২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি

বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি - সংগৃহীত

অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষ চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে। আধুনিক বিশ্বে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অর্থ একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তাই অর্থের প্রয়োজন অনেক। তবে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে এমন কিছু নৈতিক বিধিনিষেধ আছে, যা মানব হিতার্থে মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। বাজারের ক্ষেত্রে এ বিধিনিষেধগুলো মেনে চলা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই অপরিহার্য ও কল্যাণকর। বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার আচরণে এসব নৈতিক নিয়মকানুনের ব্যত্যয় ঘটলে উভয়েই ইহকালে তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই, পরকালেও হবে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ‘মহান আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন’। (সূরা বাকারা : আয়াত-২৭৫) আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ আত্মসাৎ করো না। তবে পরস্পরের সম্মতিতে ব্যবসা বা বাণিজ্য করা বৈধ।’ (সূরা নিসা : আয়াত-২৯) হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘মহান আল্লাহ এমন সহনশীল ব্যক্তির প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, যে ক্রয়-বিক্রয় ও নিজের অধিকার আদায়ের সময় নম্রতা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে’ (বুখারি-৮/৯৭৬)। একটি হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘মানুষের জন্য এমন একসময় আসবে, যখন সে তার উপার্জনকৃত মাল হালাল না হারাম পন্থায় উপার্জন করল, তা যাচাই করার কোনো প্রয়োজন বোধ করবে না’ (বুখারি-৩/৯৭১)। মোটা দাগে এসব নিয়মকানুন বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশের ক্রেতা-বিক্রেতারা মেনে চলবেন, সেটিই কাম্য। বাস্তবে আমরা তা দেখি না; বরং বুখারি শরিফের উপরোক্ত ৩/৯৭১ হাদিসটির কার্যকারিতাই লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশের বর্তমান বাজারব্যবস্থা স্থিতিশীল নয় এবং এর গতিবিধি এমন যে, এতে ক্রেতা ও উৎপাদক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। লাভবান হন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। যেমন কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না এবং ভোক্তাদের বাড়তি দামে পণ্য ক্রয় করতে হয়। মধ্যস্বত্ব¡ভোগীরা বিরাট অঙ্কের মুনাফা ভোগ করেন। ব্যবসায়ে প্রতারণা, আত্মসাৎ, ক্ষতি ও পাপাচার উদ্দেশ্য হতে পারে না। হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘উত্তম উপার্জন হচ্ছে যা কল্যাণকর বেচাকেনা (বা-এ মাররুর) এবং নিজ হাতের উপার্জন (মিশকাত পৃষ্ঠা ২৪২)। ‘মাররুর’ বেচাকেনা হচ্ছে, ‘যাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও কল্যাণ নিহিত থাকে। তাতে প্রতারণা, আত্মসাৎ ও আল্লাহর নাফরমানি থাকবে না। তদুপরি হাদিস অনুসারে (নিজে) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা উচিত নয় (অবৈধ)’ (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ২০০০। ইসলামে পণ্য বেচাকেনার সাথে ভেজাল না মেশানোর সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। যেসব লেনদেনে ধোঁকা ও প্রতারণা আছে, এ-জাতীয় লেনদেন অবৈধ। পণ্যের সাথে পাথরের টুকরা বা অন্য কোনো প্রকার ভেজাল মেশানো হারাম। আমরা লক্ষ্য করি, বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং ভেজালবিরোধী, নিষ্ফল তদারকি করা হয়। বিক্রেতারা পণ্য বিক্রয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নৈতিক নিয়মকানুন মেনে চলেন না। এর প্রধান কারণ অনেক ক্ষেত্রে বিক্রেতারা ধার্মিকের পরিচয় দিলেও বাস্তবে তাদের মধ্যে ইসলামী বিধানের অনুসূতি নেই।

বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের দিক থেকে লেনদেনে ধর্মীয় বিধান অমান্য করার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মচর্চাকে উৎসাহিত করা হয় না। ব্যবসায়ীরা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মীয় বিধান মান্য না করেন, নিছক পুলিশি তদারকির মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে সদাচার আশা করা যায় না। এ সত্য বাংলাদেশে আমরা প্রতিনিয়তই দেখে আসছি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে- বৈধ পন্থা ও সততা অবলম্বন করা অপরিহার্য। এটি যারা করবে না তাদের জন্য ভয়াবহ পরিণামের কথা হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদের পাপী হিসেবে ওঠানো হবে। অবশ্য যারা পরহেজগারি, ন্যায়নিষ্ঠা ও সততার সাথে ব্যবসা করেছে তাদের কথা ভিন্ন’ (মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪৪)। পক্ষান্তরে, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী সা:, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথী হবেন।’ (মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪৩)। ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে এসব সতর্কতা ও পুরস্কারের বাণী কেবল সেসব ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা যথার্থ ধার্মিক এবং পরকালে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যদি সত্যিকার অর্থে তাই হতেন তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকির প্রয়োজন হতো না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব বাহিনীর আচরণও নিষ্কলুষ নয়। কারণ তারাও ঘুষ খান- যদিও ঘুষ খাওয়া ধর্মে নিষিদ্ধ; যে কারণে মুনাফাখোরি, ভেজাল মিশ্রণকারী ও চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর একটাই উপায়; তা হলো- রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের ধর্মাচারে উদ্বুদ্ধ করা এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরও ধর্মীয় বিধান মেনে চলা। নইলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণের আর কোনো উপায় নেই।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মুনাফা অর্জন ও সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা লেনদেনে উভয় পক্ষের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতির তোয়াক্কা করেন না, বরং জবরদস্তিমূলক সম্মতিকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ সম্মতি বলে ধরে নেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, সুদের ব্যবসা কিংবা শ্রমিককে তার শ্রমের তুলনায় কম মজুরি দেয়া বা মজুরি না দেয়া। এরূপ ব্যবসায়িক লেনদেন অবৈধ। প্রায়ই দেখা যায়, ফসলের ভরা মৌসুমে দরিদ্র কৃষক যখন তার পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অসহায়, তখন মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কম দামে ক্ষেতের ফসল কিনে নেন। এরূপ ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান হলো এ ধরনের নিরুপায় ব্যক্তির কাছ থেকে পণ্য অন্যায্য মূল্যে ক্রয় না করা। অর্থাৎ বিক্রেতার অনন্যোপায় অবস্থা থেকে অবৈধ ফায়দা গ্রহণ করা নাজায়িজ। (মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪৮)। যদি কেউ কিনেন তাকে ন্যায্য দাম দিয়ে কিনতে হবে। এটি সচরাচর আমাদের দেশে দেখা যায় না, যদিও ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে জবরদস্তি সম্মতিকে অবৈধ বলে গণ্য করা হয়েছে।

ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়পক্ষের মাঝে পণ্য বিক্রয়ের চুক্তি হওয়ার পরও যেসব লেনদেনে কলহ-বিবাদের আশঙ্কা থাকে অথবা যেসব ব্যবসায়িক লেনদেনে কোনো একপক্ষের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, সেগুলো অবৈধ। যেমন, ব্যবসায়িক লেনদেনে পণ্য কিংবা মূল্য অথবা উভয়টিই অমীমাংসিত বা অস্পষ্ট রাখা। অথবা কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্যের লেনদেনকে দুই রকম লেনদেনে পরিণত করা। যেমন বলা হলো, যদি কোনো পণ্য নগদ টাকায় ক্রয় করা হয় তবে পণ্যটির মূল্য ২০০ টাকা আর বাকিতে কিনলে ৩০০ টাকা। কিংবা বেচাকেনার ক্ষেত্রে যদি এমন শর্ত আরোপ করা হয় যা সেই লেনদেনের অংশ নয়। এ জাতীয় লেনদেন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের মধ্যে সহযোগিতার বদলে কলহ-বিবাদের সৃষ্টি করে। এ লেনদেন ধর্মমতে নিষিদ্ধ। রাসূল সা: এক বেচাকেনাকে দুই বেচাকেনায় রূপান্তরিত করতে বারণ করেছেন (মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪৮)। উপরন্তু পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শর্তারোপ করাও নিষিদ্ধ (নাসায়ি ও তিরমিজি)। ‘যে পণ্য বিক্রেতার কাছে নেই তেমন পণ্য বিক্রয় করাও অবৈধ’ (তিরমিজি)। এ ছাড়াও কোনো বস্তু ছুঁয়ে অথবা ছুড়ে দিয়ে বেচাকেনা করাও নিষেধ (মিশকাত, পৃষ্ঠা-২৪৭)। ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে জালিয়াতি ও ফটকাবাজারি করাও অবৈধ (বুখারি)। এ-জাতীয় লেনদেনের ক্ষেত্রে যেহেতু জুয়া অথবা ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যেকোনো একপক্ষের লোকসান হওয়া বা তাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সম্ভাবনা থেকে যায়, সে কারণে এরূপ বেচাকেনা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উপরন্তু একটি বুখারি হাদিসে বর্ণিত আছে- শহরাঞ্চলের লোকেদের মধ্যে চড়ামূল্যে বিক্রয়ের জন্য গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করা শরিয়তে নিষিদ্ধ। এ লেনদেনের মূল লক্ষ্য হলো মুনাফাখোরি। সে কারণে এ প্রকারের লেনদেন ইসলামে নিষিদ্ধ।

ইসলামী বিধান মতে, বেচাকেনার মূল নীতি হলো- পণ্য লেনদেনে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মধ্যেই যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উভয়পক্ষের কেউ যেন প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারনীতি সেরূপ না হয়ে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী পন্থায় পরিচালিত হচ্ছে বলে তা কোনো প্রকারেই নিয়মানুগ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এতে মানুষের স্বভাব অপরিচ্ছন্ন থেকে যায়। অপরিচ্ছন্ন স্বভাবের ব্যবসায়ীরা পরিচ্ছন্ন ব্যবসা করবেন, তা কল্পনাও করা যায় না। একমাত্র ধর্মাচারই পারে মানুষের স্বভাবকে পরিচ্ছন্ন করতে এবং তাদের যাবতীয় জাগতিক কর্মকাণ্ডে পরিচ্ছন্ন ও ন্যায়ানুগ রাখতে। এর ঘাটতি বাংলাদেশের ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রয়েছে। এ রীতির ধর্মানুগ পরিবর্তন না হলে দেশের বাজার ব্যবস্থাসহ মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড যেমন চলছে তেমনি নীতিবিবর্জিতভাবে চলতেই থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নজরদারি করে এর সংশোধন করা যাবে না এবং যাচ্ছেও না। 

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা


আরো সংবাদ



premium cement