১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটি দেশের পতনের লক্ষণ

একটি দেশের পতনের লক্ষণ - ছবি : সংগৃহীত

বৈরুতে গত মঙ্গলবারের মারাত্মক বিস্ফোরণের পর লেবানন একটি উন্মুক্ত ক্ষতস্থানে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনায় প্রত্যেকের অনুভূতি কী বর্ণনা করল? বলা যায়, প্রচণ্ড ক্রোধ কেবল শুরু হয়েছে। লেবাননের মানুষ জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। দেশটি ইতোমধ্যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। মানবিক সহায়তা ছাড়া এই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ নেই। সহায়তার এই আবেদনে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও ব্যক্তি থেকে সাড়া পাওয়া গেছে।
এতে পুনরায় এটা প্রমাণিত হলো যে, তাদের হৃদয়ে এই দেশ এবং তার জনগণের জন্য একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। অনেক মানুষের হতাহতের ঘটনায় লেবাননবাসী যখন গভীর হতাশাগ্রস্ত তখন তারা বুঝতে পেরেছে বিপজ্জনকভাবে আবাসিক এলাকার নিকটস্থ বৈরুতের বন্দরে কেন এবং কিভাবে দুই হাজার টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জমা করে রাখা হয়েছিল।

বন্দরে আনুষ্ঠানিক সরকার ও হিজবুল্লাহ মধ্যকার দায়দায়িত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে ভুলত্রুটি এবং ওভারল্যাপিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বড় ধরনের অবহেলাজনিত কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। হিজবুল্লাহর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিকৃত পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় ব্যাপক বিস্ফোরণের মাধ্যমে নির্দোষ মানুষদের প্রাণহানির মতো বিরাট ক্ষতি হয়েছে। খুব কম লোকই জানে, এসব প্রধান প্রধান স্পর্শকাতর এলাকা হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর বেশি দিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া যায় না। এখন সময় এসেছে সব ধরনের দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করার।

লেবাননের জনগণ ভালোভাবে জানে, নিরাপত্তা প্রশ্নে হিজবুল্লাহই হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। এই দুর্ঘটনার পেছনে সত্যিকার অর্থে একমাত্র কারণ হচ্ছে এটা। এই মিথ্যা যুদ্ধ লেবাননকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। হিজবুল্লøাহর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যারাই তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে তাদেরকে হত্যা করা হয়। গোটা দেশ এবং জনগণ তাদের কাছে পণবন্দী। তারা বন্দর, সীমান্ত এবং অতীত ও বর্তমান সরকার, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কাকে এবং কেন পুরস্কৃত করা হবে, সেটিও তারাই নির্ধারণ করে।

হাসান নসরুল্লাহ এবং তার লোকেরা যখন বাংকারে লুকিয়ে রয়েছেন তখন লেবাননের মানুষ হিজবুল্লøাহর কর্মকাণ্ড এবং তাদের ভুলের কারণে আগুনে পুড়ছে। বিস্ফোরণের কারণ যাই হোক না কেন, বন্দরের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব যেসব লোকের ওপর ছিল তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে এবং ঘটনার জন্য দায়ী গোটা চেইন অব কমান্ডকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। গোটা দেশকে জ্বালিয়ে দিয়ে সবসময় দেশ ও জনগণের বাইরে গিয়ে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য যারা তৎপর, তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।

সত্যিকারের অপরাধীদের রক্ষা করার জন্য নিম্নপর্যায়ের কিছু সরকারি চাকরিজীবীকে বারবার ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে ব্যবহার করে এই সঙ্কটের সমাধান করা যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে, একটি দীর্ঘমেয়াদি বিচারের মাধ্যমে দেখা যাবে, ইনস্টিটিউশনগুলো কলঙ্কজনক ঘটনার প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে একে অপরকে দোষারূপ করতে থাকবে। এভাবে সত্যিকারের বিচার আর কখনো আলোর মুখ দেখবে না। শেষ না হওয়া বিচার প্রক্রিয়া লেবাননে আর চলতে পারে না।

এই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হচ্ছে একটি দেশের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বা পতন ঘটার লক্ষণ। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করে দেয়ার কারণেই এই দেশ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এটাই সত্যিকারের অপরাধ। এই হিজবুল্লাহ সংগঠনটি অনিয়ন্ত্রিত। তারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নির্দেশ দেয়। যুদ্ধে যেতে বলে, ধনী হওয়ার জন্য যারা কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য এবং কারা বুলেটের যোগ্য অথবা কারা গাড়িবোমা হামলার উপযুক্ত, সেটি তারাই নির্ধারণ করে। হিজবুল্লাহর নেতারা লেবাননের ওপর তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নির্দেশ জারি করে। যখন প্রয়োজন হবে তখনই তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ছত্রছায়ায় লুকিয়ে থেকে জনগণকে ব্যবহার করে। তারা তাদের, ভৃত্যদের জন্য রাজনৈতিক দুর্নীতিকে পুরস্কার কর্মসূচি হিসেবে ব্যবহার করে। এগুলোর মধ্যে তাদের কথিত রাজনৈতিক বিরোধীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিরোধীরাই এসব
অভিযোগ করেছে। নির্বাচনী আইনের কারণে জনগণ বারবার হিজবুল্লাহকে ভোট দিয়ে যাচ্ছে। তারা সিরিয়ায়ও তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। বিরোধীরা হিজবুল্লাহকে সরকারে ঢোকার অনুমোদন দিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী তাদের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগাচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে লেবাননের সব রাজনীতিক আর ব্যবসায়ী এলিটরা এটাকে মেনে নিয়েছেন এবং মাঝে মাঝে এই পরিস্থিতি থেকে নিজেরা উপকৃত হচ্ছেন। তারা দেশে ইরানি স্টাইলের ধর্মীয় শাসনকে মেনে নিয়েছেন এবং লেবাননে সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সহায়তা করছেন। ইরানি স্টাইলের ধর্মভিত্তিক শাসন প্রতিরোধ করার পরিবর্তে সেটা থেকে ফায়দা হাসিলের দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। লেবাননের জনগণ এটাকে যখন দেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে তখন এই এলিটরা একে সুযোগ হিসেবে দেখছে। যাই হোক না কেন, লেবাননের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী এলিটরা হিজবল্লাহর শাসনকে মেনে নিলেও সাধারণ জনগণ সেটিকে মেনে নেয়নি এবং ভবিষ্যতেও তারা তাদের শাসন কর্তৃত্বকে মানবে না। আজকে আমাদের বুঝতে হবে, প্রশমনকারী চিকিৎসা অব্যাহত রাখা যাবে না এবং অবশ্যই সঠিক রোগের চিকিৎসা করতে হবে।

দেশটি ইতোমধ্যে যখন চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে তখন হিজবুল্লøাহ নিজেদেরকে এই সঙ্কটের সমাধানকারী অর্থাৎ দেশে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বিধানকারী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু বেপরোয়া এবং ক্ষুধার্ত লেবাননি এমনকি অন্য কোনো বিকল্প দেখছেন না। কিন্তু, বৈরুতকে যখন বারবার ধ্বংস করা হচ্ছে, এই সময়েও কি জনগণ নীরব থাকবে? দেশের পরিপূর্ণ সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং হিজবুল্লাহর সামরিক অস্ত্র ধ্বংস না করা পর্যন্ত লেবানন এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। এই দাবির ব্যাপারে নীরব থাকলে অথবা বিলম্ব করলে লেবাননের জন্য কেবল অধিক দুঃখ এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

উচ্চ ঝুঁকি এবং বিপক্ষের এই সময়ে কেউ কেবল জিজ্ঞেস করতে পারে, লেবানন সেনাবাহিনীর মহৎপ্রাণ নারী ও পুরুষরা কোথায়? সন্ত্রাসী গ্রুপের লোকদের তারা আর কত দিন মেনে নেবেন? কখন তারা মানুষের চিৎকার এবং আর্তনাদ শুনেত পাবেন? কখন তারা জনগণের দায়িত্বের ডাকে সাড়া দেবেন? তারা যদি তাদের পদমর্যাদাগত বিভাজনকে ভয় পান, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে, তাদের অপেক্ষা যত দীর্ঘতর হবে, ঝুঁকিও তত বাড়বে। বৈরুতের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে। বৈরুতের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক শাসকদের দুষ্কর্মে সহযোগিতা বন্ধ করা প্রয়োজন। জনগণ ও সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসব বিপদ একত্রে মোকাবেলা করতে হবে।

এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের বাইরেও লেবানন এখন কিসের মুখোমুখি? আইনগতভাবে ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের এখনই সময়। দেশটিকে এখন সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এই মুহূর্তে লেবাননের একটি নতুন সরকার, নতুন প্রেসিডেন্ট অথবা নতুন পার্লামেন্টের প্রয়োজন নেই। লেবানন সেনাবাহিনীর এখন দেশ শাসন করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এই কমিটি বর্তমান সংবিধান স্থগিত এবং সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করবে। একটি নতুন লেবানন গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন নেই। কেবল লেবাননের জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং দেশটির সেনাবাহিনীকে একটি অধিকতর ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে একত্রে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

লেখক : মিডিয়া ও টেক কোম্পানি ইউরাবিয়ার সিইও। তিনি আল-ওয়াতান আল আরাবিয়ার সম্পাদকও।

আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : খায়রুল বাশার

 


আরো সংবাদ



premium cement
নাটোর পৌরসভা কার্যালয়ের ভিতরে দুপক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত কাঁঠালিয়ায় মাঠে ছাগল আনতে গিয়ে বজ্রপাতে কিশোরে মৃত্যু সালমান খানের বাড়িতে গুলির ঘটনায় গ্রেফতার ২ আরো দুই সদস্য বাড়িয়ে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন রাবির নতুন জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে অপরাধ না করেও আসামি হওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে : মির্জা ফখরুল লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানোৎসবে নেমে শিশুর মৃত্যু ধূমপান করতে নিষেধ করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা বড় বোনের বৌভাতের গিয়ে দুর্ঘটনায় স্কুলছাত্র নিহত কোটালীপাড়ায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত চুয়াডাঙ্গা দর্শনায় রেললাইনের পাশ থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার

সকল