২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রবিঠাকুর থেকে বিশ্বকবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - ছবি : সংগৃহীত

রবিঠাকুর থেকে বিশ্বকবি নামক প্রদীপের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ভট্টনারায়ণের সময়কাল থেকেই। তিনি ছিলেন এক দিকে বেদজ্ঞ, পণ্ডিত, সংস্কৃত সাহিত্যে পারদর্শী অপর দিকে বেণীসংহার নাটকের রচয়িতা। ধনঞ্জয় ছিলেন রাজা বল্লাল সেনের (১০৮৩-১১৭৯) রাজ্যের বিচারকসহ বৈদিক শব্দ নির্ঘণ্টের সঙ্কলক। হলায়ূদ মিশ্র ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের (১১৭৮ থেকে ১২০৬ সাল) প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারক। তিনি অনেক সংস্কৃত গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। এরাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ।

তাদের ধারাবাহিকতায় পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতা দ্বীজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বোন স্বর্ণকুমারী, মেঝো বৌঠান জ্ঞানদা নন্দিনী ও নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী- জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সঙ্গীত-শিল্প ও নারীজাগরণ প্রভৃতি বিষয়ে তাদের একেকজন একেক বিষয়ের দিকপাল হিসেবে প্রেরণা জুগিয়েছেন রবিঠাকুরকে।

জোড়াসাঁকোর স্থপতি ‘প্রিন্স’ দ্বারকানাথ ঠাকুর। ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও সুরসিক। ১৮২১ সালে রামমোহন প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক সংবাদ কৌমুদিনী সম্পাদক ছিলেন দ্বারকানাথ। ইংরেজি সাপ্তাহিক বেঙ্গল হেরাল্ড’ এবং বাংলা ‘বঙ্গদূত’ কাগজের সূচনাও হয়েছিল তার হাতে। এ ছাড়া তার অর্থসাহায্যে চলত ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘ইংলিশম্যান’ প্রভৃতি সংবাদপত্র। যা হোক, ১৮৩৮ সালে পিতামহী অলকা সুন্দরীর মৃত্যুকালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি ধর্মবিষয়ে আগ্রহী হয়ে মহাভারত, উপনিষদ ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন শুরু করেন। এর ফলে পার্থিব বিষয়ের প্রতি তার অনীহাসহ ঈশ্বর লাভের আকাক্সক্ষা প্রবল হয়। ১৮৩৯ সালে তত্ত্বালোচনার উদ্দেশ্যে তত্ত্ববোধিনী সভা স্থাপন করেন। তিনি ১৮৪২ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৮৪৮ সাল থেকে ঋগ্বেদের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন। ১৮৬৯ সালে ‘ব্রাহ্মধর্ম’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৮৬৭ সালে তিনি বীরভূমের বিশাল ভূখণ্ড ক্রয় করে আশ্রম স্থাপন করেন। এই আশ্রমই আজকের বিখ্যাত ‘শান্তিনিকেতন’। দেবেন্দ্রনাথের ৯ ছেলে ও ৬ মেয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চতুর্দশ। অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কবি, পণ্ডিত, গীতিকার, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ। তিনি বাংলা শর্টহ্যান্ড ও স্বরলিপি রচনার অন্যতম অগ্রপথিক। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন লেখক, সঙ্গীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়।

নারীমুক্তি আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় পরিচয়, ১৮৪৪ সালে কলকাতায় জন্মানো ২১ জন ‘প্রকৃত’ ব্রাহ্ম সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম। তিনি কঠোর অনুশাসনসহকারে ছোট ভাইদের পড়াশোনায় নজর রাখতেন। বিশাল পরিবার ও সম্পদের প্রশাসকও ছিলেন তিনি। আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন নাট্যকার, সঙ্গীতস্রষ্টা, সম্পাদক ও চিত্রশিল্পী। প্রতিভাদের খুঁজে বের করার বিরল ক্ষমতা ছিল তার। ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি পারিবারিক নাট্যদল গঠন করে নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করেন। ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’ যেখানে প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’। ১৮৬৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আহমেদাবাদ থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ সেতার বাজাতে ও ছবি আঁকতে শেখেন। নিজ পরিবারসহ নানা বিষয়ে ২০০০টি স্কেচ রবীন্দ্র ভারতী তার বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ফকির লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে পদ্মায় নিজের বজরায় বসিয়ে লালনের পেন্সিল স্কেচটি অঙ্কন করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, যা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

রবিঠাকুরের সাত বছর বয়স থেকে সাথী নয় বছর বয়সী বৌদি কাদম্বরী দেবী। নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীই ছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথের শ্রোতা, প্রেরণা ও উসকানিদাত্রী। ঠাকুর পরিবারে অবহেলিত কাদম্বরী ছিলেন রবিঠাকুরের প্রাণপ্রিয়। ১৮৬৮ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের চার মাসের মাথায় অসহ নিঃসঙ্গতা বুকে নিয়ে ১৮৮৪ সালে আফিম সেবন করেন কাদম্বরী। তিন দিন ছটফট করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শুরু হয় রবীন্দ্রজীবনে শোকগাথা (Elegy)। মাত্র ২২ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটিয়ে অজানা রোগে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু ১৯০২ সালে।

পরের বছর মারা যায় মেজো কন্যা রেণুকা (রানী)। রেণুকার বিয়ে হয়েছিল শৈশবেই। মেহেদির রঙ না মুছতেই মরণব্যাধি ক্ষয়রোগে রানী মারা যান। স্নেহের কনিষ্ঠ পুত্র সমী। স্ত্রী বিয়োগের পাঁচ বছরের মাথায় একই তারিখে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে সমী মারা যান ১৯০৭ সালে। রবীন্দ্রনাথের ছোট কন্যা মীরা। স্বামী নগেন্দ্রনাথ কবিগুরুর টাকায় আমেরিকা থেকে লেখাপড়া শেষে খ্রিষ্টান হয়ে মীরাকে ছেড়ে চলে যান। মীরার ছেলে নীতুকে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশনা শিল্পে শিক্ষালাভের জন্য জার্মানিতে পাঠান, কিন্তু মাত্র ২১ বছর বয়সে মরণব্যাধি যক্ষ্মায় ১৯১২ সালে মারা যায় একমাত্র দৌহিত্র। তার অন্তর্ধান সহ্য করতে না পেরে বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ নিজের নামের আগে ‘শ্রী’ লেখা বর্জন করেন। আদরের বড় কন্যা মাধুরী লতা (বেলা)। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার তিন বছরের কন্যা মাধুরী। ‘কাবলিওয়ালা’ গল্পের মিনি এই মাধুরী লতা।
‘দেনা-পাওনা’ গল্পের ‘নিরুপমা’ও সে। মাধুরী লতা ওরফে বেলার বিয়ের সময় ২০ হাজার টাকা (যেখানে ১৮৩৪ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি কিনেছিলেন ১৩ টাকা ১০ আনা দিয়ে) যৌতুক চেয়েছিল বর পক্ষ। স্ত্রীর সব গয়না বিক্রি ছাড়াও ঋণ করে ১০ হাজার টাকা যৌতুক দিয়েছিলেন কবি।

এই বিয়ের যৌতুক পরিশোধ করতে যা হয়েছিল তা নিয়েই রবির ছোটগল্প ‘দেনা-পাওনা’। বিয়ে হয়েছিল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী তৃতীয় পুত্র শরৎকুমারের সাথে। তাকে কবি নিজ খরচে বার অ্যাট ল করিয়েছেন। অথচ কবির সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করেন শরৎকুমার। এমনকি কবির ‘নোবেল প্রাপ্তি’র বিজয় উৎসবে তিনি নিজেও আসেননি, স্ত্রীকেও আসতে দেননি। তার পরও মাধুরী লতা যখন মরণব্যাধি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন, তখন কবি প্রতিদিন জামাতার বাড়ি চলে যেতেন। মেয়ের হাত ধরে বসে থাকতেন। তবে যক্ষ্মার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। বড় মেয়ে চলে গেলেন ১৯১৮ সালে। কবির একমাত্র জীবিত পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘজীবী হলেও ছিলেন নিঃসন্তান।

রবীন্দ্রমানস গঠনে বৌঠান কাদম্বরীর দান চিরস্মরণীয়। তিনি সবসময় রবীন্দ্রনাথকে এই বলে উসকে দিতেন যে, ‘রবি সবচেয়ে কালো দেখতে, গলার যে কী অবস্থা, ওর চেয়ে সত্য ভালো গায়, ও (রবি) কোনো দিন গাইতেই পারবে না। কোনোকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতেও পারবে না।’ রবীন্দ্রনাথের তখন শুধু চেষ্টা থাকত কী করে এমন হবেন যে, নতুন বৌঠান আর কোনো দোষ খুঁজে পাবেন না তার মধ্যে। সেই সাধনাটিই করছিলেন কাদম্বরী, যাতে কেউ কোনো দিন রবীন্দ্রনাথের দোষ খুঁজে না পায়। যখন রবীন্দ্রনাথ এটি উপলব্ধি করলেন তখন চিরতরে হারিয়ে গেছেন ‘নতুন বৌঠান’। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রদীপে তেল সলতে লাগিয়ে আলো জ্বালাবার কাজ তখন সারা। কিন্তু প্রিয় বৌঠান তখন চির অন্ধকারে, হয়তো তাই কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে, ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই/নয়নেরই মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই’

Elegyশব্দের অর্থ শোকগাথা। প্রিয়জন বিয়োগে মানুষের মন চিরদিনই ব্যথিত ও উৎকণ্ঠিত থাকে। বেদনা ও উৎকণ্ঠার মাঝে মানুষ খোঁজে সান্ত্বনার ঠাঁই। কবিগুরুর সান্ত্বনার ঠাঁই ছিল সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চা। কবি বিশ্বাস করতেন, ‘মনভরে চাইলে মৃত ব্যক্তির আত্মা দেখা করেন’। কবি পদ্মার বোটে, বাদল দিনে, গভীর রাতে, একাকী সন্ধ্যায়, বিজন মাঠে মৃত আপনজনের আত্মা খুঁজে ফিরতেন সারাজীবন। মৃত্যুর ছয় বছর আগে ১৬ জুন ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ চন্দননগরে। শরীর দ্রুত ভেঙে পড়ছে। কবির পাশে রানীচন্দ। এখানেই তো তেইশ বছর বয়সে তার নতুন বৌঠান কাদম্বরীর সাথে কাটিয়েছিলেন দীর্ঘ ছুটি। বৃদ্ধ বয়সে যেন কাদম্বরী দেবীর খোঁজেই সর্বশেষবারের মতো চন্দননগর ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন বানীচন্দকে, ‘মনে পড়ে আমার নতুন বৌঠানকে। দেখ, মরে যে যায়, সে যায়ই। আর তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। শুনতাম, ডাকলে নাকি আত্মা এসে দেখা দেয়। সে ভুল।

কবিগুরুর সৃষ্টিকর্মজুড়েই তো আপনজন খোঁজার স্তুতি, না পাওয়ার বেদনা।

‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।’

এবং

‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম/
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম ॥
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন/
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম।’

কবিগুরুর কবিতা ও গানে কান পাতলেই আপনজনদের হারিয়ে যাওয়ার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। বিশ্বে যারা প্রিয়জনহারা তারাই ছুটে আসেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সান্ত্বনা খুুঁজে পান রবীন্দ্রসৃষ্টিকর্ম দেখে। রাশিয়ার এক অধ্যাপক শুধু রবীন্দ্রনাথকে জানার জন্য বাংলা ভাষা রপ্ত করেছিলেন। তা দেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সেখানকার একজন মানুষ প্রাচ্যের কবি রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করবার জন্য বাংলার মতন একটি দুরূহ ভাষা শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, এটা বিস্ময়কর নয়?’

কালের পরিক্রমায় সব কিছু হারিয়ে গেলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবেদন ফুরাবে না। মানবিকতা যত দিন বেঁচে থাকবে তত দিন বেঁচে থাকবে প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা নিয়েই তো অধিকাংশ রবীন্দ্রসঙ্গীত।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement