২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনার খাদ থেকে কিভাবে উঠবে গণমাধ্যম

করোনার খাদ থেকে কিভাবে উঠবে গণমাধ্যম - ছবি : সংগৃহীত

কিনারে নয়, করোনা একেবারে খাদেই ফেলেছে দেশের গণমাধ্যমকে। জীবনের সাথে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছে সংবাদকর্মীদের। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইনসহ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এমন কঠিন সময়ে আর পড়েনি। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকার মূলধারার ৮-৯টি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশনা। আরো কয়েকটি বন্ধের পথে। কয়েকটি পত্রিকা প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।

প্রকাশ হতে থাকা পত্রিকাগুলোর বিক্রিও তলানিতে ঠেকেছে। পত্রিকার মাধ্যমে করোনা ছড়ায় এমন অহেতুক ভীতি পত্রিকার সার্কুলেশনে কিছুটা হলেও আঘাত হেনেছে। বিনোদনভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নতুন কোনো অনুষ্ঠান তৈরি করতে পারছে না। তারাও আক্রান্ত। নিউজ চ্যানেলগুলো নিয়মিত খবর সরবরাহ করছে। কিন্তু নিয়মিত কার্যক্রম ও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান সচল না থাকায় তারাও সাবান আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছাড়া কোনো বিজ্ঞাপন পাচ্ছে না।

করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মালিকসহ সংবাদকর্মীদের অনেকে। মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন। টেলিভিশনগুলোর অবস্থাও করুণ। সার্কুলেশনের সাথে সংবাদপত্রের মার্কেটিং ভেঙে পড়েছে। টেলিভিশনগুলোরও তাই। বিজ্ঞাপনই সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের আয়ের বড় উৎস। বিজ্ঞাপন ও আয়ের পথ হারিয়ে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমগুলো আজ গভীর সঙ্কটে পড়েছে। এমন করুণ পরিস্থিতি গণমাধ্যমের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এ মাধ্যমের কর্মীরা কিভাবে চলছে তা অনেকেরই অজানা। 

বেশির ভাগ টেলিভিশনে বেতনভাতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাদি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। ছাঁটাই তো আছেই। ছাঁটাইয়ের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্মীদের চলতি ও বকেয়া পাওনার সুরাহা করা হয়নি। রাজধানীর বাইরেও শত শত সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ প্রায়। এক তথ্যে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতিতে ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগীয় শহর ও সংশ্লিষ্ট জেলায় ৮৬টি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর-ডিএফপির হিসেবে, এই আটটি বিভাগীয় শহর ও সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা ৩৪০টি পত্রিকা। সেই হিসাবে ২৫৪টি পত্রিকাই বন্ধ। গত মার্চে করোনা পরিস্থিতি শুরুর আগে ঢাকায় সংবাদপত্রের এজেন্ট ও হকারদের হাতে যেত ৫৫টি পত্রিকা। বাকি প্রায় ২০০ পত্রিকার নাম ডিএফপির মিডিয়া তালিকায় থাকলেও সেগুলো বিক্রি হতো না। বছরের পর বছর এগুলো দেয়াল বা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা নামে পরিচিত। সেগুলোর বেশির ভাগ এখন বন্ধ বলা চলে। 

জীবনের ঝুঁঁকি ও বিড়ম্বনা নিয়ে তথ্য সরবরাহের দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন চাকরিরতরা। ভালো বেতন পাওয়া সংবাদকর্মীর সংখ্যা কম। সীমিত বেতনভাতা দিয়ে অনেক সাংবাদিক পরিবার পরিজন নিয়ে টানাপড়েনে দিন পার করেন। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে বেশ ধকল সইতে হচ্ছে তাদের। সাংবাদিকদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে মূল দায়িত্বে নিবেদিত থাকার বাইরেও একটু সচ্ছলতার আশায় টুকটাক নানা কাজে সম্পৃক্ত থাকেন। বর্তমানে তাও বন্ধ। করোনা পরিস্থিতি অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সাংবাদিকদেরও সীমাহীন দুর্দশা ও বিড়ম্বনা দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। সংবাদপত্র শিল্পে দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা। তার ওপর এইদুর্যোগেও কারণে-অকারণে মামলা, আটক, হয়রানির শিকার সাংবাদিকরা।

বিজ্ঞাপনের প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বকেয়া বিলের প্রাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে চলমান রাখায় সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, কর্মীদেরও সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। সরকারি বিজ্ঞাপনও ‘নাই’ হওয়ার দশায়। যেখানে পত্রিকাগুলো সরকারের কাছে ১৫০ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে, সেখানে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরকে মাত্র ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সরকারের সব সেক্টরে মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাবদ হাজার কোটি টাকা বকেয়ার অর্ধেক পরিশোধ করলেও গণমাধ্যমের জন্য সহায়ক হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদের আগে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের ডেকে মিডিয়ার বকেয়া বিজ্ঞাপন পরিশোধের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেয়া হয়েছে। শুধু তথ্য মন্ত্রণালয় ছাড়া কেউই সাড়া দেয়নি। করোনা সঙ্কটে বিভিন্ন খাত প্রণোদনা, সহায়তা বা ছাড় পেলেও সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম কিছুই পায়নি। পাওয়ার ভরসাও নেই।

নানা মহল থেকে কিছু পরামর্শ এলেও ভরসা উঁকি দিচ্ছে না। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে কর্মরতদের দিকে রাষ্ট্রীয় মহল থেকে মানবিক হওয়ার লক্ষণ এখনো নেই। এখন পর্যন্ত ঘোষিত প্রণোদনাগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ নেই। এ বছরের জাতীয় বাজেটে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের একটি দাবিও মেনে নেয়া হয়নি। চলমান এ সঙ্কটের সহজ কোনো সমাধান নেই। সংবাদপত্র অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল শিল্প। অর্থনীতি সচল হলে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হলে সংবাদপত্রশিল্প হয়তো ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে। তবে এটি কবে হবে, এ মুহূর্তে তা কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এই সঙ্কটে সরকার গণমাধ্যমের জন্য কিছু করবেÑ তা আশা করার অবস্থাও নেই। সরকারের কাছ থেকে বড় কোনো সহযোগিতা মিলবে না, এটি ধরে নিয়েই টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। প্রশ্ন হলো, সেই সক্ষমতা ক’জনের আছে?

বকেয়া বিল পরিশোধ করা, ঋণ দেয়া, বিভিন্ন কর বা নিউজপ্রিন্টের শুল্ক কমানোসহ পরোক্ষ যেসব সহায়তা সরকার করতে পারত, সেগুলো আলোচনার টেবিলেই ঘুরছে। এর মধ্যেই ব্যাংকের বিজ্ঞাপন বন্ধের ঘোষণাও এসেছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ওষুধশিল্পের বিজ্ঞাপন থাকলেও নেই বাংলাদেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে সংবাদপত্রশিল্প রক্ষায় নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-নোয়াবের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঁচ দফা প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সেগুলো হলোÑ সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাদ দেয়া, বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎস কর (টিডিএস) ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা, উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের বদলে অগ্রিম কর (এআইটি) শূন্য শতাংশ করা এবং কর্মীর আয়কর থেকে প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্ত করা ও তার বাড়ি ভাড়ার পুরোটাই করমুক্ত করা। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এসব দাবির ব্যাপারে কোনো সুখবর পাওয়া যায়নি।

বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে ছাপা সংবাদপত্র এমনিতেই রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। আর করোনাভাইরাসের মহামারী সংবাদপত্রশিল্পের জন্য আরো ভয়াবহতা ডেকে এনেছে। পত্রিকাগুলোর মাসিক বেতন ব্যয়, অফিস ভাড়া, ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পত্রিকা পরিবহন ব্যয়সহ অন্য সব ব্যয় অপরিবর্তিত রয়েছে। মহামারী ও দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে তথ্যপ্রবাহ জরুরি। তাই সমাজের স্বার্থে, গণমানুষের স্বার্থেই গণমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ সময়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে গণমাধ্যমকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলা কোনোভাবেই উচিত নয়। তথ্যে ঘাটতি-কমতি হলে গুজব বাড়বে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছেÑ গণমাধ্যমের এ দুর্দিনে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মানুষের মুখে ঘুরতে থাকা অসংখ্য ‘ভুল বার্তা’ সমাজে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমই রাখছে। সংবাদপত্রে মুদ্রিত অক্ষর বা টিভিতে প্রচারিত তথ্যে মানুষের নির্ভরতা বেশি। বিশ্বাসযোগ্যতায় পাঠক-দর্শকের মনে স্থান করে নেয়া গণমাধ্যমই সরকার ও জনগণকে গুজব থেকে মুক্ত করছে। অথচ সেই গণমাধ্যমই এখন খাদে পড়ে গেছে। সংবাদপত্র বিক্রি কমে যাওয়ার জের পড়েছে হকারদের ওপর। ঢাকার সাত হাজার হকারের মধ্যে বর্তমানে বড়জোর ১৭-১৮ শ’ জন টিকে রয়েছেন। যে হকার একসময় প্রতিদিন তিন শ’ থেকে পাঁচ শ’ পত্রিকা বিক্রি করতেন, তিনি এখন ৫০ থেকে ৬০টির বেশি বিক্রি করতে পারছেন না। 

লেখক : গবেষক ও আইনজীবী


আরো সংবাদ



premium cement