ মিডিয়াই নয়, গণমাধ্যমগুলোও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এসব মাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের উপস্থাপনার ঢঙ অনেক বিষয়কেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। গণমাধ্যম কাদের গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে একজন বিশ্লেষক বলেন, পশ্চিমা পত্রিকাগুলো স্বভাবতই মধ্যপ্রাচ্যের বা মুসলিম সাহিত্যিকদের গুরুত্ব দিতে চায় না। এই ধরনের যেকোনো প্রবণতাই ক্ষতিকর। এ ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতি লেখকদের ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক লেখকই স্বাধীনভাবে লেখার সাহস দেখান না বা বিভিন্ন কারণে দেখাতে পারেন না। তবে লেখকদের জন্য এই ঘটনাগুলোর ইতিবাচকও দিকও আছে। সাহিত্য সৃষ্টির জন্য যে অনুপ্রেরণার প্রয়োজন, তার গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে এই নেতিবাচক ঘটনাপ্রবাহ। গণমাধ্যম ও সাহিত্যের বিনিয়োগ কোথা থেকে হচ্ছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
অনলাইনে আমরা প্রতিদিন অনেক তথ্যের সম্মুখীন হচ্ছি। কে ঘরের মধ্যে কী খেলো, কে কোন সিনেমা দেখলÑ জীবন ধারণের জন্য এত তথ্য লাগে না। একই সাথে অনেক ছবিও গলাধঃকরণ করছি। ফলে ছবি নির্মাতাদের জন্য কাজটা চ্যালেঞ্জের হয়ে গেছে। আগে একটা সুন্দর জায়গার কোনো দৃশ্য দেখলেই ভালো লাগত, সেখানে অনলাইনের মাধ্যমে এখন যেকোনো সময় সেটা দেখে নেয়া যায়। ফলে একটি সিনেমার ভেতরে কী আছে, সিনেমারটির আত্মা কোথায়, সেটাই এখন খুঁজে বের করতে হবে। নয়া মিডিয়ায় এখন হাজারো কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এই যে অনুশীলনবিহীন কণ্ঠহীনের কণ্ঠ- তাকে কে কেমন ভাবে দেখছেন? দর্শক শ্রোতার চোখে কোনো কালিমা লেপ্টে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে কি না- কিংবা এখানে কোনো রকম তথ্য আবর্জনার স্তূপে সমাজ ভারাক্রান্ত হচ্ছে কি না- তা দেখার দায়িত্বও সমাজের।
প্রচলিত মিডিয়াব্যবস্থায় একটা বিশেষ শ্রেণীর ঝোঁক থাকলেও নিউ মিডিয়াতে ঝুঁকে পড়েছে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ। নিউ মিডিয়ার প্রতি এই আকর্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। তাদের মতামতগুলো প্রাসঙ্গিক বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবনে আরো বেশি সহায়ক মনে করেই নিচে দু-একজনের মতামত তুলে ধরা হলো। মূলধারার মিডিয়া একটা শক্তিশালী সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে চলে বলে দ্রুত কাজ করলেও ভুলের আশঙ্কা কম থাকে। নিউ মিডিয়ায় প্রবেশের মুহূর্তে প্রশিক্ষণ জরুরি। মিডিয়ার সক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। এটি কেবল রিপোর্টারদের জন্য নয়, নিউজরুমের প্রত্যেকের জন্য।
কেননা প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত আপগ্রেড হচ্ছে। সেখানে যদি হালনাগাদ অবস্থা না থাকে তাহলে পুরো হাউজ পিছিয়ে যাবে। প্রশিক্ষণ না দিলে বিষয়টি বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে।’ ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার রিফাত নেওয়াজ নিউ মিডিয়া জগতে প্রবেশের বিষয়ে বলেন, ‘এখন যন্ত্রপাতি ডেভেলপ করেছে।
আগে আইফোন ছাড়া ভিডিও কোয়ালিটির ওপর ভরসা করা যেত না এবং সবাইকে আইফোন দেয়ার বাস্তবতাও ছিল না। এখন ১৫ হাজারের মোবাইল ফোন সেটেই সেটা সম্ভব বলে কাজগুলো সহজ হয়ে যাচ্ছে। আগে রিপোর্টাররা হাতে নোট নিতেন, তারপর অডিও রেকর্ড করতেন। এখন এর সাথে ভিডিও যুক্ত হয়েছে। কেননা মানুষ এখন দেখতে চান। এখন পাঠক-দর্শক শ্রোতার রুচি বদলে গেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সারা বিশ্বে টেকনোলজির বদলের কারণেই পত্রিকাগুলো অনলাইনে যেতে চাচ্ছে। নিউ মিডিয়া আসার আগে মানুষ পত্রিকার জন্য বসে থাকত। এখন মানুষ যেখানে আছে, নিউজম্যানকে সংবাদ সেখানে পৌঁছে দিতে হচ্ছে।’ যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে একটা গ্রুপকে ছিটকে পড়তে হবে কি না, সে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবকিছুতে যখন পরিবর্তন আসে তখন আত্মস্থ করার বিষয়টা শিখতে হয়। হাতে লেখা থেকে কম্পিউটারে যখন গেছে তখন সেটা শিখে নিতে হয়েছে। যারা পারবেন না, তারা পিছিয়ে পড়বেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস একটি পত্রিকাকে বলেন, ‘সামনের সময় মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমের। মোবাইল ব্যবহার করেই সংবাদের সব কাজ হবে। বর্তমানের সাংবাদিকতা গতানুগতিক ধারার মধ্যে প্রশিক্ষিত হয়ে আসে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে প্রত্যেকে সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে এবং সিটিজেন জার্নালিজমের কারণে তারা নিজেদের ‘সাংবাদিক’ বলে দাবিও করছে। তবে মূলধারা সেটাকে চ্যালেঞ্জ করছে এই জায়গা থেকে যে সোশ্যাল মিডিয়ার সংবাদ সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ হচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাংবাদিকতা নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি আত্মস্থ করানোর দায়িত্ব মিডিয়া হাউজগুলো যেমন নেবে, তেমনি এই ধারণাগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সিলেবাসে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করবে। প্রাচীনপন্থীরা নতুন যেকোনো কিছু গ্রহণে ‘কালচারালি শকড’ হয়। ফলে নতুনদের মধ্য দিয়ে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।’ নিউ মিডিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে তার যথাযথ নিয়মাচার, রীতিনীতি, পদ্ধতি এবং মানের আলোকে তার গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতার দিকটার প্রতি আমাদের যত্নবান হওয়া আজ সময়ের দাবি।
সময়ের বিবর্তনে ‘গতানুগতিক’ গণমাধ্যমের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমছে। সে জায়গা নিয়ে নিচ্ছে ‘নিউ মিডিয়া’ ও অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। এজেন্ডা নির্ধারণের জন্য মানুষ এখন আর গণমাধ্যমের ওপর তেমন নির্ভরশীল নয়। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তারা নিজেরাই এজেন্ডা ঠিক করে নিতে পারছে। নিজেদের মতো প্রকাশ করতে পারছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দুই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ফেসবুকের মাধ্যমে অনুসারী তৈরি করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে নিজেদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো প্রচারে তারা যতটা না গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি সহায়তা নিয়েছেন নিজস্ব ফেসবুক পেজের। পরিশেষে বলতে পারি, প্রচলিত মূলধারার চাহিদা ও তার প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় রেখে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় করে আমাদেরকে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর নিউ মিডিয়াকে আত্মস্থ করতে এবং তার সঠিক ব্যবহার ও বাস্তবায়নের কর্মপন্থার নির্ণায়ক তৈরির প্রয়াসী হতে হবে। অন্যথায় আধুনিক বিশ্বে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ব- যা আমাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। তাই সব দ্বিধা বা সংশয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নতুনকে বরণ করে নতুন মিডিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা