২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দিল্লিতে গুজরাটের পুনরাবৃত্তি

-

দিল্লির দরিদ্র ও অসহায় মানুষ ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আগুন ও রক্তের যে সাগর অতিক্রম করেছে, তার যন্ত্রণা ও কষ্ট তারা ছাড়া আর কেউই অনুভব করতে পারবে না। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম, এ দরিদ্র-অসহায় জনগণ যে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হলো তা পরিপূর্ণরূপে কথায় প্রকাশ করতে পারব না।

কয়েকবার দাঙ্গাবাজ ও পুলিশের হাতে মৃত্যুবরণের মুখ থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু গত কয়েক দিনে এই দিল্লিতে যন্ত্রণাদায়ক ও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে তা আমাকে মারাত্মকভাবে ঝাঁজরা করে দিয়েছে। তিন দিন পর্যন্ত কোনো রকম বাধা ছাড়াই চলতে থাকা এ হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাটে বহু নিরপরাধ মানুষ মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হয়েছে। অসংখ্য মানুষ হাসপাতালে তড়পাচ্ছে। আর হাজার হাজার মানুষ শিকার হয়েছে লাঞ্ছনার। কোটি কোটি রুপির সম্পদ জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে। সঙ্কীর্ণ ও অন্ধকার অলিগলিবিশিষ্ট পূর্ব দিল্লির এলাকা মুসতাফাবাদ, খাজুরি, চান্দবাগ, কারাওয়াল নগর ও মৌজপুরে ধ্বংসলীলার মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে, এখানে শত্রুবাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে এবং বেঁচে থাকার সব উপকরণ ধ্বংস করে দিয়েছে। সারা জীবনের পরিশ্রম ও কষ্টভোগের পর সঞ্চিত সম্পদ ও আসবাবপত্র কোথাও ভস্মীভূত, কোথাও ধ্বংসস্তূপের আকারে দেখে অক্ষম অসহায় মানুষ বুক চাপড়ে কাঁদছে। তাদের মধ্যে এমন অসংখ্য দরিদ্র ব্যক্তি রয়েছে, যারা দ্বিতীয়বার নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। যে সময় রাজধানীর দরিদ্র এলাকাগুলোতে ধ্বংসলীলার এ কাহিনী তৈরি করা হচ্ছিল, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই রাজধানীতেই উপস্থিত ছিলেন। বলা হচ্ছে, পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যস্ত ছিল, এ জন্য তারা ধ্বংসযজ্ঞের এলাকায় মনোযোগ দিতে পারেনি। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যে পুলিশ ওই এলাকায় উপস্থিত ছিল, তারা অসহায় ও মজলুম নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার পরিবর্তে দাঙ্গাবাজদেরই সাহায্য করছিল। দেশের সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠাবানরূপে অভিহিত দিল্লি পুলিশের সাম্প্রদায়িক মুখোশ ওই সময়ই উন্মোচিত হয়েছিল, যখন তারা জামেয়া মিল্লিয়ার ছাত্রদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করছিল। পুলিশ তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে নিজেদের রাজনৈতিক গুরুদের খুশি করতে ব্যস্ত ছিল।

এ কথা সবারই জানা, এটা দেশের প্রথম দাঙ্গা, ঘোষণা দিয়ে যার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। গত দু’মাস ধরে শাসক দলের লোকেরা প্রকাশ্যেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত বিষাক্ত ও হুমকিমিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে আসছে। পুলিশকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। কারো এ বিষয় নিয়ে চিন্তাই নেই যে, বিদ্বেষের যে বীজ বপন করা হচ্ছে, তার ফলাফল কত ভয়ঙ্কররূপ ধারণ করবে। মনে হচ্ছে, ‘এসব কিছু এক পরিকল্পিত কর্মসূচির অংশবিশেষ এবং উগ্রপন্থীদের এ আশ্বাস দিয়ে ময়দানে নামানো হয়েছিল যে, তারা যা কিছুই করুক না কেন, আইন তাদের কিছুই করতে পারবে না।’ এ কারণেই যখন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলিধর দিল্লি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং এ বিষ যারা ছড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেন, তখন রাতারাতি তাকে বদলি করে দেয়া হলো। অপর যেসব বিচারককে এ মামলার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তারা অ্যাটর্নি জেনারেলের ইচ্ছা অনুযায়ী এ মামলার শুনানি এক মাসের জন্য পিছিয়ে দিয়েছেন। এভাবে বিজেপির ওই নেতাদেরও কোনো আইনি ব্যবস্থার বিন্দুমাত্র ভয় নেই, যারা খুনি বর্বর হিংস্র পশুর মনমেজাজ নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বিষ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে তারা নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ‘জাহান্নাম’ তৈরি করেছে। দিল্লি পুলিশ এখন পর্যন্ত ওই লোকদের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি, যারা হিংস্রতা ও বর্বরতার সর্বোচ্চ পাশবিক কাহিনী রচনা করেছে। হ্যাঁ, পুলিশ ‘বলির পাঁঠা’র অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছে এবং সবার আগে আম আদমি পার্টির পৌর কাউন্সিলর তাহের হুসাইনকে এ জন্য লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইন্টেলিজেন্স অফিসার অঙ্কিত শর্মা হত্যা মামলাও দেয়া হয়ে গেছে। তার বাড়ি ও কারখানা সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার দলের কাউন্সিলর তাহের হুসাইনকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে তাকে দল থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন এবং তার জন্য দ্বিগুণ শাস্তির দাবি করেছেন। অথচ তাহের বারবার বলছেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। তবে পুলিশের তৎপরতা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে যে, পুলিশ তাহেরকে এ দাঙ্গার ‘মাস্টারমাইন্ড’ অভিহিত করে কপিল মিশ্রকে নির্দোষ ঘোষণা করবে। আগামীতে ‘বলি’র জন্য আরো ‘পাঁঠা’ অনুসন্ধান করে তাদের দাঙ্গা ছড়ানোর জন্য আসামি বানানো হবে। আর এটারও পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে যে, রীতিমতো পুলিশের ছত্রছায়ায় দাঙ্গা ছড়ানোর হুমকি প্রদানকারী কপিল শর্মাকে কেউ জিজ্ঞাসাও করবে না, ‘তোমার মুখে কতগুলো দাঁত রয়েছে’? বিজেপির নির্বাচনী সভায় দেশের ‘গাদ্দার’দের গুলি মারার স্লোগানদাতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের কিছুই যেমন হবে না, ঠিক তেমনি দিল্লির মসজিদগুলোতে বুলডোজার চালানোর প্রকাশ্য হুমকিদাতা প্রবেশ বার্মারও কোনো ক্ষতি হবে না। কেননা এসব লোক সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ছত্রছায়াপ্রাপ্ত, যারা দিল্লি পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দাঙ্গাবাজদের মনমস্তিষ্কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এতটাই বিদ্বেষ যে, তারা কয়েকটি মসজিদেরও ক্ষতি করেছে। মসজিদের মিনারে হনুমানের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জুলুম ও বর্বরতার কাহিনী এত বেশি যে, এগুলোর সঙ্কুলানের জন্য বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থও যথেষ্ট হবে না। ধ্বংসলীলা, হিংস্রতা ও পাশবিকতার দিক দিয়ে এটা সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ঘটনা। আশার আলো শুধু এতটুকু যে, কিছু হিন্দু তার মুসলমান প্রতিবেশীর এবং কিছু মুসলমান তার হিন্দু প্রতিবেশীর জীবন নিজেদের জীবনবাজি রেখে বাঁচিয়েছে।

উত্তর-পূর্ব দিল্লির যে এলাকাগুলোতে ধ্বংসতাণ্ডব রচিত হয়েছে, তাকে ‘যমুনা পাড়’ বলা হয়। ঘনবসতির এ এলাকাগুলোতে দরিদ্র মানুষের বসবাস। তাদের বেশির ভাগই দিনমজুর। আর বাকিরা ছোটখাটো কাজকারবার করে থাকে। সঙ্কীর্ণ ও অন্ধকার অলিগলিবিশিষ্ট এ এলাকাগুলোতে জীবনের মৌলিক সুযোগ সুবিধার বেশ অভাব। তবে সৌন্দর্য হচ্ছে, এখানে বসবাসরত হিন্দু-মুসলিম অধিবাসীরা সব সময় মৌলিক প্রয়োজনে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং তারা সাম্প্রদায়িক বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকে। এ কারণেই বেশির ভাগ স্থানে মুসলমানরা হিন্দুদের বাড়িতে এবং কিছু হিন্দু মুসলমানদের বাড়িতে ভাড়া থাকছে। মিলেমিশে বসবাস করা, মানুষদের ধর্মের পরিচয় আলাদা করা কঠিন। কেননা, এখানকার লোকেরা প্রতিদিন যে জীবনযুদ্ধের লড়াই করছে, তাতে তাদের এ সুযোগটা কোথায় যে, তারা এ বিষয়ে মাথা ঘামাবে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহের ঘটনাগুলো এসব লোককে ‘হিন্দু-মুসলিম’ ঘরে বিভক্ত করে দিয়েছে। গত ২৪, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি এলাকাগুলোতে যেভাবে বেছে বেছে মুসলমানদের ঘর, দোকান ও কারখানাকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়, তাতে মুসলমানদের সব কিছু ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, দিল্লিতে ওই সব কিছুরই পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়েছে, যা ২০০২ সালে গুজরাট ভূখণ্ডে মুসলমানদের সাথে করা হয়েছিল। ওখানেও পুলিশ ও সরকারি দফতরগুলোর সহযোগিতায় বর্বর পশুদের মুসলমানদের হত্যা ও লুটপাটের জন্য প্রকাশ্য সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এবার দিল্লিতেও তিন দিন পর্যন্ত যমুনাপাড়ে দাঙ্গাবাজদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে সব কিছু করার সুযোগ দেয়া হলো। তিন দিন পর ওই সময় কারফিউ জারি এবং দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়, যখন সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। গুজরাটের গণহত্যার সময়ও এসব কিছুই হয়েছিল। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে ছিলেন? কেননা সবাই তার নাম ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত।

প্রথম দৃষ্টিতে, উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে আগুন লাগানোর উদ্দেশ্য এটাই মনে হচ্ছে যে, এটা ওই সব মানুষকে সন্ত্রাসী বানানোর ষড়যন্ত্র ছিল, যারা দেশব্যাপী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, এনআরসি এবং এনপিআরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। এ সহিংসতার সূচনাও জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের নিচে অবস্থান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী মেয়েদের সরানোর নামেই করা হয়েছিল, যেখানে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র পুলিশের ডিসিপির উপস্থিতিতে হুমকি দিচ্ছিলেন, যদি এ আন্দোলন বন্ধ করা না হয়, তাহলে সেটি বন্ধ করে দেবো। এ হুমকিকে কার্যকর জামা পরিধান করানো হয়েছে। দেশের অন্যান্য এলাকায় আন্দোলনকারীরা নিঃসন্দেহে ভীতসন্ত্রস্ত, তবে তারা সাহসহারা হয়নি। এখন প্রয়োজন, কালাকানুনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অব্যাহত রাখা। আর গণতন্ত্র ও সংবিধানের কবর খননকারীদের এটা বিশ্বাস করিয়ে দেয়া উচিত, আন্দোলনকারীরা ভয় পাওয়ার লোক নয়।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ০১ মার্চ, ২০২০ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশীরা কারা? কিশোরগঞ্জে নিখোঁজের ২৫ দিন পর উদ্ধার যুবকের লাশ উদ্ধার ভুয়া সনদ সিন্ডিকেট : কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানকে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ ঢাকার পয়োবর্জ্য-গ্যাস লাইন পরীক্ষায় কমিটি গঠনের নির্দেশ হাইকোর্টের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার : পরিবেশমন্ত্রী সাকিবকে ডিপিএলে চান বিসিবি প্রধান নির্বাচক কাতারের সাথে যৌথ বাণিজ্য কাউন্সিল গঠনে এফবিসিসিআইয়ের চুক্তি টি-২০ খেলতে সিলেটে পৌঁছেছে ভারতীয় নারী ক্রিকেট দল খুলনায় হিটস্ট্রোকে এক ব্যক্তির মৃত্যু ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলল যুক্তরাষ্ট্র? জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য বাংলাদেশের প্রাথমিক দল ঘোষণা

সকল