তিনি স্মৃতিতে ভাস্বর
- নীলুফার শামসুদ্দীন
- ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:৩৮
নিরন্তর কাজ করে যাওয়ার নাম যদি হয় জীবন; তবে গভীর একাগ্রচিত্তে নিষ্ঠার সাথে অবিরত কাজ করে যাওয়াই ছিল অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের জীবন। তিনি ছিলেন বিনয়ী অহংবর্জিত নিভৃতচারী একজন শিক্ষাবিদ। ছিলেন সবার প্রিয় এবং সহজ-সরল মনের মানুষ। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি জ্ঞান আহরণ করেছেন; তেমনি জ্ঞান বিতরণ করেছেন প্রিয় ছাত্রছাত্রীর মধ্যে। তার প্রেরণায় তারা উদ্দীপ্ত হয়েছেন; আশান্বিত হয়েছেন। উৎসাহ পেয়েছেন সামনে আগানোর। এক বছর এই মানুষটিকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এই এক বছরে তার কাছ থেকে যা পেয়েছি; যা দেখেছি, তার তুলনা হয় না।
১৯৬৩ সালের কথা। আমার বাবা সৈয়দ আহমদুল হককে রংপুরের এনডিসি হিসাবে বদলি করা হয়। তিনি ছিলেন ঢাকায় ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর। সবেমাত্র ঢাকা আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি দিয়েছি। রেজাল্ট তখনো বের হয়নি। রংপুরে তখন মেয়েদের জন্য একটি কলেজ করার প্রস্তুতি চলছিল। কয়েক মাইল দূরে কারমাইকেল কলেজ ছাড়া শহরের আশপাশে আর কোনো কলেজ ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে ফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই কলেজ চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। ৩০ জন ছাত্রী নিয়ে সেই কলেজের যাত্রা শুরু হলো। রংপুরের তৎকালীন ডিসি ছিলেন পাঞ্জাবি কারনী সাহেব। মূল পদগুলোতে তখন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানিরাই অধিষ্ঠিত থাকতেন। কাগজে-কলমে প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে পেলাম এলেন সাত্তারকে। তিনি ছিলেন সেই সময়কার রংপুরের এডিসি জনাব সাত্তারের সহধর্মিণী। এলেন সাত্তার ছিলেন জার্মান। ‘কাগজে-কলমে’ বলছি এ কারণে যে, তাকে কখনো কলেজ ক্যাম্পাসে দেখিনি। ভর্তির কয়েক দিনের মধ্যে জানতে পারলাম, জনাব সাত্তারকে ইলেকশন কমিশনার হিসেবে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে। তত দিনে আমরা জানতে পেরেছি, এমাজউদ্দীন স্যারই হবেন আমাদের অধ্যক্ষ। স্যার আমাদের বললেন, এলেন সাত্তারকে বিদায় সংবর্ধনা দিতে হবে। চার দিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়ে গেল। কারণ, ওটা তখন ছিল একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। চার দিকে সাজ সাজ রব। সবাই আশায় বুক বাঁধল, এরপর থেকে কলেজের কার্যক্রমে গতি পাবে।
এলেন সাত্তারের উদ্দেশে একটি মানপত্র পড়ার ভার আমার ওপর পড়ল। এমাজউদ্দীন স্যার খুব সুন্দর করে মানপত্রটি লিখে দিলেন। তিন দিন পর অনুশীলন। দুর্ভাগ্য, ঠাণ্ডা লেগে আমার গলা বসে গেল। গলায় মাফলার জড়িয়ে কলেজে যাই। তখন বর্ষা সবে শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে আসা যাওয়ায় গলাটা বেশ বসে গেল। স্যার তার অফিস রুমে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হলে তিনি আমাকে মানপত্রটি পড়তে বললেন। আমার গলার আওয়াজে স্যার ভীষণ বিব্রতবোধ করলেন। শহরের বিশিষ্টজনেরা আসবেন অথচ গলা দিয়ে ভালো করে আওয়াজ আসছে না, কী পড়ব! তারাই বা কী শুনবেন? স্যার হোস্টেল সুপার আপাকে তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠালেন। বললেন- নীলুফারের জন্য আদা, তেজপাতা, দারুচিনি দিয়ে এখনই পানি গরম করে তাকে গার্গলিং করতে দিন! এখন ২০২০ সাল। লিখছি ১৯৬৩ সালের কথা। বর্তমানে এ ‘করোনাকালে’ অতি প্রসিদ্ধ পানি সবাই যা পান করছেন তাও আদা, তেজপাতা, দারুচিনি সিদ্ধ পানি। তিন দিন ধরে এ সিদ্ধ গরম পানি আমাকে খেতে হলো এবং গড় গড়া করানো হলো। গলা পরিষ্কার হয়ে গেল। স্যার কোনো কিছুতে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র ছিলেন না। এই তিন দিন স্যার বারবার নিজে পড়ে কেমনভাবে পড়তে হবে তা তিনি বুঝিয়ে দিলেন। আমায় তিনি বললেন- ‘বুঝেছো তো! এলেন সাত্তার রংপুর ছেড়ে চলে যাবেন তাই তোমাকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মানপত্রটি পড়তে হবে। ‘Irreparable Loss’ কথাটি এমনভাবে পড়বে যেন তোমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে- এভাবে ধরা গলায় পড়বে’। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র বাবাও রাতে একবার শিখিয়ে দিলেন, কেমনভাবে পড়তে হবে। স্যারের উৎসাহ ও আন্তরিকতাকে বৃথা যেতে দেইনি। তবে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন যখন স্যারকে ডিসি কারনী বলেছিলেন, ‘এই রংপুরের মতো ছোট্ট শহরে এমন মেয়েও আছে যে এত সুন্দর ইংরেজি পড়তে পারে। এ ধরনের মেয়ে যদি আরো পাই তবে রংপুরের ঘরে ঘরে গিয়ে কলেজের জন্য মেয়ে ভিক্ষা চাইবো’।
স্যারের কষ্ট সার্থক হয়েছে দেখে তিনি ভীষণ আনন্দিত। স্যারের আনন্দ আমাকেও আত্মবিশ্বাসী করে তুলল। মেয়েদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা জাগ্রত করতে স্যার প্রথম বছরেই সেই সদ্যপ্রতিষ্ঠিত কলেজে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদযাপনের সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সৌভাগ্যবশত গান ছাড়া প্রত্যেকটি ইভেন্টেই প্রথম হয়েছিলাম। আমি যেন স্বপ্নের ঘোরে হাওয়ায় ভেসে ভেসে দিন পার করছিলাম। এক দিন বাবা ডেকে বললেন- ‘আমি সরকারি কর্মকর্তা, যেকোনো সময় আমাকে লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, করাচি যেতে হতে পারে! তুমি যদি বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনা করো, তাহলে এই প্রথম বর্ষেই তোমার পড়াশুনার সমাপ্তি ঘটবে’।
সারা জীবনভর বাংলা স্কুলে পড়েছি। এখন ইংরেজিতে পড়তে হবে। একটুও দমলাম না। স্যার আমার একার জন্য রাজশাহী বোর্ড হতে ইংরেজি মাধ্যমে লেখার অনুমতি নিয়ে দিলেন। বাবার কথাই ঠিক হয়েছিল। বাবাকে করাচি বদলি করা হলে করাচি গর্ভনমেন্ট সেন্ট্রাল উইমেন কলেজ ও করাচি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে কোনো অসুবিধা হয়নি। বরঞ্চ স্যার আমার হৃদয়ে যে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন; সে আলোয় আমি করাচির কলেজ ফাইনাল পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে প্রথম হলে করাচির মেয়রের হাত থেকে পুরস্কার নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
স্যার ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। ক্লাসে এলে বলতেন- ‘প্রতিদিন রাতের বেলা ঘুমাবার সময় গুনবে, আজ তুমি কয়টি মিথ্যা কথা বলেছ। প্রতিদিন একটি করে মিথ্যা কথা বলা কমাবে। দেখবে, আর তোমার মিথ্যা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আর প্রতিদিন একটি করে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করবে’।
মিথ্যা কথা না বলার অভ্যাস হয়তো গড়ে তুলতে পারব। কিন্তু মানুষের উপকার কী করে করব তা ভেবে আকুল! এক দিন নির্জন রাস্তায় হেঁটে বাসায় ফিরছি। পথে এক গরুর গাড়িওয়ালাকে দেখতে পেলাম। বেয়াড়া গরুকে বাগে আনতে লাঠি দিয়ে গরুকে মারছেন! হঠাৎ লোকটির হাত থেকে লাঠিটি পড়ে যায়। মার খাওয়া গরু গাড়ি নিয়ে দৌড়াতে থাকে; ফলে লোকটি নেমে লাঠিটি নেয়ার সুযোগও পাননি। আমি ভাবলাম, এটা একটা সুযোগ পরোপকার করার! তাই রাস্তা থেকে লাঠিটি তুলে নিয়ে দৌড়ে তাকে দিলাম। সেদিন তার কৃতজ্ঞতা ভরা চোখ দু’টির কথা কখনোই ভোলার নয়। তখনকার দিনে রংপুরে মেয়েরা স্কুলের শেষধাপ পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পারত না বখাটেদের দৌরাত্ম্যে। এক দিন স্কুলে মেয়েদের সাথে হেঁটে বাবার সামনে আনি সেই সব ছেলেকে। ওই সব বখাটে না বুঝে আমাদের ফাঁদে পা দেয়। এভাবে ওই সব দুষ্টু ছেলে চিহ্নিত হয়। পরে বাবা তাদের তিন মাসের জেলের ব্যবস্থা করলে বখাটেদের উৎপাত বন্ধ হয়ে যায়।
স্যারের উদারতার কথা ভুলবার নয়। কলেজ পরীক্ষায় আমি ভালো করায়, রংপুর সিটি করপোরেশন থেকে ৪০০ টাকা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেন স্যার, যখন স্বর্ণের ভরি ছিল ১০০ টাকা। এমাজউদ্দীন স্যারের পিতৃসুলভ স্নেহপরায়ণ সুন্দর মনের যে পরিচয় পেয়েছিলাম সেই কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। একবার আমরা সবাই পিকনিকে গেলাম। হঠাৎ স্যার খেয়াল করলেন, সব মেয়ে নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু আমি সেখানে নেই। তিনি আমাদের বাংলার শিক্ষিকাকে জিজ্ঞেস করলেন, নীলুফার কোথায়? শিক্ষিকা উত্তরে বললেন নদীতে কলাপাতা ধুতে গেছে। স্যার বললেন- ‘এখনি যান মেয়েটিকে নিয়ে আসেন। নদীতে পড়ে গেলে কী সর্বনাশই না হবে।’ এমন স্নেহপরায়ণ ও দরদি বাবা কে কোথায় পাবেন?
তিনি শেষ জীবনে অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করেছেন। তার পরও দেশের স্বার্থে নিজেকে নিবেদিতপ্রাণ করে রেখেছিলেন। তিনি গভীরভাবে দেশকে ভালোবাসতেন। তাই দেশকে কিছু দেয়ার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন এমন একজন মেধাবী ব্যক্তি, যার ছিল কষ্ট সহ্য করার অপরিসীম শক্তি। স্যারের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। আরো প্রার্থনা করছি আল্লাহ তাকে যেন বেহেশত নসিব করেন।
লেখক : সাবেক কলেজ শিক্ষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা