২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘যুদ্ধরত’ সুন্দরবন

-

সুন্দরবন মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ সৃষ্টি। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, যার আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ছয় হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার এবং ভারত অংশের আয়তন প্রায় তিন হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার। এ বনের গাছপালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, পশুর প্রভৃতি। পৃথিবীর প্রায় ৫০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের ৪০ প্রজাতিই রয়েছে এ বনে। আমাদের গবেষণা মতে, এ বনে রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০ প্রজাতির উভচর প্রাণী। এ বনের বিলুপ্ত প্রাণীরা হলো একশিঙ্গা গণ্ডার, বনমহিষ, মার্বেল বিড়াল, বারশিঙ্গা প্রভৃতি স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং বড় মদনটাক, বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, রাজশকুন প্রভৃতি পাখি। এখানে আরো প্রায় ৩০ প্রজাতির প্রাণী শঙ্কাগ্রস্ত।

সুন্দরবন এমন এক অদ্ভুত প্রকৃতির বন, যে বনের প্রায় পুরোটাই শ্বাসমূল দ্বারা আবৃত। ফলে সুন্দরবনের ভেতরে হেঁটে বিচরণ করা যেমন দুরূহ, তেমনি স্বল্পসংখ্যক বাঘ থাকলেও বাঘ আছে বিধায় এ বন একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়নি। উপরন্তু জালের মতো এ বনে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-বড় খাল। এ সবকিছু মিলে এ বন এক কঠিন রূপ ধারণ করেছে। এ কারণেই সুন্দরবন আজো টিকে আছে, বেঁচে আছে আমাদের দেশটি। না হলে বাংলাদেশে যে হারে পরিবেশ ও প্রতিবেশখেকোদের আধিক্য দেখা দিয়েছে, তাতে সুন্দরবন তথা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত অনেক আগেই। সুন্দরবন তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই এখনো এতটাই শক্তিশালী যে, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা প্রভৃতি থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

গত জানুয়ারির ২৬ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত সুন্দরবনের ভেতরে থেকে সুন্দরবনকে আরেকবার বিশ্লেষণ করার সুযোগ হয়েছে। বিভাগের অনারারি শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছি আরো একজন অনারারি শিক্ষক প্রফেসর ড. হামিদা খানমসহ মোট সাতজন শিক্ষক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ৬০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে সুন্দরবনে শিক্ষাসফরে গিয়েছিলাম। এই অল্প সময়ের মধ্যে সুন্দরবনকে যেটুকু বিশ্লেষণ করতে পেরেছি তারই কিছু উপাত্ত এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আমাদের পর্যবেক্ষণের স্পটগুলো ছিল হারবাড়িয়া ইকোপার্ক, হিরণ পয়েন্ট, দুবলারচর, কটকা ও করমজল। হারবাড়িয়া ইকোপার্কে কোনো এক জায়গায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেছে, লাল পতাকায় তার নির্দিষ্টকরণ ও সতর্কসঙ্কেত দেয়া রয়েছে। বেশ স্বস্তির সঞ্চার হলো। এ বনে বানরের সংখ্যাও অপ্রতুল নয়। সেটাও এক প্রশান্তি। হিরণ পয়েন্টের বেশ ভেতরে বড় একটি খালের ওপারে বেশ বড়সংখ্যক জংলি মোরগও আমাদের আশ্বস্ত করেছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সব স্পটেই হরিণের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। তাতে সন্দেহ নেই যে, হরিণ শিকার চলছেই। তবে দুবলারচরের শুঁটকি বাণিজ্য সুন্দরবনের জন্য অশনিসঙ্কেত। এখনই এ বিষয় ভাবতে হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সবচেয়ে বেশি দুরবস্থা করমজলের ব্যবস্থাপনায়। এখানে মানুষের আধিক্য বন্যপ্রাণীর জন্য যে শুধু দুশ্চিন্তার কারণ তা নয়, বরং এসব মানুষ আর বন্যপ্রাণী যেন একে অপরের শত্রু। বানরগুলো মানুষের গায়ে লাফিয়ে পড়ছে, আঁচড় কাটছে, মানুষও তাদের তাড়া করছে, খেতে দিচ্ছে, ঢিল ছুড়ছে। বানররা ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে আসছে। এসব দৃশ্য যেন অতি সাধারণ। কাউকেই যেন ভাবাচ্ছে না। অথচ বিষয়টি খুব ভয়াবহ নানা দিক থেকে। বানরদের বন্য জীবনব্যবস্থার জন্য এসব অত্যন্ত ক্ষতিকর। অভ্যাস পরিবর্তন হেতু বানরের স্বাস্থ্যগত ব্যাপার এতে জড়িত। এমনকি, মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যাপারটিও ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে কুমির ও কাছিমের ঈধঢ়ঃরাব নৎববফরহম চলছে, যেখানে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। এ বিষয়টি অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক ও গবেষণামূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়। করমজলের সার্বিক ব্যবস্থাপনার ত্রুটি-বিচ্যুতির অভাব নেই। এ দিকে নজর না দিলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহতা দেখা গেছে, বাজার সৃষ্টির কারণে এখানে চলছে সাংসারিক সরঞ্জামের কেনাকাটার মহোৎসব। এসব দেখার কি কেউ নেই?

হিরণ পয়েন্টে একটি পুকুরের দেখা মিলেছে। জানা গেল, এ রকম মোট আটটি পুকুর করা হয়েছে সুন্দরবন জুড়ে, যাতে বন্যপ্রাণী তথা বাঘ-হরিণ মিঠাপানির প্রয়োজন মেটাতে পারে। কিন্তু এসব পুকুরের পাড় খাড়া। এমতাবস্থায় হরিণের পক্ষে এ পুকুর থেকে পানি খাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া হরিণ শুধু পানিই খায় না, জলাধারে নেমে wallowing করে অর্থাৎ শিং দিয়ে কাদা তুলে তুলে গায়ে মেখে রোদে ঘোরাফেরা করে। কাদা শুকিয়ে গেলে আবার পানিতে নেমে গোসল করে। এভাবে এরা গায়ের ectoparasite ঝরিয়ে নেয়। এ জন্য জলাধারের পাড় অবশ্যই ঢালু করতে হয়। এ বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তা ছাড়া এসব পুকুরের পাশে মানুষের আনাগোনা ও বসার ব্যবস্থা রয়েছে, যা অবশ্যই বাঞ্ছনীয় নয়। ছোট-বড় খালগুলোতে ভোঁদরের আধিক্য আগে ছিল; তা এখন তেমন নেই বললেই চলে। পশুর ও শ্যালা নদীতে ডলফিনের সংখ্যা হ্রাস পাওয়াও চোখে পড়ার মতো।

সব জায়গাতেই সুন্দরবনকে মনে হলো ‘আপ্রাণ যুদ্ধরত’ অবস্থায় আছে। কোথাও তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। খাল-নদী পরিবেষ্টিত যে স্থলভাগগুলো রয়েছে তার ধার ঘেঁষে গাছপালা রয়েছে ভালোই। তবে এসব গাছের বেশির ভাগই নতুন গজানো অর্থাৎ সুন্দরবনের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সুন্দরবনজুড়েই গাছের আধিক্য, মেঘলা দিনে তো বটেই। সকাল-বিকেল যখন সূর্যের আলোর জোর কম তখনো সুন্দরবন দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মনে হবে, বনজুড়েই বুঝি গাছের প্রাচুর্য। আসলে তা নয়। প্রখর রোদ হলে, বিশেষ করে ভরদুপুরে সুন্দরবনের আসল রূপ চোখে ধরা পড়ে। অরণ্যের ভেতরটা একেবারেই ফোকলা। পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসকারীদের হাতে সুন্দরবন কিভাবে বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে না দেখলে বোঝা যাবে না। সমগ্র সুন্দরবনে বড় গাছের বড়ই অভাব। সুন্দরবনের regeneration নিজ থেকেই হয়ে থাকে, এ কথা আমরা সবাই জানি। ওর বুকে কোনো plantation চলে না। তাও জানা বিষয়। তবে জানি না, কত দিন সুন্দরবন তার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। সুন্দরবনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণী চোরাকারবারিরা প্রশাসনের পোষ্য। এদের যোগসাজশে ম্যানগ্রোভ বন যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমন বাঘ থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা চলছেই। এসব ব্যবসার সাথে চীন এবং এর মতো অন্য দেশগুলো প্রকারান্তরে জড়িত, যাদের এখনই রুখে দাঁড়ানোর সময়। চীন তাদের Traditional Chinese Medicine (TCM) তৈরিতে যত বন্যপ্রাণী ও তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে এবং ভবিষ্যৎ শত বছরের জন্য সংগ্রহ করে, তার হিসাব কি কেউ রাখে? এখনই এ ব্যবসা রুখে না দাঁড়ালে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশের দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি করতে হবে। কেননা সুন্দরবন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্য। প্রাকৃতিক পরিবেশ কোনো রাজনৈতিক সীমানা মানে না, জানে না।

আশা করি, সুন্দরবন তার অস্তিত্ব রক্ষার্থে যে নীরব যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, মানুষের কাছে আকুতি জানাচ্ছে তা মানুষ উপলব্ধি করবে, যদি সে মানুষ হয়ে থাকে। এমনিতেই সুন্দরবনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা নানা কারণে। বিশ্ব উষ্ণায়ন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে যাচ্ছে, সাথে বাড়ছে লবণাক্ততা; যার প্রভাবে এ বন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হিমশিম খাচ্ছে। আরো আছে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। উজানের নদীগুলোতে বাঁধ তথা ফারাক্কা বাঁধ এ বনের লবণাক্ততা অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা জ্যামিতিক হারে প্রতি বছর বাড়ছে তো বাড়ছেই। উপরন্তু প্লাস্টিক দূষণ সুন্দরবনের অস্তিত্বের প্রতি দৈত্যাকার হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা সুন্দরবনের ৎবমবহধৎধঃরড়হ জন্য সুন্দরবনই ব্যাপৃত। অর্থাৎ এটা প্রাকৃতিক। এখানে প্লাস্টিক বর্জ্য অবশ্যই বনের জিয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। খাল নদীর পানি ভরে যাচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যে বন্যপ্রাণীর পেটে প্লাস্টিক যাচ্ছে খাদ্যের সাথে। সব মিলিয়ে হ-য-ব-র-ল। দেখার কেউ নেই। উল্লেখ্য, আমাদের ৬০ জন ছাত্রছাত্রী অতি অল্প সময়ে যে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য বস্তায় বস্তায় ভরেছে তা দেখে আতঙ্কিত ও শঙ্কিত হবে সবাই। সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তথা সংস্থা কী করছে?

এত কিছুর পরও আশা করি, বিশ্ব-ঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রতি সমগ্র মানবজাতি তথা দেশ ও বিশ্বের সব সংস্থা সদয় হবে এবং সুন্দরবনকে সুস্থ সুন্দর রাখার জন্য এগিয়ে আসবে।

লেখক : প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement