২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পরনিন্দা রাজনীতি

পরনিন্দা রাজনীতি - ছবি : নয়া দিগন্ত

বলা হয়ে থাকে, রাজনীতি মানবচিন্তার উচ্চতম বৃত্তি। আর এটা উচ্চতম বৃত্তি এ কারণে যে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনার উৎকৃষ্টতম গুণাবলি যেভাবে প্রকাশিত এবং বিকশিত হয় তা আর অন্য কোনো কর্মকাণ্ড সম্পাদনের মাধ্যমে বিকশিত হয় না। কারণ রাজনীতি মানবকল্যাণে সর্বদা নিয়োজিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিকাশ ও বিস্তার মানবকল্যাণের মাধ্যম হলেও যে দেশে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ নেই সে দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যথাযথ বিকাশ ঘটে না।

এ ছাড়াও রাজনীতিবিদদের উচ্চারণ ও আচরণ সাধারণ জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আচরণের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে; যে প্রভাব প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণ খুব কমই লাভ করতে পরে। উদাহরণ স্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সে সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ অবরুদ্ধ ব্রিটিশ জনগণের মনোবল চাঙ্গা রেখেছিল। ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতাদের জাতীয় সঙ্কটকালে এরূপ অনেকের ভাষণের উল্লেখ করা যায়। এ ধরনের ভাষণ জনমনে শুধু সাহসই সঞ্চার করে না অনেক দূরদর্শী চিন্তারও উদ্রেক করে। বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও রাজনীতিক নেতাদের ভাষণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই ভারত উপমহাদেশের তিনটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এরূপ নেতাদের আবির্ভাব ঘটতে দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ভারতের মোহনদাস কমরচাঁদ গান্ধী ও বাংলাদেশের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম উল্লেখযোগ্য। (কোনো কোনো রাজনীতিক, বিশেষত আওয়ামী লীগাররা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ভাষণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু স্মর্তব্য, ১৯৫৭ সালের কাগমারি সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তার ভাষণে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘ওয়ালিকুম আস সালাম’ শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করেছিলেন। সেই ভাষণ পরে মুজিবের মতো স্বাধীনতাকামী নেতাদের অনুপ্রাণিত করেছে)। পড়েছিলাম : ‘রাজনৈতিক নেতার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ যেভাবে জনগণের চেতনাকে জাগ্রত করতে পারে, কোনো বই পড়ে জনমনে সেরূপ চেতনা জাগ্রত হয় না।’ দেশে দেশে জাতীয় সঙ্কটকালে ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে এরূপ নজির লক্ষণীয়। সম্ভবত এ কারণেই রাজনীতি ‘মানব মনের চিন্তার উচ্চতম বৃত্তি’ বলে স্বীকৃত হয়েছে।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের আচরণ ও উচ্চারণ দেখলে এবং শুনলে রাজনীতি যে মানব চিন্তার উচ্চতম বৃত্তি তা এককথায় স্বীকার করে নেয়া কঠিন। তাদের মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও তা আঁকড়ে ধরে রাখার যে প্রবণতা এবং এটা করতে গিয়ে তারা পরস্পরের প্রতি যে আক্রমণাত্মক ভাষার ব্যবহার ও আচরণ করেন এর থেকে জনগণ কোনো সুচিন্তার খোরাক পায় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে যা চলছে তা এক কথায় পরনিন্দা বা গীবতের রাজনীতি বলা যায়। বাংলাদেশের পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরস্পরের প্রতি যে কুরুচিপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য শোনা যায় তা কোনো কোনো সভ্য দেশের রাজনৈতিক নেতাদের উচ্চারণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনে উল্লেখ আছে- গীবত করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কারো দোষ অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা অবশ্যই তা ঘৃণা করো। তোমরা আল্লøাহকে ভয় করো।’ (সূরা হুজুরাত : আয়াত-১২) আল্লøাহ আরো বলেন, ‘আল্লøাহ মন্দ কথা প্রকাশ করা ভালোবাসেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা।’ (সূরা নিসা : আয়াত-১৪৮) রাজনীতিকদের একটি উৎকৃষ্ট ভাষণ যেমন জনগণকে অনুপ্রাণিত করে, ঠিক তেমনি গীবতের এসব রাজনীতি জনমনে সংক্রমিত হয়ে বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করে। রাজনীতিকদের এহেন আচরণে সমাজ দূষিত হয়ে পড়ে। তাই শরিয়াহর দৃষ্টিতে রাজনীতিকদের মধ্যে প্রচলিত গীবতের রাজনীতি নিন্দনীয় ও ক্ষতিকর।

কোনো কোনো দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো জুলুম করতে দেখা যায়। যেমন ভোটাধিকার জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। কতেক দেশের নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কর্তৃক জনগণের এ গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হরণের ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এ কারণে এসব দেশে গীবতের রাজনীতির মতো অপসংস্কৃতি চালু হতে দেখা যায়। এ রকম জুলুম কুরআনের ভাষায় গীবত তুল্য। তাই এটাকে এড়িয়ে চলাই উত্তম এবং সমাজ ও দেশে সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির অনুকূল। দায়িত্বশীল রাজনীতিকদের আচরণ এ লক্ষ্যে সংযত করা কর্তব্য। বিশেষত, মুসলিম অধ্যুষিত দেশের রাজনীতিকদের কুরআনের এসব উক্তি অনুসরণ করা দায়িত্ব ও ফরজ। বাংলাদেশে বা অন্য যেসব মুসলিম দেশে নিজেদের ধর্মচর্চা সীমিত অথবা পরিপূর্ণভাবে পালিত হয় না সেসব দেশে ও সমাজে এ গীবতের চর্চা সচরাচর বেশি হতে দেখা যায়। তবে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলো শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্য সাংস্কৃতিক চর্চায় উন্নত বলে সেসব দেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুসলিম অধ্যুষিত না হলেও অনুন্নত দেশের গীবতের অপসংস্কৃতি থেকে অনেকাংশেই মুক্ত। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ও সমাজে তাই ধর্মীয় শিক্ষা ও চর্চার বিস্তারের মাধ্যমে সমাজে ও দেশে গীবত এড়িয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

যেসব দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু আছে সেখানে গীবতের রাজনীতি তেমন একটা দেখা যায় না। চীনে মাও জে দংয়ের মৃত্যুর পর দেং জিয়াও বিং ক্ষমতায় এলে তার সমালোচকদের কিছু সমালোচনা তিনি সহনশীল মনোভাব নিয়ে সহ্য করতেন। তবে মাও জে দংয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী জিং কোয়িংসহ রেডিক্যাল পন্থী চার ‘কুচক্রি’কে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। কিউবার শাসক ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ভিন্ন মতাবলম্বী বোন জোয়ানা ডি লা কারিডাডসহ অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি অঙ্গরাজ্যে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার ভিন্ন মতাবলম্বী লেখক আলেকজান্ডার সোলজেনিৎসিন নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০০৮ সালে রাশিয়াতেই মৃত্যুবরণ করেন। তবে অনেক ভিন্ন মতাবলম্বী যুক্তরাষ্ট্র্রে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। সাধারণত, সমাজতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সহ্য করা হয় না। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রে, গণতান্ত্রিক কোনো কোনো দেশে যেমন ভিন্নমত প্রকাশকারীদের সহ্য করা হয়, তেমন হয় না কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এ করকম নেই বললেই চলে।

ইসলামী রাষ্ট্রে ভিন্নমত শরিয়াহসম্মত হলে তা গ্রহণ করা হয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা যায়। ইসলামী রাষ্ট্রে নারীরা আইন প্রণয়নেও ভূমিকা রাখতে পারেন, এর সূত্র ধরে উল্লেখ করা যায় বিখ্যাত একটি হাদিস একবার খলিফা ওমর রা: সাহাবিদের সাথে মোহরের সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন, যাতে যুবকরা বিয়েতে উৎসাহিত হতে পারে। সে সময় পেছনের সারি থেকে জনৈক মহিলা প্রতিবাদ করে বললেন, কুরআন বলে- ‘তুমি বিপুল পরিমাণ সম্পদ দিতে পারো মোহর হিসেবে।’ (সূরা নিসা : আয়াত-২০) ‘যেখানে কুরআন মোহরের সীমা নির্ধারণ করেনি, সেখানে ওমর মোহরের সীমা নির্ধারণ করার কে?’ তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মহিলা। একজন সাধারণ মহিলা ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাজের প্রতিবাদ করতে পারেন। আইনের পরিভাষায় বলা যায়, ওমর রা:-এর আমলের সেই মহিলা সংবিধানচ্যুতির প্রতিবাদ করেছিলেন। কারণ মুসলিমদের সংবিধান হিসেবে আল কুরআনকে মান্য করা হয়, তাই কুরআনের অনুকূলে যুক্তি দেখিয়ে একজন সাধারণ মহিলাও আইন প্রণয়নে অংশ নিতে পারেন। সাধারণত কোনো গণতান্তিক দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে‘ভিত্তিহীন' তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের মোদির মুসলিমবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় সংখ্যালঘু নেতাকে বহিষ্কার ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নতুন কনসাল জেনারেল সেহেলী সাবরীন চান্দিনায় পানিতে ডুবে একই পরিবারের দুই শিশু মৃত্যু কেএনএফ সম্পৃক্ততা : গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কে যা জানা গেছে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ক্যাপ, পানি ও স্যালাইন বিতরণ করেছে ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগর পশ্চিম নোয়াখালীতে হিট স্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় স্ত্রীর ২৭ স্থানে স্বামীর ধারালো অস্ত্রের আঘাত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ১২ উপজেলায় মানববন্ধন রোববারই খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবার ক্লাসসহ ৪ নির্দেশনা

সকল