১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শয়তানের ডালকুত্তা ও সাংস্কৃতিক মুক্তির দিশা

শয়তানের ডালকুত্তা ও সাংস্কৃতিক মুক্তির দিশা - ছবি সংগৃহীত

উত্তর ঔপনিবেশিক চিন্তকদের অনেকেই দেখতে চান, তত্ত্ব যুদ্ধ করছে। তত্ত্বের বিপক্ষে তারা নন। তাদের কথা হলো, তত্ত্ব হবে চিন্তা ও কর্মের একটি স্টেনগান, সে গর্জাতে থাকবে। তত্ত্বকে জোগাতে হবে কাজের রক্তজল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, তত্ত্ব সাধারণত ত্যানা পেচায়। সে ঊর্ণাজালের মতো। সে প্রশ্ন সহ্য করে এবং ভেঙে পড়ে। ফলে তত্ত্ববিরোধিতাও যেমন তৈরি করে আরেক তত্ত্ব, তেমনি তত্ত্বের লেজ ধরে টান দিলে বেরিয়ে আসে আরো তত্ত্বের রোম।

তত্ত্ব বন্দুক হোক, আমিও চাই। কিন্তু তাকে বন্দুক হতে দেখছি কোথায়? অতএব তত্ত্বের জাবরকাটা নয়, আন্দোলন, বিপ্লব ও ঐক্য হলো আজকের অগ্রাধিকার- এটাই সব তত্ত্বের চেয়ে বড় তত্ত্ব। আন্দোলন, বিপ্লবে যা দরকার, সেগুলো তত্ত্ব হয় হোক, তত্ত্ব না হলেও তা আমাদের চাই। এইমে সেজেয়ার (১৯১৩-২০০৪) তত্ত্ববাদী নন। ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজমে তিনি দুনিয়ার সাংস্কৃতিক ও মুক্তিকামী আন্দোলনগুলোর কাজে আসে- এমন এক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন বুদ্ধিজীবীদের শানে। তার মতে, ‘বুদ্ধিজীবীরা বেশির ভাগই বকবক করা, খাটাশ, নীৎশের উরু থেকে বেরিয়ে আসা।’ মিসরীয় দার্শনিক ফুয়াদ জাকারিয়া (১৯২৭-২০১০) সুন্দর এক চিত্রকল্প দিয়ে দেখিয়েছেন, বুদ্ধিজীবীরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সাধারণত কী ভূমিকা নেয়, তার উপমা। জাকারিয়ার চিত্রকল্পটি হচ্ছে, মেঘের কালো আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে নিলো চাঁদ। সবই ঢেকে গেলো অন্ধকারের দীর্ঘ চুলে। কিছু জোনাকি জ্বলছিল বন-বাদাড়ে। তাদের আলোতে কিছু অন্ধ অঙ্কন করছে মহানগরীর পথঘাট।’

অন্ধকারে অন্ধদের সে অঙ্কনের কী অর্থ দাঁড়াবে? সেটা কোন বাস্তবতাকে চিত্রিত করবে? এ কারণেই বোধ হয় ফিলিস্তিনি কবি ও বুদ্ধিজীবী সামিহ আল কাসিম (১৯৩৯-২০১৪) মুক্তিকামী মানুষের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাটিতে দাঁড়িয়ে অধিপতি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভূমিকা যখন নিরূপণ করেন, তখন দেখেন, ‘তারা মাটিচাপা দিচ্ছে ইতিহাস এবং মানুষকে, এমন এক মাটিতে, যে মাটির প্রতিটি ধূলিকণা রানতিসির ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে।’ (রানতিসি হচ্ছেন, ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের অবিস্মরণীয় লড়াকু হামাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ আলী রানতিসি (১৯৪৭-২০০৪)। (ইসরাইলি নির্মম হামলায় তিনি শাহাদাতবরণ করেন) তাদের এই চরিত্রের প্রতি দৃষ্টি রেখে বহু আগেই ভারতের কবি মখদুম মহিউদ্দীন (১৯০৮-১৯৬৯) তাদেরকে উপযুক্ত আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি এদের থিংকট্যাঙ্কগুলোকে ‘শয়তানের ডালকুত্তাদের ডেরা’ হিসেবে অভিহিত করেন।
এই যে ‘অধিপতি বুদ্ধিজীবী’ শ্রেণীর সমালোচনা, মানুষের মুক্তিকামনার দিক থেকে এর একটি আন্তর্জাতিক তাৎপর্য আছে, সেখানে বাংলাদেশও আছে। ‘অধিপতি বুদ্ধিজীবী’ শ্রেণী নীৎশের উরু থেকে বেরিয়ে এসেছেন কি না, নিশ্চিত নই, তবে এটা নিশ্চিত যে, ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও মগজগঠন প্রকল্প থেকে তারা বেরিয়ে এসেছেন। ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রকল্পের সাথে তাদের গাটছাড়া কিংবা এর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিষয়টি যদি ধরতে পারি, তাহলে বোধ হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঔপনিবেশিক ও উত্তর ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও দর্শন কী ভূমিকা নেয়, তা বুঝতে পারব। বুঝতে পারব শয়তানের ডালকুত্তাদের ডেরা থেকে কিভাবে যুদ্ধ করা হয় মুক্তিকামনার বিরুদ্ধে।

সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা আমরা বলেছি। এখানে জট তৈরির জন্য কতিপয় প্রশ্ন প্রস্তুত থাকে। কেন মুক্তি? কাদের মুক্তি? কাদের থেকে মুক্তি? ... প্রশ্নগুলো যেদিক থেকেই আসুক, শেষ পর্যন্ত মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে যায়। এ জন্যই যে, মুক্তির কারণগুলো জাজ্জ্বল্যমান। মুক্তিকামী জনতার সংগ্রাম দৃশ্যমান এবং মানুষের মুুক্তির প্রতিপক্ষও চিহ্নিত। ইতোমধ্যে জ্ঞান ও চিন্তায় ‘আমি ও সে’ বলিষ্ঠতা পেয়ে ‘আমরা ও তারায়’ উপনীত হয়েছে। এটি শ্রেণীতাত্ত্বিক দিক থেকে নয়, বরং যারা মুক্তি চাইছে, আর যারা দাবিয়ে রাখছে, তাদের পরস্পরে। দাবিয়ে রাখছে মুক্তিকামনাকে; এরা কারা? কেউ বলবেন সা¤্রাজ্যবাদী সামরিকতা, কেউ বলবেন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা, কেউ বলবেন ‘রক্ত-মৃত্যুগন্ধী ধনতন্ত্র।’ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাদের বক্তব্য এক জায়গায় এসে দাঁড়ায় এবং সেটা হচ্ছে- ‘যুদ্ধের জন্য মিসাইল-ই দায়ী’। অথচ মিসাইল যখন ছিল না, তখনো যুদ্ধ ছিল। সাম্রাজ্যবাদ, অসমশক্তিতত্ত্ব কিংবা ধনতন্ত্র, যা জুলুমবাজির পরিপ্রেক্ষিত মাত্র, তাকেই কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন এরা।

এগুলো উৎসারিত হয়েছে যে জীবনদর্শন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে, সেটা অচিহ্নিত থেকে যাচ্ছে; যদিও মূল সমস্যা সেটাই। ভোগবাদী ও বস্তুতান্ত্রিক জীবনদর্শন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে মূল সমস্যা হিসেবে আমরা দেখতে পাই। কারণ সাম্রাজ্যবাদ, ধনতন্ত্র ও শক্তিমদমত্ততার শেকড়ের মূল শক্তি এখানেই। অতএব এই শেকড়কে দায়ী করার অর্থ দাঁড়াচ্ছে সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলনকে পুঁজিবাদ, কিংবা সা¤্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্তিকামনা করলেই চলবে না, তাকে লড়াই করতে হবে ভোগবাদী ও বস্তুবাদী জীবনদর্শনের আদত কাঠামোর বিরুদ্ধে। এই বিষবৃক্ষকে ঠিক রেখে পুঁজিবাদের ডালে আঘাত করবেন, বেরিয়ে আসবে সামাজিক স্বৈরাচারের মতো ধ্বংসাত্মক ডাল, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ডালে করাত চালাবেন, বেরিয়ে আসবে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারের মতো শোষণের উত্তরাধিকার। এই বিষয়টি অধরা থেকে গেছে বলেই উত্তর-ঔপনিবেশিকতার নামে সাম্রাজ্যবাদকে প্রত্যাখ্যানের দুনিয়াজোড়া আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদেরই দৃষ্টিনন্দন এক তাঁবু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যেখানে তত্ত্বের কচকচানি এবং মানবতার মুক্তি ও পুঁজিবাদ বিরোধিতার নামে অনবরত শূন্যে গোলা নিক্ষেপ হচ্ছে তুমুল, কিন্তু যথার্থ ফলাফল বেরিয়ে আসছে না।

তার মানে এই নয় যে, এডওয়ার্ড সাঈদের (১৯৩৫-২০০৩) ওরিয়েন্টালিজম ও কালচার অ্যান্ড ইমপিরিয়েলিজম কিংবা গায়ত্রী চক্রবর্ত্তী স্পিভাকের (১৯৪২-...) ইন আদার ওয়ার্ল্ডস ও পোস্ট কলোনিয়াল ক্রিটিকের মতো কাজের গুরুত্ব ও উপযোগিতাকে অস্বীকার করছি। তারা এসব গ্রন্থে সা¤্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের খোলস উন্মোচনে প্রয়াসী হয়েছেন, পাশ্চাত্যের বিশ্বদর্শনের অমানবিক দিকটিকে হাজির করেছেন এবং ইউরোপীয় আধিপত্য ও লুঠমারসর্বস্ব মনস্তত্ত্বকে দিগম্বর করে ছেড়েছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি থেকে যায়, তা হলো এই আধিপত্য ও লুঠমারসর্বস্ব ইউরোপীয় জীবনদর্শনের বিকল্প কোনো বিশ্বব্যবস্থা তাদের জানা ছিল কী? তারা কী পেরেছেন তা হাজির করতে? যতদিন তা হাজির না করা যাবে, ততদিন শুধু সাম্রাজ্যবাদকে গাল পেড়ে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন আকাশে কুসুম ফোটানোর মতো অসম্ভব থেকে যাবে।

এর অর্থ হলো, মানবতার মুক্তিকামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্যে উত্তর ঔপনিবেশিকতার গোলায় মৌলিক সঞ্চয় থাকতে হবে। যে সঞ্চয় মূলধন এবং যা না হলে সত্যিকার মুক্তি অর্জিত হবে না, তা আবিষ্কার করাই অতএব সাংস্কৃতিক মুক্তি আন্দোলনের প্রথম কাজ হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে বামপন্থা একটি হাতিয়ার হতে পারত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ধনতন্ত্রের হরিনাম কীর্তন ও সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লাঠিয়ালি ছাড়া আজকের বিশ্বে আদর্শিকভাবে এতিম তথাকথিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আর কোনো ‘পুণ্য’ নেই। এই পুণ্যের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির যে সব চিন্তা ও অনুশীলন, যে সব
আচার-আচরণ-উচ্চারণ-মতাদর্শ-মূল্যবোধ রয়েছে, সেগুলোর টিকে থাকার গোড়ায় তারা পানি ঢালেন। তারা ঢুকে পড়েন ডালকুত্তাদের ডেরায়। ঠিকানা ও উদ্দেশ্যবিচ্যুত চিন্তার ধূম্র উৎপাদন করে তারা ডালকুত্তাদের ডেরার সহযোগী হন। যে ডেরার কাজ মানুষকে তার মহিমান্বিত উৎস ও লক্ষ্য থেকে চ্যূত করে কৃত্রিম ও ভোগান্ধ এক যন্ত্র বানিয়ে দেয়া। যে ডেরা থেকে সমাজে শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণ-ভাষা, দেশ-জাতি ও সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজনের কোলাহলে মানবতাকে তার আত্মপরিচয় ও মুক্তির সত্যিকার জীবনদর্শন-অনুসন্ধান থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। সংস্কৃতিকে এর ফলে ভোগ ও পাশবিক পিপাসার নর্দমার মুখোমুখি হতে হয়। ডালকুত্তাদের ডেরা সা¤্রাজ্যবাদের হয়ে সারা বিশ্বেই পশুর পিপাসাকে উত্তাল করার কাজটিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। মানুষকে বানাচ্ছে মহিম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যবর্জিত বুদ্ধিমান পশু। বিশেষত নারীকে বানাচ্ছে পণ্য। বস্তুতান্ত্রিক জীবনদর্শন যেহেতু মানুষকে আপন পরিচয় জানতে দেয় না, এর ফলে আধিপত্যবাদী সংস্কৃতিকে প্রবৃত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়। এর মধ্যে মানুষকে ডুবিয়ে রেখে তার মুক্তিচেতনাকে ভোতা করে দেয়া যায়।

এই প্রক্রিয়া খুবই ভয়াবহ হলেও আশার বিষয় হলো, মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষই এবং প্রবৃত্তির দাসত্ব তার আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে অক্ষম। এর ফলে শেষাবধি সে নিজেকে আবিষ্কার করতে চায় এবং নিজেকে আবিষ্কার এবং মানুষ হিসেবে মানবীয় সত্ত্বার পুষ্টি ও সম্পন্নতা বিধানের প্রচেষ্টার নামই সাংস্কৃতিক মুক্তি আন্দোলন। এর সরল মানে হলো প্রত্যেক মানুষই মৌলিকভাবে সেই আন্দোলনের সম্ভাব্য সদস্য। এত বড় সম্ভাবনা যে আন্দোলনের, সে আন্দোলন ফেনিয়ে উঠলে পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের কবরের জায়গাও পাওয়া যাবে না, অতএব একে ঠেকাও, একে ঠেকাও, একে ঠেকাও।

কিভাবে ঠেকানো যাবে? ঠেকানোর পথ হলো, এ আন্দোলনকে কোনোভাবেই বস্তুবাদী জীবনদর্শনের বিকল্প জীবনব্যবস্থার দিগন্তে উপনীত হতে দেয়া যাবে না। বলা বাহুল্য, বস্তুবাদী-ভোগবাদী বালখিল্যের বিকল্প জীবন ব্যবস্থা প্রধানত ইসলাম। অতএব সাম্রাজ্যবাদের লাঠিয়ালির ফলে ‘অধিপতিশ্রেণী’ বা ‘সুশীলসমাজের’ তকমা আঁটা বুদ্ধিজীবীদের কাজই হলো- ধরো ইসলামকে, হামলে পড়ো ইসলামে উপনীত মুক্তিকামীদের ওপর।

কিন্তু প্রতিপক্ষের আকাশ কাঁপানো হট্টগোলের মধ্যেও সাংস্কৃতিক মুক্তি আন্দোলনের বিপুল স্র্রোত ইসলামের মোহনার দিকেই এগিয়ে যাবে, সেই সম্ভাবনা কি কমেছে কোনওভাবে?

লেখক : কবি, গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement