একজন জ্যোতির্ময় শিক্ষক
- আবুল কাসেম হায়দার
- ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৯:২১
আমাদের আদর্শিক পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য, ব্যক্তি ও পেশাগত সত্তার বিকাশের জন্য, উচ্চতর নৈতিক ও মানবিক আদর্শের উপমার জন্য আমাদেরকে বার বার ফিরে যেতে হবে ‘কালের জ্যোতির্ময় শিক্ষক’ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীনের কাছেই।’ আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন সম্পর্কে কিছু লিখতে পারায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। বিশাল এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু কথা, শুভ কামনা পাঠক সমাজে তুলে ধরতে পেরে তার ছাত্র হিসেবে গৌরব বোধ করছি। শুরুতে যে বক্তব্যটি অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ দিয়েছেন, এতে সঠিক সত্য কথাটি বলেছেন। আমাদের জীবন চলার সমাজ গঠনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এমাজউদ্দীন আহমদ নামের শিক্ষাগুরুর চরিত্র, জীবন, কর্মকৌশল, চলার পথের কার্যাবলি জাতির জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়।
তার অর্জন ও কর্মকীর্তিকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় দীর্ঘ জীবনের সামগ্রিক গতিময়তার দিকে তাকালে। তার সৃজন ও মননের প্রাণময়তার ঐশ্বর্যের জন্য বিপুল ও বিশালতার জন্য বিস্মিত ও আনন্দিত হতে হয়।
রাষ্ট্র ও সামাজিক বিষয়ে বিদ্যায়তানিক সংগ্রামশীলতা, নান্দনিক গবেষণা আর জ্ঞানচর্চার আধুনিক বিদ্যাবংশের প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের কালের জ্ঞান মার্গের শেষ ধ্রুপদী ‘মুগল’ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন ও অখণ্ড বাংলার অন্যতম গৌরবময় জনপদ গৌড়ে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের অবিভক্ত মালদহ জেলার কালিয়াচক থানার কালিনগরে।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদের সাথে পরিচয় ও সম্পর্ক তার বিশাল কর্মময় জীবনের তুলনায় খুবই সামান্য সময়। আমার কর্মজীবন শুরু হয় সরকারি চাকরি দিয়ে ১৯৮১ সালে। পরে চাকরি ছেড়ে দিলাম। শুধু দুর্নীতি, অন্যায়, ঘুষবাণিজ্যের প্রতিবাদে সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি গ্রহণের মাধ্যমে আমার কর্মজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু। ১৯৮৩ সালে বেসরকারি চাকরি ছেড়ে তৈরী পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমার ব্যবসায়ী জীবনের যাত্রা শুরু হয়। আজো ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা, সমাজ চেতনার কাজে নিজকে নিয়োজিত রেখেছি।
অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘সংবর্ধনা গ্রন্থ’ আমাদের চিন্তার জগতে বিশাল দ্বার খুলে দিয়েছে। গ্রন্থের ভূমিকায় কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ‘অভিভাবকত্ব কতটা দায়িত্বশীল হতে পারে, তাকে না দেখলে আমরা জানতে পারতাম না। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে তার মধ্যে মিলে মিশে একাকার হয়েছে পিতার হৃদয়। বিনয় ও কোমলতার মিলিত জোসনা তাকে দিয়েছে অতল গভীরতার স্নিগ্ধতা। তিনি দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। মেধা ও প্রতিভা তার প্রকৃতিলব্ধ। তিনি প্রেমময় স্বামী। স্নেহময় দাদু। তিনি ধীর বিচক্ষণ ও প্রকান্ত। সহজ ও অনাড়ম্বর কিছু ইস্পাতের দৃঢ়তা শিরায়। সঙ্কটে তিনি সবার আশ্রয়, আশ্বাস। তার আত্মার পরতে পরতে মিশে আছে এক পাললিক মানচিত্র, বাংলাদেশ তার আশা ও আনন্দ। বাংলাদেশের সঙ্কট যেন তার ব্যক্তিগত সঙ্কটের অন্য নাম। দেশের স্বার্থই যেন তার ব্যক্তি স্বার্থের পরিপূরক।’
ড. আকবর আলি খান অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদকে ‘এমাজ ভাই’ বলে ডাকতেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম পরিচয় ঘটে ড. আকবর আলি খানের সাথে সুদূর কানাডায় কিংসটন শহরে। ড. আকবর আলি সবার ‘এমাজ ভাই’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বাঙালিদের মধ্যমণি ছিলেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন সবার ‘এমাজ ভাই’। অসাধারণ অমায়িক ও অত্যন্ত ধৈর্যশীল এই ব্যক্তিত্ব ছিলেন সবার পরামর্শদাতা। সবার বিপদে-আপদে তিনি সবার আগে এগিয়ে আসতেন। হাসিমুখে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। বাঙালির বাইরে, ভারতীয় ও পাকিস্তানি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।’ ড. আকবর আলি খান এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ ও আলোচনা করতে গিয়ে আরো নানা বিষয়ের অবতারণা করেন। তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের একটি বড় কৃতিত্ব হলো, তিনি একজন অত্যন্ত সফল পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা।’ ‘সৌভাগ্যবশত অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের মধ্যে পাণ্ডিত্য ও বাংলাপ্রীতির মণিকাঞ্চন সংযোগ ঘটেছিল। তাই তার রচিত পাঠ্যপুস্তকগুলো বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানচর্চায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।’
অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করেন। এক নিবন্ধে বলেন, ‘প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদকে আমি বন্ধু হিসেবে জানি, তিনিও আমার ধারণা, সেভাবেই আমাকে দেখেন।
এমাজউদ্দীন আহমদের অনেক গুণ, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার আন্তরিকতা ও স্বাচ্ছন্দ্য। মুখে সব সময় বলেন না, কিন্তু আন্তরিকতা সব সময় টের পাওয়া যায়। আর আছে স্বচ্ছন্দে সব কিছু বক্তব্যে চমৎকার বলার ক্ষমতা। তিনি অধ্যাপনা করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন প্রশাসনিক, লিখেন, সভা-সমিতিতে কথা বলেন, তিনি গ্রন্থমনস্ক; কিন্তু তার সব কাজে একটি নীরব ও সহজ স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষ করি। তাকে অনেক সঙ্কট পার হতে হয়েছে, আমাদের সময় ও সমাজে কেই বা সঙ্কটমুক্ত? কিন্তু আমি তাকে কখনোই শান্ত প্রাণবন্ততা ছাড়া দেখিনি। তার মতো মিষ্টভাষী মানুষও কম পাওয়া যায়।’
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের কাছে আমরা সন্তানতুল্য। তিনি আমাদের তার সন্তানের মতো স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। যখনি কখনো কোনো প্রয়োজনে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। যেকোনো বিষয়ে পরামর্শ নেয়া আমার নিয়মিত কাজ ছিল। মাঝে মাঝে কাঁঠাল বাগানের বাসায় গিয়ে দেখা করতাম।
১৯৯০ সালের পর থেকে নানা সভা-সেমিনার তার মূল্যবান বক্তব্য শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের সভায় তিনি হয়তো সভাপতিত্ব করছেন নতুবা প্রধান অতিথির বক্তব্য রেখেছেন। অল্প কথায় যুক্তিসহ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। তার বক্তব্য শোনার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। ২০০৮ সালে আমার প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী লেখালেখির যাত্রা শুরু হয় প্রকাশনা শিল্পের সাথে আমি অনেক বছর ধরে জড়িত। আমার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক প্যানোরমা’ বহু বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। বেশ কিছু দিন আগে থেকে ‘দৈনিক আজকের আওয়াজ’ সম্পাদনা করছি। তাও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ‘লেখালেখির’ জন্য এমাজউদ্দীন আহমদের নিজস্ব লেখা বই প্রকাশের উদ্দেশ্যে একটি পাণ্ডুলিপির জন্য অনুরোধ করলে খুবই সহজে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি বাংলায় ও অন্য একটি ইংরেজি বই-এর পাণ্ডুলিপি আমাকে দেন, যা পরে ২০০৯ সালে একুশে বইমেলায় ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’ এবং ‘Bangladesh from East Pakistan’ নামে প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত বাংলা ও ইংরেজি বই দুটি এক অনন্য মাত্রায় এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্বল্প সময়ে বের হয়েছে। আকর্ষণীয় অসাধারণ লেখা বই দু’টি। খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্য, ডাটা চিন্তাচেতনার এক অপূর্ব সংযোজন।
রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তরে উত্তীর্ণ স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস অত্যন্ত বিধুর। উপেক্ষা, বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রথমে প্রতিবাদ, তারপরে প্রতিরোধ এবং মার্চ শেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হয়। এই ছোট্ট বইটিতে উল্লিখিত হয়েছে যেভাবে পাকিস্তানের অদূরদর্শী শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকে পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী জনসমষ্টির স্বার্থবিরোধী নীতি অনুসরণ করেছে এবং কিভাবে সেই বঞ্চনা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ এবং তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত করে এবং চূড়ান্ত পর্বে অনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে সুশাসন ও স্বশাসন অর্জনের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই অর্জন ছিল জনগণের অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিল জনগণের বিজয়। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে, হাজারো ধারার রক্ত ঝরিয়ে, ৯ মাসের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে জনগণ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত পতাকা। প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
এত চমৎকার সুন্দর তথ্যবহুলভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ বাংলা ভাষায় দ্বিতীয় কোনো বইতে নেই। ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’ এবং ‘ইধহমষধফবংয ভৎড়স ঊধংঃ চধশরংঃধহ’। বই দু’টির ওপর গবেষণা করা উচিত। আগামীতে নিশ্চয় শুধু এই বইটির ওপর পিএইচডি করার জন্য অনেক শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবেন।
লেখক এমাজউদ্দীন আহমদ তার ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের মূল রহস্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, জন্মক্ষণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রাকৃতিক, জনমিতিক ও ভাষাগত বিভিন্নতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অর্থনৈতিক অবস্থান বিশেষ করে জনগণের প্রত্যাশা সংক্রান্ত যে কাঠামোগত ভিন্নতা তাই ১৯৭১ সালের বিস্ফোরণের প্রেক্ষাপটরূপে কাজ করেছে।’
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ছয় দফার মাধ্যমে সংঘটিত হয়নি, নানা কারণ তার মধ্যে রয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের আলাদা দেশের প্রয়োজনীয়তা জাতি এক সময় অত্যন্ত সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। তাই পুরো জাতির ঐক্যবদ্ধভাবে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত হয়েছিল। লেখক মাত্র ৮৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে তীর্যক ভাষায় সুনির্দিষ্টভাবে যুক্তিপূর্ণ আকারে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট পাঠকের কাছে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটিকে ছয়টি বড় শিরোনামে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি শিরোনামের অধীনে বেশ কয়েকটি উপশিরোনামে খুবই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। উপশিরোনামের সংখ্যাও মাত্র ৩২। বইটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্য চিন্তার খোরাক। গবেষকদের জন্য একটি অনন্য সৃষ্টি।
‘একজন কীর্তিমান পুরুষ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেছেন, ‘অনেক সময় অপরিচিত মানুষও নিজের কাছের মানুষ হয়ে উঠেন। ঘনিষ্ঠতা একজন মানুষকে সব সময় নিজের প্রার্থিত স্থানে নিয়ে না এলেও কাছাকাছি নিয়ে এসে জানার সুযোগ করে দেয়। এর প্রধান কারণ আন্তরিক অনুভূতি। মানুষ সামনে অগ্রসর হওয়ার পথে মাঝে মধ্যে পেছনে তাকিয়ে সেই স্মৃতির চিত্র দেখে অভিভূত হয় অথবা খানিকটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও সেই রূপটি কোনো ক্ষেত্রেই আর অস্পষ্ট থাকে না। এই স্মৃতি বিস্মৃতির আলোকে জড়িয়ে আছে চমৎকার অন্তরালে দুটো উজ্জ্বল চোখ আর মুখে স্মিত হাসি নিয়ে জীবনে তারুণ্য বিস্তৃতকারী একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ।’ ‘কর্মকে জীবনের প্রধান ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করায় কোনো দায়িত্ব পালনে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। সদা হাস্যময় একজন সফল প্রশাসক হিসেবে সর্বত্র তিনি দক্ষতার সাথে প্রশাসনকে গতিময় করে তুলেছেন। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, পরিচালনা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে রেখে নিজের যে প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন, তার মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন স্বকীয় স্বরূপ- বৈশিষ্ট্য নিয়ে।’
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের আরেকটি বড় গুণ- তিনি একজন হৃদয়বান মানুষ। সবাইকে আপন করে নেয়া, সবার জন্য কিছু করার সদিচ্ছা, কাউকে দূরে সরিয়ে না রেখে পরিবারের পিতার মতো সবাইকে কাছে টেনে নেয়ার যে বিরল মানসিকতা তা এ সমাজে সত্যি দুর্লভ।
তাকে পিতার মতো জানি। শ্রদ্ধা ও সম্মান করি পিতার মতো। তার পাণ্ডিত্য ও অন্তর্মুখী জ্ঞান প্রজ্ঞাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ গত ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। যারা অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের বহুমুখী সৃজনশীলতা ও গবেষণাকর্মের সাথে পরিচিত তারা একমত হবেন যে, তিনি সেই দুর্লভ বুদ্ধিজীবী যার মন পৃথিবীর সব বৌদ্ধিক তর্কবিতর্ক জ্ঞানের দিকে খোলা। অথচ যিনি নিজের চিন্তনে স্বভূমিতে স্থিত এবং দেশজ সংস্কৃতির সব কিছু তার প্রত্যয়ের অন্তর্গত। বৈশ্বিক ও দেশজ প্রপঞ্চ ও অনুষঙ্গের ভারসাম্যপূর্ণ সেতুবন্ধ তিনি।
উচ্চশিক্ষার সাথে একান্ত যোগচিত্তের, যা সব জড়তা, মূঢ়তা, কূপমণ্ডুকতা এবং সব উদাসীনতা ঘুচিয়ে এমন উন্নত বোধের বোধন ঘটায়, যেখানে আনন্দ ও সত্য হাত ধরাধরি করে স্বপ্ন ও সুন্দরের পথে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে যায়। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা ও গবেষণাকে সত্য, সুন্দর ও আনন্দের বাইরে কল্পনাও করতে পারেন না। তার কাছে শিক্ষা ও গবেষণা হলো সত্যের উপাসনা সুন্দরের প্রয়াস এবং আনন্দে অবগাহন। তিনি তার এই সত্য সুন্দর আনন্দের কর্মযজ্ঞের নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশে তার সব উত্তর পুরুষকে আচ্ছন্ন ও আবিষ্ট করে রাখেন। তার কথা মনে আমার স্মরণে এসে ঢেউ জাগায় পশ্চিম বাংলার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় কয়েকটি উক্তি :
‘তিনি আমার স্বপ্নে কিছু কথা বলেন
তিনি আমার সঙ্গে শুধুই হেঁটে চলেন
তিনি আমার সমগ্রকে ভাঙতে দড়
তিনি আমার অকস্মাৎ ও পূর্বপর’।
দেশের প্রতি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের ভালোবাসা, দেশকে নিয়ে চিন্তা গবেষণা দেশের কল্যাণে প্রতিনিয়ত তার ভাবনাগুলো তার লেখনী, বক্তৃতায়, চিন্তাচেতনায়, কাজে আমরা নিয়মিত খুঁজে পাই। চিন্তাচেতনায় সব কর্মে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবতেন। দেশের মধ্যে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা তার লেখনীতে সবসময় মানুষের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে। তিনি একজন আলো আর আলোকিত মানুষ।
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের এক অনন্য প্রতীক এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি এক আলোকবর্তিকা। তিনি অনুসরণীয় এক দৃষ্টান্ত। যতবার আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে ততবারই নিজ অবস্থান থেকে তিনি তার সঠিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্গত কারণেই বলতে হয়, তিনি আমাদের গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী। দেশকে ভালোবাসার চিন্তার ও গবেষণার স্বরূপ লেখায় দেখতে পাই, ‘বাংলাদেশ আমার স্বপ্নের দেশ’।
‘এই দেশের মাটি আর মানুষকে ভালোবাসি এবং খুব গভীরভাবে। এ দেশের মাটি সুরক্ষিত হোক আর এর অধিবাসীরা উন্নত জীবনের অধিকারী হোক এই স্বপ্ন নিয়েই তো বেঁচে রয়েছি। প্রায় চার হাজার বছর পর সর্বপ্রথম এ দেশের শাসনকাজ পরিচালিত হচ্ছে এই মাটির সন্তানদের দ্বারা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এর আগেও দেশ ছিল। দেশের মাটি ছিল। ছিলেন দেশের অধিবাসীরা। কিন্তু কোনো সময় এর নীতিনির্ধারিত হয়নি এ মাটির সন্তানদের দ্বারা। ১৯৭১ সালের পর থেকে নতুন অধ্যায়টির সূচনা হয়েছে। এই অধ্যায় অক্ষয় হোক। অমর হোক। চিরন্তন হোক। এই স্বপ্ন নিয়ে তো রয়েছি।’
দেশের বিবেকবান মানুষরা মনে করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন তার প্রাপ্য বা প্রত্যাশিত মূল্যায়ন পাননি।
দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি এর আত্মত্যাগ, পরিশ্রম অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার পরেও কেন তিনি কৌশলে উপেক্ষিত রয়ে গেলেন? ২০১০ সালে টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, এমাজউদ্দীন আহমদকে বর্তমান সরকার বা বর্তমান বিরোধী দল কেউই যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। রাজনীতি বিভক্ত এ সমাজে এ মূল্যায়ন অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য এ কারণে যে, দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীর এ মূল্যায়নে রাজনীতি ক্ষেত্রে মতামত প্রদানে এমাজউদ্দীন আহমদের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ অবস্থানই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ফলে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সব সরকারই ছিল রক্ষণশীল।
এ দীর্ঘ জীবনে তাকে ঘিরে তার ছাত্র, স্নেহভাজন ও শুভানুধ্যায়ীদের আবেগময় কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়েছে, হয়তো সরকারি স্বীকৃতি সে রকম তিনি পাননি; কিন্তু মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তিনি যে পরিমাণ পেয়েছেন, তা অনেক তথাকথিত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মানুষ শুধু স্বপ্নেই পেতে পারেন, বাস্তবে তা নয়। আমাদের সেই প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক, গবেষক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ।
লেখক : শিক্ষানুরাগী ও শিল্প উদ্যোক্তা
E-mail : : aqhaider@youthgroupbd.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা