১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছোঁয়াচে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কার কী করণীয়?

- সংগৃহীত

‘মহামারী আল্লাহর আজাব’- হজরত আয়েশা রা:। ‘মহামারী পীড়িত গ্রাম বা শহরে প্রবেশ নিষেধ। পক্ষান্তরে কেউ যদি পূর্বে আক্রান্ত জায়গায় থাকে, তাহলে সেখান থেকে পলায়ন করা নিষিদ্ধ। মহামারী আক্রান্ত এলাকা থেকে পলায়ন জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নতুল্য অপরাধ’।
- বুখারি ৩৪৭৩, ৫৭২৮।

ছোঁয়াচে রোগের সূচনা
আফ্রিকার মুর মুসলমানরা তারিক বিন জিয়াদের সেনাপতিত্বে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে জিব্রাল্টার বিজয় করে ক্রমে ৭২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পুরো স্পেন ও পর্তুগালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা এবং কর্ডোভায় রাজধানী স্থাপন করেছিল। বর্তমানের বহুলপ্রশংসিত কর্ডোভা ক্যাথেড্রাল ৭০০ বছর (৮০০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ) ধরে পরিচিত ছিল আকর্ষণীয় মসজিদ রূপে, যা স্থাপন করেছিলেন মুসলিম মুর শাসকরা। ১৫ শতাব্দীতে মুসলিম শাসনের পতন হলে স্পেনিয়ার্ডরা কর্ডোভা মসজিদের নতুন নামকরণ করে ক্যাথেড্রাল নামে। কর্ডোভা ক্যাথেড্রালের স্পেনীয় নাম হচ্ছে খধ Megquita- মানে, দ্য মস্ক- মসজিদ।

মুসলমানদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধাবিভক্তির কারণে ১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। একই বছর কলম্বাস নতুন মহাদেশ আমেরিকা খুঁজে পান এবং সেখান দিয়ে আসে ইউরোপের রোগ হাম, বসন্ত ও যৌন রোগ গনোরিয়া। সাথে নিয়ে আসে বিস্তর স্বর্ণখণ্ড ও ছোঁয়াচে যৌন রোগ সিফিলিস। সিফিলিস রোগের জীবাণুর নাম ট্রেপোনোমা প্যালিডিয়াম। কলম্বাসের নাবিকদের অবাধ যৌন বিহারের মাধ্যমে সিফিলিস পুরো আন্দালুসিয়া, পর্তুগাল ও ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৯৬-তে ছড়িয়ে পড়ে ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডে। ফ্রান্সের সম্রাট অষ্টম চার্লস বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বিরাট ভাড়াটে সেনাদল নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর ১৪৯৫ সালে ইতালিতে প্রবেশ করেন। পথিমধ্যে ব্যাপক যৌন আমোদে অংশ নিয়ে নেপলস পৌঁছেন ১২ মে ১৪৯৫-তে। প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন জুলাই মাসে, সাথে নিয়ে আসেন ‘রেনেসাঁ জীবাণু’, যা ফ্রান্সে পরিচিতি লাভ করে ‘নেপোলিয়ান ব্যামো’ বা ফরাসি ব্যামো নামে, যার দ্রুত বিস্তৃতি ঘটেছিল জার্মানি ও উত্তর-পূর্ব ইউরোপে।

ভাসকো ডি গামা ৮ জুলাই ১৪৯৭ তারিখে বিরাট নৌবহর নিয়ে লিসবন ছাড়েন এবং ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে কালিকটে তরী ভেড়ান ১৭ মে ১৪৯৮-তে। তার নাবিকরা ভারতীয় নারীদের মধ্যে প্রসার ঘটায় ফিরিঙ্গি রোগ নামে খ্যাত সিফিলিসের। এ রোগ ১৫১০ থেকে ২০ সালের মধ্যে আফ্রিকা, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, জাপান ও চীনে ছড়িয়ে পড়ে। চীনে সিফিলিসের পরিচিতি ছিল ‘চৈনিক ঘা’ নামে। ১৯৪৬ সালে অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন বাজারজাত না হওয়া পর্যন্ত যৌনাচারে সংক্রমিত সিফিলিস রোগ সারা পৃথিবীকে ৬০০ বছর ধরে পর্যুদস্ত করে রেখেছিল; অনেকটা আজকের ছোঁয়াচে রোগ করোনা সংক্রমণের ধারায়।

১৯২৮ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরিতে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, হাওয়ার্ড ফ্লোরি, আর্নেস্ট বরিস চেন ও নরমান হিটলির সম্মিলিত গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয়। যে কয়েকটি পাত্রে প্রথম পেনিসিলিন উৎপাদন করা হয়েছিল, তার একটি পাত্র বিজ্ঞানী নরমান হিটলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে উপহার দেন ১৯৮০ সালে, যা সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে রক্ষিত আছে।

পেনিসিলিন প্রথম ব্যবহৃত হয় লন্ডনের পুলিশ আলবার্ট আলেকজান্ডারের প্রদাহ নিবৃত্তির জন্য ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ তারিখে। পেনিসিলিনের ব্যাপক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাবট, লিডারলি, ফাইজার, মার্ক ও স্কুইবের ভূমিকা স্মরণযোগ্য।

ভয়ানক ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস
ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রাক্কালে ’৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র কলেরা জীবাণুর মাধ্যমে জীবাণু যুদ্ধের বিস্তারের জন্য ব্যাপক গবেষণা করেছিল ঢাকার মহাখালীর সিয়াটো কলেরা ল্যাবরেটরিতে, যা বর্তমানে ‘আইসিডিডিআর,বি’ (ICDDR,B) নামে বিশ্বখ্যাত।

এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে সার্স করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2) সংক্রান্ত গবেষণা চলছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের উহানের গবেষণাগারে। জনশ্রুতি আছে, জীবাণু যুদ্ধে ভাইরাস ব্যবহারের উপযোগিতা পরীক্ষা ছিল মূল লক্ষ্য। কথিত আছে, চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ হুবেইর রাজধানী উহানে প্রাণিবাজার থেকে করোনাভাইরাস নভেম্বর ২০১৯ সালে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। সার্স ভাইরাস ৩৮৪ বার পরিবর্তিত হয়ে করোনা নভেল রোগরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগকে কোভিড-১৯ নামকরণ করে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে এবং কোভিড-১৯ কে মহামারী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় ১১ মার্চ ২০২০ তারিখে।

কোভিড-১৯ অন্যান্য ভাইরাস থেকে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ভয়ানক ছোঁয়াচে, মানুষ থেকে মানুষে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ প্রবাসী নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন, বিনোদন বা পরিজনের সাথে সময় যাপনের নিমিত্তে আগমন। কোভিড-১৯ এর উপসর্গগুলো হচ্ছে জ্বর, কাশি, হাঁচি, মাংসপেশির ব্যথা, গলাদাহ যা দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ফুসফুসের সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রুত চিকিৎসা করা না হলে নরম ফুসফুস পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়।

১৯ মার্চ ২০২০ সাল অবধি আট হাজারের অধিক কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে ১৭০টি দেশে এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। সবচেয়ে বেশি রোগী চীন, কোরিয়া, ইরান, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সে। বাংলাদেশে প্রমাণিত কোভিড-১৯ রোগী ২৪ জন এবং দু’জন মারা গেছে। বাংলাদেশে এ রোগ আক্রান্তদের সংখ্যা যে লাফিয়ে বেড়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। তাই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

১. বাংলাদেশ কোভিড-১৯ এর প্রবেশদ্বার
ক. ভারত সীমান্ত- ভারতের সাথে বাংলাদেশের দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটারের অধিক সীমান্ত রয়েছে, কয়েক শ’ পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা যায়। তদুপরি রয়েছে প্রতিদিন কয়েক শ’ ভারতীয় ট্রাকের বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট ব্যবহার। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নিয়মিত কর্মে লিপ্ত। অনুমোদনবিহীন ভারতীয় নাগরিকের বাংলাদেশে অবস্থানের ব্যাপারে সঠিক তথ্য নেই। প্রতিদিন কয়েক হাজার ভারতীয় স্থলপথে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং প্রত্যাবর্তন করে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা সমধিক। বাংলাদেশ থেকেও প্রতিদিন কয়েক হাজার বাংলাদেশী চিকিৎসা, বিনোদন ও হুন্ডি ব্যবসার নিমিত্তে ভারতে আসা-যাওয়া করে। এ যাতায়াত বন্ধের জন্য সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল সকল স্কুল, কলেজ বন্ধ ঘোষণাই যথেষ্ট নয়।

খ. কারাগার থেকে কোভিড-১৯ অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সব কারাগারের মিলিত বন্দী ধারণক্ষমতা ৪০ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানি, পুলিশের ঘুষবাণিজ্য ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে কারাবন্দী আছে প্রায় ৯০ হাজার ব্যক্তি। কারাগারের জনাকীর্ণতা কোভিড-১৯ এর জন্য উন্মুক্ত দ্বার সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিকার হিসেবে সরকারের উচিত ফাঁসির আসামি, যাবজ্জীবন ও ১০ বছরের অধিক দণ্ডপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য সব দণ্ডপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দেয়া এবং বুঝিয়ে বলা, পরিবারের বাইরে যেন তারা বিচরণ না করে।

গ. আদালত প্রাঙ্গণ ও কোর্টসমূহ
সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ ও উকিল-মুহুরি এবং অন্যান্য কর্মচারী আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত ভয়ানক ভিড় করে থাকে। একে অপরের গায়ে প্রায় লেগে থাকে। আদালতে এত মামলার মূল কারণ রাজনৈতিক হয়রানি ও পুলিশের অনৈতিক ঘুষবাণিজ্য।
বিশ্ব কোভিড-১৯ এর ছোঁয়াচে সংক্রমণ বিবেচনায় নিয়ে উচিত হবে ৭০ ভাগ অভিযুক্তকে ২০৫ ধারায় কোর্টে উপস্থিতি থেকে রেহাই দেয়া যত দিন না মামলার চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। দ্বিতীয়ত, অন্যদের ক্ষেত্রে সকল মামলার শুনানি ও উপস্থিতির জন্য তিন মাস অন্তর তারিখ দেয়া।

ঘ. রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বাড়ানো প্রয়োজন
রোহিঙ্গা ক্যাম্প অত্যন্ত জনাকীর্ণ এবং সেখানে সাধারণ জীবনযাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, একইভাবে স্থানীয় জনসাধারণের ক্যাম্পে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

২. মসজিদ, মন্দির, গির্জা প্যাগোডা খোলা থাকবে, তবে
উপাসনালয়ের প্রবেশপথে ভক্তদের ছয় থেকে ১০ ইঞ্চি দূর থেকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয় করা উপযুক্ত কাজ হবে। মসজিদে খুতবায় কোভিড-১৯ সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে, গুজব না ছড়িয়ে বা গুজবে কান না দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের বিদেশ প্রত্যাগত আত্মীয়স্বজনকে ১৪ দিন আলাদা রাখার পরামর্শ দিতে হবে। বাড়ির সবাইকে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া এবং কনুই পর্যন্ত ধুয়ে অজু করার পদ্ধতি অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। হাত মেলানো ও আলিঙ্গন পরিহার করতে হবে, না ছুঁয়ে সালাম দেয়ার অভ্যাস করতে হবে। হ্যান্ডশেক নয়, সালাম দিন বা নমস্কার করুন। মন্দির, গির্জা প্রভৃতি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এই সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে হবে।

৩. বাস-ট্রেন স্টেশন, বন্দর, বাজার ও লঞ্চঘাটে যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিন হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে। বাড়িতে ফিরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া এবং আলিঙ্গন ও হ্যান্ডসেকের পরিবর্তে হাত তুলে সালাম বা নমস্কার দেয়ার অভ্যাস করুন।

৪. বিদেশ থেকে প্রত্যাগত নাগরিকদের প্রতি সদয় ব্যবহার
প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জোগানদার। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ২৫ লাখ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ওষুধবিদ, আইটি পেশাজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করেন। এরা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বিদেশে রাখেন। দেশে পাঠান না। বাকি প্রায় ৭৫ লাখ সাধারণ শ্রমজীবী প্রবাসী বাংলাদেশী ১০ মাসে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। প্রায় ১০০টি দেশে বাংলাদেশীরা কঠিন শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তিন-চার বছর পরপর তারা স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, পরিজন ও আত্মীয়দের দেখার জন্য দেশে ফেরে ১০ থেকে ৪০ ঘণ্টা বিমান ভ্রমণ করে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের নিমিত্তে বিমানবন্দরে পৌঁছার পর তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা বিজ্ঞানসম্মত। তারা যদিও নবাবজাদার অভ্যর্থনা প্রত্যাশা করেন না তবে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হলো, তাদেরকে ১৪ দিন আহার ও বিশ্রামের জন্য পাঁচ তারকা তুল্য অভ্যর্থনা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া। দীর্ঘ দিন পরে যারা আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরে যাচ্ছেন, তাদের আইসোলেশনের বৈজ্ঞানিক কারণ ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া, যাতে বাড়ির বাইরে ১৪ দিন ঘোরাফেরা না করেন। তাদের জরিমানা করা অমানবিক ও ভুল কাজ।

৫. সরকারি ব্যবস্থাপনা অনেক বাড়াতে হবে
পৃথিবীর সব দেশ কঠিন সমস্যায় পতিত হয়েছে, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে দুর্বলতা হচ্ছে হাসপাতাল, ক্লিনিক নামক অজস্র ভবন আছে, কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত জনবল নেই ভুল নীতিমালার কারণে।

বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর- ‘Institute of Epidemiology, Disease Control and Research’ এ রিভার্স পলিমারজ চেইন রিঅ্যাকশন (rRT-PCR) পরিচালনায় দক্ষ ৫০ জন ভিরোলজিস্ট, এনটোমোলজিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট নেই। সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবরেটরিতে উন্নতমানের পিসিআর (PCR) নেই। তদুপরি বাংলাদেশে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির ওপর অদ্ভুত ধরনের অতিরিক্ত শুল্ক ও বিবিধ কর প্রয়োগের নিয়ম প্রযোজ্য হয়। মেডিক্যাল শয্যার ওপর সর্বমোট কর হচ্ছে ৫৮ শতাংশ, গ্যাস অ্যানালাইজার, ভেন্টিলেটর, থার্মোমিটার, অক্সিজেন সিলিন্ডারের ওপর ধার্যকৃত সর্বমোট শুল্ক হচ্ছে ৩১ শতাংশ। তদুপরি কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য অন্যান্য ‘উপরি ব্যয়’ তো আছেই।

সব মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট ও সামগ্রীর ওপর ০ শতাংশ বা জিরো ট্যাক্স আরোপ করা সরকারের আশুদায়িত্ব। সব প্রবেশপথে পর্যাপ্ত স্ক্যানার ছাড়াও কমপক্ষে ২০-৩০টা হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের ব্যবস্থা করা উচিত। তিন শিফটে কাজ চালু রাখার মতো স্বাস্থ্য কর্মীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভাণ্ডারে মাত্র এক হাজার ৭৩২ কোভিড-১৯ রোগজীবাণু পরীক্ষার কিট আছে। আইইডিসিআর কোভিড-১৯ শনাক্ত করার জন্য মাত্র ২৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। যেকোনো একটি উপসর্গ থাকলেই চিন্তিত রোগীর নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। প্রস্তুতি থাকতে হবে মাসে কয়েক লাখ সম্ভাব্য রোগীর নমুনা পরীক্ষার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তৃতির তথ্য।

সরকারকে অবিলম্বে আগামী এক মাসের মধ্যে এক লাখ চিকিৎসক ও দুই লাখ নার্স টেকনিশিয়ান প্যারামেডিক ও ফিজিওথেরাপিস্টদের কয়েক ঘণ্টা করে করোনা রোগের ধরন, উপসর্গ, বিস্তৃতি, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা, ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, আলিঙ্গন বা হ্যান্ডশেক না করে সালাম বা নমস্কার দেয়ার অভ্যাস করা এবং সম্ভাব্য রোগীকে দেখে চিকিৎসক ও নার্সদের ভয়ে পালিয়ে না যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। শেখাতে হবে যে, রোগীকে পরীক্ষা না করে পালানো, রাসূলুল্লাহ সা:-এর মতে জিহাদের মাঠ থেকে পলায়নতুল্য। চিকিৎসক ও নার্সদের ভালো করে হাত না ধোয়া সম্পর্কে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল কয়েক বছর আগে।

৬. দেশীয় বিজ্ঞানীদের সহায়তা করুন, সম্মান দিন
সরকারি সহযোগিতা পেলে গণস্বাস্থ্য এক মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ নির্ণায়ক গণস্বাস্থ্য র‌্যাপিড ডট ব্লট (G-Rapid Dot Blot) বাজারজাত করবে। ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুরে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস নির্ণায়ক- র‌্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবন দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান বিজ্ঞানী। ড. বিজন কুমার শীল ও তার তিনজন সহকারী ড. নিহাদ আদনান, ড. ফিরোজ আহমদ ও ড. বায়জিদ জমির উদ্দীন গণস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরিতে অ্যান্টিবডিএসেজ (ইমমিউনোগ্লোবিন-এ, ইমমিউনোগ্লোবিং-জি ও ইমমিউনোগ্লোবিং-এম ইমমিউনোএসেজ) পদ্ধতি ব্যবহার করে কোভিড-১৯ ভাইরাস নির্ণায়ক পদ্ধতি র‌্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবন করেছেন। সরকার দ্রুত বিভিন্ন করোনাভাইরাস অ্যান্টিবডি, নিউ ক্লোপ্রোটিন, স্পাইন গ্লাইকোপ্রোটিন, করোনাভাইরাস এনভেলাপ প্রোটিন প্রভৃতি ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহের অনুমতি দিলে বাজারজাতকরণের জন্য পর্যাপ্ত র‌্যাপিড ডট ব্লট প্রস্তুত করা হবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে। প্রতিটির উৎপাদন খরচ হবে ২০০ টাকা; সরকার শুল্ক, বিভিন্ন প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাট মওকুফ করে দিলে জনগণ মাত্র ৩০০ টাকায় পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে।

পিসিআর পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল র‌্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিচ্ছে এবং গণস্বাস্থ্যের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

শেষ কথা :
সঠিক তথ্য দিন, গুজব ছড়াবেন না, বাংলাদেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখুন। ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবাই সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন, হ্যান্ডশেক নয়, সালাম বা নমস্কার দিন। আল্লাহর আজাব থেকে নিশ্চয়ই সবাই মুক্তি পাবেন।

তথ্যসূত্র : হিস্টরি অব সিফিলিস অধ্যাপক ক্লড কুইটেল, প্যারিস ১৯৮৬।
সারস রোগ নির্ণয় পেটেন্ট, ড. বিজন কুমার শীল, ২০০৩।
করোনা রোগ ২০১৯ উইকিপিডিয়া/ সিডিসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র / বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।


আরো সংবাদ



premium cement