২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিদ্রোহের মোহর

-

ইসলামাবাদে বেশ ঠাণ্ডা পড়ছিল। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। এ আবহাওয়া মনের ভেতর এমন ইচ্ছা তৈরি করে, আনন্দ উপভোগকারীদের দলে আমার যেমনটা হয়। এ সময় আমার পুরনো সহকর্মী নাসির বেগ চুগতাঈয়ের ‘সুলাগতে চিনার’ (জ্বলন্ত চিনার) এক বৈঠকেই পড়ে শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে বসলাম। কিন্তু তখনই আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির মুখপাত্র জাহেদ খানের ফোন এলো। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘আজ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে বাচা খানের ওপর সেমিনার রয়েছে। ওখানে আপনাকে আসতে হবে এবং কিছু কথা বলতে হবে।’ ফোন বন্ধ হওয়ার পর ‘সুলাগতে চিনার’-এর ওপর আমার দৃষ্টি আটকে গেল। এখানে ক্রমাগত আগুন জ্বলেই যাচ্ছে। চিনারের দেশে আগুন নেভানোর জন্য বাচা খানও বারবার দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কেননা তিনি নেহরুর সাথেও কথা বলতে পারতেন, আবার শেখ আব্দুল্লাহর সাথেও কথা বলতে পারতেন। নওয়াব ইফতেখার মামদোত ও হামিদ নিজামী বাচা খানের প্রস্তাব রীতিমতো পাকিস্তান সরকার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার উত্তরে বলেছিল, আমাদের গাদ্দারের সহযোগিতার দরকার নেই। চিনারের মধ্যে জ্বলন্ত আগুন নেভানোর আকাক্সক্ষা বাচা খানের সাথে এমন এক সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছিল যে, ঠাণ্ডা ও বৃষ্টির সাথে লড়াই করতে করতে এবং ভিজতে ভিজতে প্রেসক্লাবে পৌঁছলাম। মনে করেছিলাম, তাড়াতাড়ি কিছু কথা বলে অফিসে চলে যাবো। কিন্তু সেখানে সেমিনার শুরু হওয়ার পর অনুভব করলাম, বক্তাদের শব্দগুলো মুখ থেকে নয়, অন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে। মিয়াঁ ইফতেখার হুসাইন ওই কথাই বললেন, যা আমাকে ওই সেমিনারে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, বাচা খান দুইবার কাশ্মির সমস্যা সমাধানের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। কিন্তু দুইবারই তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বাবর বললেন, যে ব্যক্তি ফাতেমা জিন্নাহকে সহায়তা করেছেন, তাকে পাকিস্তানে ‘গাদ্দার’ অভিহিত করে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে।

আড়াই ঘণ্টা এভাবেই পার হয়ে গেল অথচ স্টেজ থেকে ওঠার সাহস করতে পারলাম না। কেননা মারাত্মক ঠাণ্ডা ও বৃষ্টি সত্ত্বেও আমার সামনে অনেক যুবক মনোযোগ সহকারে আমাদের কথা শুনছিল। তাদের চোখের চমক আমার জন্য আশার আলো ছিল। এ আলো আমাকে দিচ্ছিল সান্ত্বনা।

প্রায় সোয়া ৫টায় প্রেস ক্লাব থেকে বের হওয়ার সময় বাইরে বিপুল পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ে। এত মারাত্মক বৃষ্টির মধ্যে প্রেস ক্লাবের বাইরে পুলিশের জটলা অস্বাভাবিক লাগল। অফিসে পৌঁছতেই কেউ একজন বললেন, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য মুহসিন দাওড়কে প্রেস ক্লাবের বাইরে থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেননা তিনি মনজুর পাশতিনের গ্রেফতারির প্রতিবাদ করছিলেন। যে স্থান থেকে দাওড় গ্রেফতার হয়েছেন, ওই স্থানে দুই বছর আগে ইমরান খান ও আমি নিজে মনজুর পাশতিনসহ এক সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলাম। এরপর মনজুর ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। জুলাই-২০১৮-এর নির্বাচনের আগে ইমরান খান মনজুর পাশতিনের দাবিগুলো সমর্থন করেছেন এবং দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তেহরিকে ইনসাফের প্রার্থীকে আলী উজিরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে প্রত্যাহার করে নেন। মনজুর পাশতিন ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে দুই বছর ধরে ‘লুকোচুরি’ চলছে। ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জানা গেল, মুহসিন দাওড়কে কিছুক্ষণ পরই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রাতে জানা গেল, তার সাথে গ্রেফতার হওয়া অপর ২৩ জন ব্যক্তির নামে বিদ্রোহের মামলা ঠুকে দিয়ে জুডিশিয়াল রিমান্ডের জন্য জেলে পাঠানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মামলা হয়েছে তারা সবাই আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টির লোক এবং তাদের বেশির ভাগ পাঞ্জাবি। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন যুবক বেশ উচ্চশিক্ষিত। আম্মার রশিদ আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টি, পাঞ্জাবের প্রধান। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিজের গিটার দিয়ে লড়াই করেছেন। লাহোরের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস থেকে গ্র্যাজুয়েশন এবং ব্রিটেনের সাসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন। কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতাও করেন। অপর একজন গ্রেফতারকৃত যুবক নওফেল সালিমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ইসলামাবাদের বস্তি থেকে অসহায় দরিদ্র মানুষদের উচ্ছেদ করা হলে তিনি আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকেন। তার মাতা প্রফেসর রাশেদা সালিমি ছেলের সাথে আডিয়ালা কারাগারে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। সাইফুল্লাহ নাসের হাঙ্গেরি থেকে লেখাপড়া করে এসেছেন। শাহ রুকনে আলম কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটির এমফিলের ছাত্র। তারা সবাই একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশে শরিক হয়েছিলেন। তাদের কেউ না দিয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্লোগান, না দিয়েছে যুদ্ধের ঘোষণা। অথচ রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহের মামলা’ ঠুকে দিয়েছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মারাত্মক ঠাণ্ডা ও বৃষ্টির মধ্যে কারো গ্রেফতারির বিরুদ্ধে আপনি ঘর থেকে বের হয়ে স্লোগান দিতে আসবেন? এ কাজ শুধু সেই করতে পারবে, যার বুকের ভেতর এক ব্যথাভরা অন্তর তড়পাচ্ছে; যিনি এ কথা চিন্তা করেন যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য সোচ্চার হওয়া এক যুবক খাইবার পাখতুনখাওয়াতে গ্রেফতার হয়েছেন এবং তার জন্য পাঞ্জাবের যুবকদেরও কিছু বলা উচিত, যাতে পাকিস্তানের ঐক্য সুসংহত হতে পারে। রাষ্ট্র এ কারণে বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছে যে, একজন পাখতুনের পক্ষে পাঞ্জাবি ভাষার মানুষ কেন রাস্তায় বের হবে? আর এ কারণে লাহোরের এক যুবক মুহসিন আবদালিকেও মধ্যরাতে তার ঘর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবদালির সঙ্গী আম্মার আলী জান পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির বাইরে সমাবেশের ঘোষণা দিলে মুহসিনকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে ইসলামাবাদে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের জামিনের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আম্মার রশিদ ও নওফেল সালিমির মতো শিক্ষিত যুবকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মামলা দায়েরকারীদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত যে, আপনারা বাচা খান ও তার ভাই ড. আব্দুল জাব্বার খানকেও ‘গাদ্দার’ আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে ড. খানকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে ১৯৫৪ সালে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে দেয়া হয়। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক এ কে ফজলুল হককে ১৯৫৪ সালে ‘গাদ্দার’ আখ্যায়িত করে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। আবার ১৯৫৫ সালে তাকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানানো হয়। ১৯৫১ সালে ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র’ মামলায় ফয়েজ আহমদ ফয়েজের ওকালতি করায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ‘গাদ্দার’ বলা হয়। আবার তাকে ১৯৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে ফাতেমা জিন্নাহ আইয়ুব খানের বিপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াইয়ে নামলে নওয়াব খায়ের বখশ মারিকে জাতির জননীর সিকিউরিটি ইনচার্জ বানানো হয়। আইয়ুব খান উভয়কে ‘গাদ্দার’ অভিহিত করেন। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান, গাওস বখশ বিজেনজু, আতাউল্লাহ মেঙ্গাল, জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজীর ভুট্টো, আলতাফ হোসাইন, জি এম সাইয়েদ ও নওয়াজ শরীফও ‘গাদ্দার’ আখ্যায়িত হয়েছেন। যে ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টকে গাদ্দার হিসেবে অভিহিত করেছেন, রাষ্ট্র তাকে ‘গাদ্দার’ বলে স্বীকার করেনি। তার নাম পারভেজ মোশাররফ। পাকিস্তানে গাদ্দারির অভিযোগ একটি কৌতুক এবং বিদ্রোহের মামলা রাষ্ট্রের দুর্বলতার প্রতীকে রূপ নিয়েছে। ইসলামাবাদ হাইকোর্ট কিছু দিন আগে একটি রায়ে নির্দেশ দিয়েছেন যে, কোনো প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মামলা দাঁড় করানো যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্র ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্রোহের নামসর্বস্ব মামলাগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে দুর্বল করে দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এজাজ শাহ আম্মার রশিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মামলা লড়ছেন। অথচ তিনি কিছু দিন আগে পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগের নিন্দা জানিয়েছিলেন। এ দু’টি বিপরীতমুখী আচরণ রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যের সম্পর্ককে দুর্বল করে দেয়। এ বিপরীতমুখিতা নিরসনের জন্য কায়েদে আজমের পাকিস্তানে বিদ্রোহের মিথ্যা মামলা বানানোর ধারা বন্ধ করতে হবে। এ কাজ পার্লামেন্ট করবে না। এ কাজটাও আদালতকেই করতে হবে। নতুবা বিদ্রোহের মামলা রাজকীয় মোহরে পরিণত হবে।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement