২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

একুশের চেতনা বৈষম্যহীন সমাজ

-

১৯৫২ একটি ঐতিহাসিক সাল, একটি প্রেরণা ও একটি চেতনার বছর। ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় দিন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ দিনটিকে স্মরণ করে আসছে এবং স্মরণ করে যাবে। সে দিন ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আহত হয়েছিলেন আরো অনেকে। মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে তারা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিতে এমনকি জীবন দিতেও পিছপা হননি। তাই একুশ হলো প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের প্রতীক। একুশ হলো বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবী চেতনার নাম। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুধু ভাষার ক্ষেত্রে বৈষম্য নয় বরং অর্থনীতির প্রত্যেকটি সেক্টরে বৈষম্যের জন্ম দিয়েছিল। তাই একুশের চেতনা হলো বৈষম্যহীন, শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণের শপথ। প্রতি বছর যখন ফেব্রুয়ারি আসে তখন বইমেলা, বিভিন্ন সভা-সেমিনার হয়। শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হয়। স্কুল-কলেজে নানা অনুষ্ঠান হয়, শহীদদের স্মরণে দোয়া মুনাজাত হয়, এভাবে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ফেব্রুয়ারি অতিক্রান্ত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের তরুণ, কৃষক, শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষকে নানা আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ সে দিন বপন করা হয়। বৈষম্য আর শোষণের জাঁতাকল থেকে এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামের ভিত্তি রচনা করে ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ শুধু ভাষার অধিকারের কথা বলেনি, একুশ বলেছে গণতন্ত্রের কথা, বলেছে শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজের কথা, প্রেরণা জুগিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহসে। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের এই চেতনায় বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একুশের চেতনায়ই আমরা আমাদের স্বাধীনতার সূর্যকেও ছিনিয়ে এনেছি।

আজ আমরা স্বাধীন, মুক্ত। আমাদের এ স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, আহত হয়েছেন, ইজ্জত হারিয়েছেন তাদের জন্য আমাদের দোয়া, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা সব সময় থাকা উচিত; কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের বড় বড় আমলারা, মন্ত্রীরা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নানা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।

পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রযুক্তিগত উন্নতি হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ভাষার জন্য জীবন দেয়া হয়েছে, অথচ আমাদের উচ্চ আদালতের ভাষা আজো বাংলা হলো না। ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য ও বহু দিনের অভ্যাস আমরা এখনো ত্যাগ করতে পারিনি। স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ- এমন কথা আমরা বইতে পড়ি, বিশ্বাসও করি ও ভালোবাসি; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তা অত্যন্ত দুর্বল। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আমরা ধরে রাখতে পারছি না, বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করছে। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তিনটি বিভাগ- আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই তিন বিভাগকে তিন অঙ্গই বলা হয়। বিচার বিভাগ যদি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে সমাজে নানা অরাজকতা, অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করে। সমাজ জঙ্গলে পরিণত হয়। জোর যার মুল্লুক তার- এর আদিম নীতির প্রতিষ্ঠা ঘটে। এটা কারো কাম্য নয়। দাঁড়িপাল্লাকে ন্যায়বিচারের প্রতীক বলা হয়। দাঁড়িপাল্লার দু’দিক সমান সমান মানে নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা। বিচারকদের বিচার করতে হবে নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে, সঠিক তথ্য-প্রমাণ দিয়ে। বলা হয়, আইনের শাসন যেখানে শেষ অত্যাচারের শুরু সেখান থেকে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বহু যুবকের রক্ত ঝরেছে, বহু লোক ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছে। স্বাধীনতার এত দিন পরেও যেন জাতি বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখতে না পায়, গুম, হত্যা ও ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ যেন কেউ করতে না পারে রাষ্ট্রকে সে দায়িত্ব নিতে হবে।

ভাষার মাসের চেতনা হবে সুশিক্ষিত জাতি গঠন, আদর্শ শিক্ষা ও মায়ের ভাষার নির্ভুল ব্যবহার। আমাদের যুবক ছাত্রদের পাঠ্যবইয়ের সাথে বহির্জগতের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করতে হবে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু উচ্চশিক্ষার মান বাড়ছে না। আমাদের দেশের তরুণরা অমিত সম্ভাবনাময়। দেশের বাইরেও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে তারা নিশ্চয়ই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারে। জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এসে বাংলাদেশের তরুণদের বিশ্ব-নাগরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তরুণদের বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে আজকের বিশ্বের বিভাজন ও সঙ্কট অনেকটাই দূর হয়ে যাবে। বিশ্ব-নাগরিক হতে আমাদের শিক্ষার বিশ্বমান নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতি, ভাষা সাহিত্যের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মাতৃভাষা বাংলার সঠিক ব্যবহার ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে। এতে দেশ যেমন উপকৃত হবে তেমনি মানবজাতি উপকৃত হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সব বৈষম্য দূর করতে হবে। আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে আদর্শ নারীজাতি গঠনের কোনো বিকল্প নেই। মায়ের ভাষা হলো আমাদের প্রিয় ভাষা, প্রকৃত ভাষা। আদর্শ ও শিক্ষিত মা যদি আমরা গঠন করতে পারি তাহলে আমাদের সমাজ হবে শোষণহীন, উন্নত ও মানবিক বোধসম্পন্ন।

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য ছড়িয়ে আছে। আমরা আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যের শিকার। ধনী-গরিবের ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের অবনতি, বেকারত্ব ও পারিবারিক কলহ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। একুশের চেতনা যেন আমাদের এ অধিকারগুলো পেতে সাহায্য করে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল