২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনা মহামারী : আতঙ্ক, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও প্রতিকার

করোনা মহামারী : আতঙ্ক, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও প্রতিকার - ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীর সকল দেশ এখন এক মহামারী রোগে বিপর্বযস্ত। রোগটির নাম কোভিড-১৯, কিন্তু করোনা রোগ বলে সর্বমহলে আতঙ্কের সাথে খুব বেশি পরিচিত। যে ভাইরাস এ রোগ ছড়ায় সেটি করোনা ভাইরাস পরিবারভুক্ত। রোগের নাম নির্ধারণ করে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ভাইরাসের পরিবার ও জিনগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এর নামকরণ করে অন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিটি। সে কারণে রোগ ও ভাইরাস এর নামে বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন AIDS (Acquired Immune Deficiency Syndrome) রোগের ভাইরাসের নাম HIV (Human Immunedeficiency Virus)। করোনা পরিবারের ৪টি ভাইরাস নিয়ে আমরা জীবনযাপন করছি বহুদিন ধরে। এ ৪টি ভাইরাস সাধারণ সর্দি, জ¦র বা Common Cold সৃষ্টি করে, যা খুব মারাত্মক নয়। এ পরিবারের ৫ম ভাইরাসের কারণে SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) রোগের উৎপত্তি। ২০০৩ সালে এ রোগে বিভিন্ন দেশে ৭৭৪ (মোট আক্রান্তের ১০%) জনের মৃত্যু হয়েছিল। করোনা পরিবারের ৬ষ্ঠ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগের নাম MARS (Middle East Respiratory Syndrome) । ২০১২ সালে এ রোগে আক্রান্তদের শতকরা ৩৪ ভাগ মৃত্যুবরণ করে। আর করোনা পরিবারের ৭ম সদস্য হিসেবে ২০১৯ সালে SARS-CoV-2 নামের ভাইরাস কোভিড-১৯ মহামারী আকারে সারা বিশ্বে আশঙ্কাজনকভাবে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত করে চলেছে।

এভাবে বিভিন্ন সময়ে কোন কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে পৃথিবীব্যাপী মহামারীর সৃষ্টি হয়েছে। চতুর্দশ শতকে Black Death হিসেবে পরিচিত প্লেগ মাত্র ৪ বছরে ইউরোপে ২০ কোটি লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। ১৯১৮ সালে একটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামের রোগে ১৫ মাসে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এসব ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ এখনও আছে। তবে মহামারী আকারে নেই। মারাত্মক রোগ সৃষ্টকারী মাত্র ২টি ভাইরাস পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে। একটি Small Pox (Variola ভাইরাস) এবং অপরটি জরহফবৎঢ়বংঃ নামক গবাদি প্রাণির রোগের ভাইরাস। এ রোগে আক্রান্ত সকল গবাদি প্রাণি মারা যেত। আমাদের দেশসহ বহুদেশ থেকে পোলিও রোগ নির্মূল হলেও কোন কোন দেশে এ রোগ এখনও আছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন পোলিও, ডিপথেরিয়া, হাম প্রভৃতি রোগের ভাইরাসও নির্মূল হবে। ভাইরাস নির্মূলের জন্য ভাইরাসের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্র, টিকা, চিকিৎসা, অর্থ, রাজনৈতিক অঙ্গীকার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত এবং এর জন্য সময়ের প্রয়োজন।

করোনা বলে বর্তমানের আতঙ্ক কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাবের বয়স মাত্র ৮ মাস। এর মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ১০০টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ রোগের টিকা উদ্ভাবনে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ট্রায়াল বা মানুষের ওপর টিকার কার্যকারিতার পরীক্ষায় অগ্রগতিও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় কোভিড-১৯ ও এর ভাইরাস নিয়ে প্রায় ১৫ হাজার গবেষণাপত্র আছে। কোন সংক্রমণজনিত রোগ থেকে মুক্তির জন্য আদ্যাক্ষর `P’ সম্পর্কিত প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধমূলক কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এগুলো হলো Precaution, Prevention, Promotion, Protection, Persuasion এবং প্রতিকার হিসেবে সর্বশেষ চিকিৎসা। সে প্রেক্ষাপটে দেশে প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, রোগীকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখা, এলাকা লকডাউন করা, মাস্ক ব্যবহার করা, সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া এসব কার্যক্রম দেশে চলমান আছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। রোগ শনাক্ত করার জন্য পরীক্ষা, করণীয় সম্পর্কে গাইডলাইন প্রণয়ন, প্রশিক্ষণ, হাসপাতালে চিকিৎসা সম্পর্কিত সুযোগ সৃষ্টি, অনলাইনে পরামর্শ প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের বহুমুখী মাধ্যম থাকার কারণে এর সংক্রমণের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

করোনার এ মারাত্মক প্রজাতির ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা যেমন বহুমুখী, তেমনি মানুষের শরীরে এর আক্রমণ ক্ষমতাও বহুবিধ। প্রথমে মনে করা হয়েছিল যে ফুসফুস সংক্রমণ করে রোগীকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করে ও মৃত্যু ঘটায়। এখন দেখা যাচ্ছে এ ভাইরাস ফুসফুস ছাড়াও স্নায়ুতন্ত্রে সংক্রমণ করে, তাই খাবারের স্বাদ নষ্ট করে ও নাকে গন্ধ পাওয়া যায় না। পরিপাকতন্ত্রে সংক্রমণ করে ডায়রিয়া ও বমি সৃষ্টি করে। হৃদযন্ত্রে সংক্রমণ করে হৃদযন্ত্রের পেশি দুর্বল করে। কিডনির যেসব কোষ রক্ত থেকে বর্জ্য বের করে, সে সব কোষ নষ্ট করে। রক্তের স্বাভাবিক তারল্যতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ভাইরাসটি রক্ত জমাট বাঁধতে (থ্রম্বাস) বাধ্য করায়। ফলে জমাট বাঁধা রক্ত পায়ের, ফুসফুসের এবং মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম নালীতে বেঁধে যায়, সে কারণে পায়ে ‘ডিপ-ভেইন-থ্রম্বোসিস’ (ডিভিটি), ফুসফুসে পালমোনারি এম্বোলিসম্ ও মস্তিষ্কে স্ট্রোক হতে পারে। ফলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।এ ভাইরাস রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে রক্তচাপ বৃদ্ধি ও অনিয়মিত করে। ফুসফুসের বায়ু ধারণের কোষসমূহে অকেজো করে এবং রক্তে অক্সিজেনের প্রবাহ কমিয়ে দেয়। কাজেই, এ ভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা বিবেচনায় আক্রান্ত রোগীকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সংক্রমণের পূর্বেই মৃদু লক্ষণ থাকাকালে প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর খুবই বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

মারাত্মক প্রজাতির এ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য পৃথিবীজুড়ে যেমন : ভ্যাকসিন আবিষ্কারের নিরলস প্রচেষ্টা আছে, তেমনি আছে রোগ নিরাময়ে ওষুধ আবিষ্কারের প্রয়াস। বর্তমান সময়ে চিকিৎসার জন্য
নিম্নবর্ণিত চারটি (০৪) পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে :

ক. এন্টিবডি থেরাপি : কোন মানব বা প্রাণি দেহ থেকে এ ভাইরাস প্রতিরোধী এন্টিবডি শনাক্তকরণ এবং তা ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদন করে ওষুধ হিসেবে ভাইরাসের বংশ বিস্তার রোধ করা।
খ. এন্টিভাইরাল থেরাপি : এ রোগের ভাইরাসকে সরাসরি প্রতিরোধ করে এর বংশ বিস্তার বন্ধ করা।
গ. প্লাজমা থেরাপি : এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্ত থেকে প্লাজমা বা রক্ত রস আলাদা করে রোগীর শরীরে প্রয়োগ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।
ঘ. অন্যান্য রোগে ব্যবহৃত ওষুধের প্রয়োগ : ম্যালেরিয়া বা অন্য কোনো জীবাণু বাহিত রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ এ ভাইরাসজনিত রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। সবই চলছে পরীক্ষামূলকভাবে।

পরীক্ষামূলক এ প্রক্রিয়া কোভিড-১৯ চিকিৎসায় Trial and Error ভাবে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ওষুধ, যেগুলো আগে অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় নির্দেশিত ছিল, সেগুলোকে এখানে ব্যবহার করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। যাকে ইরেজিতে বলে ’রিপারপাজিং’। এর মধ্যে Chloroquine, hydroxycloquine, azithromycin, doxycycline, favipiravir, remdesivir, ivermectin, অন্যতম। সাথে আছে জিঙ্ক, ভিটামিন, প্যারাসিটামল, এন্টি-কোয়াগুল্যান্ট, স্টেরয়েড, anti-histamine এবং শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির বিভিন্ন ওষুধ ও খাদ্যের তালিকা। আমাদের দেশে এ রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য প্রণীত `National Guideline on Clinical Management of Corona Virus Disease-2019 (Covid-19)' শীর্ষক গাইডলাইনে Mild, Moderate, Severe, and Critical-এ ৪টি শ্রেণির রোগীর মধ্যে Mild I Moderate রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। Mild অর্থাৎ মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগীর জন্য প্যারাসিটামল ও এন্টিহিস্টামিন ওষুধ এবং গরম জলের ভাপ শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে গ্রহণের পরামর্শ আছে।
Moderate রোগীর জন্য Mild-এর অনুরূপ চিকিৎসার পাশাপাশি এন্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে azithromycinসহ সংক্রমণের ধরন অনুযায়ী অন্যান্য এন্টিবায়োটিকও ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণত কোন এন্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না, কাজ করে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে। তবে কোন ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে অন্যকোন সুযোগ সন্ধানী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। অপরদিকে, টেট্রাসাইক্লিনসহ কিছু এন্টিবায়োটিকের কোন কোন ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিকে বাধা দেয়া ও বিস্তার রোধের ক্ষমতা রাখে। azithromycin ও doxycycline এ জাতীয় এন্টিবায়োটিক বিধায় করোনায় আক্রান্ত রোগীদেরকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছেন।

করোনা মহামারী বিস্তাররোধ ও চিকিৎসার জন্য প্রণীত গাইডলাইন প্রণয়নে দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক, অনুজীব বিজ্ঞানী এবং গবেষকবৃন্দ সম্পৃক্ত ছিলেন ও আছেন। ২৮ পৃষ্ঠার গাইডলাইনটি একটি উচ্চমানের অনুকরণীয় দলিল সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রণীত গাইডলাইনে ivermectin নামক ওষুধ ব্যবহারের কোন নির্দেশনা নেই। অথচ শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ের ওষুধের দোকানে ivermectin ও doxycycline-এর ব্যাপক চাহিদার কথা শোনা যাচ্ছে। অধিকাংশ দোকানে সাপ্লাই আসার সাথে সাথে নাকি বিক্রি শেষ। এভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যে কোন ধরনের ওষুধ সেবন করা কখনই কাম্য নয়। অস্ট্রেলিয়ার মনাস ইউনিভার্সিটির Biomedical Disease Institute (BDI) একই দেশের Doherty Institute, মেলবোর্ন বিশ^বিদ্যালয় ও মেলবোর্ন হাসপাতালের সাথে এক যৌথ গবেষণায় প্রকাশ করেছে যে, কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী SARS-CoV-2 ভাইরাস ivermectin ওষুধ ৪৮ ঘণ্টায় মারা যায়। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. তারেক আলী এবং তার সহকর্মীবৃন্দ ivermectinIdoxycycline-এর যৌথ প্রয়োগে ৩ দিনে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয় বলে প্রমাণ। জানা গেছে যে, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতিক্রমে ivermectin-এর একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। আমরা সেই ট্রায়ালের সুফল কামনা করি। doxycycline হচ্ছে টেট্রাসাইক্লিন গ্রুপের একটি এন্টিবায়োটিক। সে কারণে ভাইরাসের বিস্তাররোধে এর ভূমিকার কারণে হয়তো vermectin-এর সাথে doxycycline করোনার এ মারাত্মক প্রকৃতির ভাইরাস প্রতিরোধে এবং একইসাথে অন্য রোগের সংক্রমণ রোধে ভাল কাজ করছে। দেশের এ্যাপোলো হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল এবং কিছু নামকরা বেসরকারি হাসপাতাল এ দুটো ওষুধসহ অন্যান্য ওষুধ বিশেজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দ বহিঃস্থ রোগীদের ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। এমনকি সরকারি সেক্টরের কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতাল (সিএমএইচ) ও পুলিশ হাসপাতাল ivermectinIdoxycycline ওষুধ ব্যবহার করছে। তবে ডোজের ক্ষেত্রে কিছু বিভিন্নতা আছে, যা সমন্বিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বহুমুখী ব্যবহার ও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের উপকারী কিছু ওষুধকে ‘বিস্ময়কর ওষুধ(Wonder Drug) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেমন- পেনিসিলিন, ইকোস্প্রিন ইত্যাদি। এ বিস্ময়কর ওষুধের তালিকায় ইতোমধ্যে Ivermetin জায়গা করে নিয়েছে। ফাইলেরিয়া, চর্মরোগ, উকুন এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর পরজীবী সৃষ্ট রোগ নিরাময়ে এবং পুষ্টির অবস্থা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে Ivermetin স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশে ব্যবহার অত্যন্ত বেশি। এ জন্য একে গরিবের ওষুধ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৭০ এর দশকে জাপান কর্তৃক আবিষ্কৃত এ ওষুধ পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলে সুলভ মূল্য ও সহজ ব্যবহার (মাত্র একডোজ গিলে ফেলা) এবং বহুমাত্রিক ব্যবহারের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। মাথাধরা, বমি বমি ভাব, পাতলা পায়খানা, চুলকানি, হাত-পা ফুলে যাওয়া, প্রাথমিক দুর্বলতাসহ কিছু কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা মাত্রা নির্ভর। কম-বেশি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই, এমন কোন ওষুধ নেই। তবে Ivermetin এর যে ডোজ (একবার বা সর্বোচ্চ দু’বার), তাতে পাশ্ব প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত কম।

আমরা এখন করোনা সংক্রমিত এ রোগের তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করছি। অর্থাৎ মাঠপর্যায়ে পরিবারে-সমাজে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা চীন, ইউরোপ বা অন্য অঞ্চলের থেকে অনেক ভিন্ন। অনেক উন্নয়নের পরেও সমাজে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোষণ, বঞ্চনা, সংঘাত, দারিদ্র্য ও বিভাজন আছে এটা যেমন সত্য। তেমনি এটাও ঠিক যে সেখানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যগত একটা ঐক্য আছে। আছে পরিবারে ও সমাজে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সমঝোতা ও সমবেদনার একটা শক্ত জমিন। পরিবার এবং গ্রামবাসীর সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার এ ঐতিহ্যগত অনুভূতির কারণে ঈদ বা কোন উৎসবে অনেক কষ্ট করেও আমরা গ্রামে ফিরে যাই। পারিবারিক ও সামাজিক এ ঐতিহ্যগত বুননের কারণে করোনা মোকাবেলার জন্য আরোপিত লকডাউন ভালভাবে কাজ করেনি- একথা হয়তো সত্য। সাথে আছে আম্পানে আক্রান্ত উপকূলের জনগণের গাদাগাদি করে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয়া, বাঁধের ওপর অনেক বেশি লোক এক জায়গায় অস্থায়ী ঘরে বসবাস করা, চলমান বন্যার কারণে একইভাবে অনেক পরিবারের বাঁধ ও রাস্তায় আশ্রয় নেয়া ইত্যাদি।এ সব কারণে লকডাউনের উদ্দেশ্য আরো ব্যাহত হয়েছে। সামনে কোরবানির পশু ক্রয়ের হাটের মাধ্যমে সংক্রমণের আশঙ্কা আছে। তবে এ পারিবারিক ও সামাজিক বুননের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। বিদ্যমান পরিবারিক ও সামাজিক এ বুননের কারণেই এখনো আমাদের দেশে অপরাধের সংখ্যা ও মাত্রা অনেক কম। এ দেশে প্রতি এক লক্ষ লোকের জন্য কারাবন্দীর সংখ্যা মাত্র ৪০ জন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭১৬ জন, রাশিয়ায় ৪৭৫ জন, সিঙ্গাপুরে ২৩০ জন, যুক্তরাজ্যে ১৪৮ জন, চীনে ১২১ জন এবং জাপানে ৫০ জন।

আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্র ছাড়া, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। যা চীনের চেয়ে প্রায় আট গুণ এবং ভারতের চেয়ে প্রায় ৩.৫ গুণ বেশি। দেশের হাসপাতালসমূহে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা মাত্র ৪০০, যার অধিকাংশ ঢাকা শহরে। দেশের ৬৪ জেলার মাত্র ২২টি জেলায় করোনা ভাইরাসের টেস্টের ব্যবস্থা আছে। অন্য সব জেলা (প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ) থেকে নমুনা সংগ্রহ, পরিবহন এবং টেস্ট শেষে রেজাল্ট জানাতে সঙ্গতকারণেই অনেক সময় ব্যয় হয়। নমুনা সংগ্রহ, পরিবহন ইত্যাদি কাজে সময় বেশি লাগার কারণে টেস্ট রেজাল্ট ত্রুটিমুক্ত না হতেও পারে। সে ক্ষেত্রে False Positive বা False Negative হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা না করানো বা ওষুধ না খাওয়ার প্রবণতা আছে। Ôno medication is also a medication'। এমনিতেই ভালো হয় অনেক রোগ। করোনা সংক্রমণের এ ক্রান্তিকালে মৃদু উপসর্গ থাকলেও প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসা না করা এবং বাড়ি লকডাউনসহ সামাজিক ও পারিপার্শিক কারণ বিবেচনায় অনেকেই সংক্রমণের প্রথম দিকে তা প্রকাশ করেন না। পরে প্রকাশ করলেও দূরবর্তী স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ ও টেস্ট রেজাল্ট পেতে বিলম্ব হয়। এ বিলম্বের কারণে ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে শ^াসকষ্ট শুরু হলে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার সুযোগ থাকে না।

কাজেই বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জনঘনত্ব, পারিবারিক, সামাজিক আচরণ ও সংস্কৃতি এসব বিবেচনায় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন ও অবলম্বন করা সমীচীন। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলেই সন্দেহজনক রোগীকে আলাদা রাখা এবং ivermectinI doxycycline/azithromycin-এর ওষুধ ব্যবহারের ব্যবস্থা করা এবং টেস্ট করার পদ্ধতি অবলম্বন করা যৌক্তিক। এতে যেমন মৃদু উপসর্গ থেকে তীব্র আকারে রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমবে, তেমনি আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক রোগ ছড়ানোর ঘটনাও কমে যাবে। দেশের কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতাল, বাংলাদেশ পুলিশ হাসপাতালসমূহ এবং অন্যান্য হাসপাতালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রোগের প্রাথমিক উপসর্গকালে ivermectinI doxycycline/azithromycin-এর ডোজ নির্ধারণ করা যেতে পারে।

বিষয়টি জাতীয় গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত করার এবং সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরসহ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি দ্বারা নির্ধারিত ডোজের এ ওষুধ তৈরি এবং ফার্মেসি ও হাসপাতালে এর সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। গাইডলাইনের শেষ পৃষ্ঠায় ‘হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগের ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক নির্দেশনায় উলেøখ করা হয়েছে ‘মৃদু উপসর্গ বিশিষ্ট কোভিড-১৯ রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। জ¦রের বা অন্যান্য উপসর্গের সাধারণ চিকিৎসা করুন’। যেহেতু মৃদু থেকে তীব্র মাত্রার আক্রমণে এ ভাইরাস বেশি সময় দেয় না, কাজেই এ বিষয়টিও বিবেচনা করার সময় এসেছে। কারণ জাতীয় গাইডলাইনে নেই, অপরদিকে জনগণ ব্যাপকভাবে এ ওষুধ ক্রয় করছেন ও ব্যবহার করছেন। সরকারি পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে তথা জাতীয় গাইডলাইনের নির্দেশনার সাথে জনগণের ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এভাবে একটা দৃশ্যমান ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। যা একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। এতে ওষুধের অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকছে। কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি এবং সংক্রমণের ক্ষমতা সম্পর্কে নিত্যনতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠান Centre for Disease Control and Prevention (CDC) সহ বিশ্বের নামকরা সব জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে প্রাপ্ত নতুন নতুন তথ্যের ভিত্তিতে নিয়মিত দিকনির্দেশনা আপডেট করছে। আমাদের জাতীয় গাইডলাইনও সেভাবে আপডেট করা জরুরি।

লেখক : চেয়ারম্যান, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক (সাবেক সচিব)


আরো সংবাদ



premium cement