২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চালক ও দুর্ঘটনা

-

দীর্ঘকাল লন্ডনে অবস্থানকালে ও সেখানকার বিভিন্ন সংস্থার সাথে জড়িত থাকার কারণে নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে যা দেখেছি ও শিখেছি, তা থেকে সামান্য বর্ণনা করছি।

গরুর গাড়ির চালককে বলা হয় গাড়োয়ান। অতীতে গরুর গাড়িই একমাত্র পরিবহন ছিল এ দেশে। গরুর গাড়ির ওপর ছই লাগিয়ে সামনে-পেছনে পর্দা দিয়ে বিয়ের পর নতুন বৌ শ্বশুরবাড়ি যাতায়াত করত। গরুর গাড়িতে করে গ্রামাঞ্চল থেকে ধান শহরের বাজারে নেয়া হতো। গরুর গাড়ি নিয়ে ভাওয়াইয়া গান গ্রামবাসীর প্রিয় বিনোদন ছিল উত্তরবঙ্গে। শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের অনুজ মোস্তফা জামান আব্বাসীর সুললিত কণ্ঠে শুনি...‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে/কি কবো দুঃখের কথা/গাড়িয়াল ভাই...হাঁকাও গাড়ি তুমি চিলমারীর বন্দরে’।

ঘোড়ার গাড়ির চালককে বলা হতো কোচোয়ান। দুই ঘোড়ার গাড়িকে পালকি বানিয়ে সেই গাড়িতে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বধূরা চলাফেরা করত।

যারা ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে ছোট নদীতে ২০-৩০ জন যাত্রী পারাপার করে তাদের বলা হয় মাঝি। মাঝারি ধরনের জাহাজ যারা এক হাজার-এক হাজার ৫০০ জন যাত্রী নিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথে ১০-১২ ঘণ্টা জাহাজ চালিয়ে যাত্রী পারাপার করে। তাদের চালককে বলা হয় সারেং। এই জাহাজগুলোর বেশির ভাগের ফিটনেস নেই। দুই ঈদের সময় বন্দরে পরে থাকা স্ক্র্যাপ জাহাজগুলো রঙ লাগিয়ে ১০-১২ দিন মহাঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায় কেউ নেয় না।

পাকা রাস্তা, ইট বিছানো রাস্তা ছাড়া রিকশা ও ভ্যান চলাচল করতে পারে না। বড় মেশিন চালিত এবং ১০-১২ জন যাত্রী বহনকারী যানকে বলা হয় রিকশা ভ্যান, নছিমন, করিমন। যন্ত্রচালিত বড় বড় বাস-ট্রাক মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সিএনজি, রিকশা, ভ্যান, নছিমন, করিমন, লেগুনার সাথে সংঘর্ষে প্রতিদিন সারা দেশে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে।

তিন চাকার দ্রুতগামী সিএনজি এবং ভারী যানবাহন যেমন- বাস, ট্রাক এখন প্রায়ই মহাসড়কে পাল্লা দিয়ে চলার ফলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেশি ঘটে। অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গত ২২ নভেম্বর ২০১৯ ঢাকা-মাওয়া রোডে বাস ও মাইক্রো বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে বরযাত্রীসহ একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১০ জন নিহত হয়। মাইক্রো বাসচালক ১২-১৬ জন মানুষ নিয়ে পাল্লা দিয়ে চলে মহাসড়কে।

প্রায়ই বাস-ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে পড়ে ছোট যানগুলো। প্রশিক্ষণবিহীন ও অনভিজ্ঞ চালকরাই প্রায়ই মহাসড়কে বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যা করে।

আমার বাড়ি বগুড়ার সান্তাহার রেলওয়ে জংশনের সন্নিকটে। সান্তাহারে রেলওয়ের সর্ববৃহৎ ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড ছিল, যেখানে মুম্বাই-দিল্লি থেকে আগত, ব্রডগেজের ওয়াগনের মালামাল ছোট লাইনের ওয়াগনে বদলি করা হতো আসাম ও মেঘালয়ে নেয়ার জন্য। আমার মরহুম বাবা ইউরোপিয়ান গ্রেডের ড্রাইভার ছিলেন। তিনি ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে প্রথম লাইট ইঞ্জিন নিয়ে একাই ব্রিজ অতিক্রম করেন। তখন মানুষ এত ভীত ছিল যে, তার সাথে কোনো সহকারী রেল ইঞ্জিনে উঠতে সাহস করেনি। ট্রলি নিয়ে রেলওয়ের বড় বড় ব্রিটিশ কর্মকর্তা ইঞ্জিনের পেছনে ছিলেন। ব্রিজ সফলভাবে অতিক্রম করায় ‘সুজন খান ড্রাইভার’কে কর্তৃপক্ষ বিপুল পুরস্কৃত করেছিল। আটজন যাত্রীসহ সমগ্র ভারত ভ্রমণের প্রথম শ্রেণীর রেলওয়ে পাশ তাকে দেয়া হয়। ১৯০০ সাল থেকে আমাদের তিন পুরুষ রেলওয়ের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। আমার গ্রামের ১০০-১৫০ জন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় চাকরি করত। সৈয়দপুর ও পাহাড়তলী (চট্টগ্রাম) রেলওয়ে কারখানা আমাদের এক বিশাল জাতীয় সম্পদ ছিল। এখন আমরা শুধু আমদানিনির্ভর হয়ে গেছি।

সমুদ্রগামী জাহাজ দুই প্রকার- চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি (Merchant Navy) ও নৌবাহিনী (Naval Force) যারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ। জাহাজগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ প্রশ্নাতীত। বড় বিপর্যয় ছাড়া এরা প্রাণনাশের কারণ হয় না। মহাঝুঁকি নিয়ে অতল সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনা করে থাকে।

বিমান চালকদের ক্যাপ্টেন বা পাইলট বলা হয়। এরা শিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও দক্ষ। প্রতিটি বিমানের জন্য এদের নতুন করে ট্রেনিং দেয়া হয়। বিমানগুলো সবসময় ‘টিপটপ’ অবস্থায় রাখতে হয়। যাত্রার প্রারম্ভে যদি ক্যাপ্টেন যন্ত্রপাতি চেক করে সন্তুষ্ট না হন, তা হলে চিহ্নিত ত্রুটি সংশোধন না করা পর্যন্ত প্লেন ‘টেকঅফ’ করবে না। এর চালকদের অনেক চেক অ্যান্ড ব্যাল্যান্সের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। কন্ট্রোল টাওয়ার তাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।

সড়ক, রেলপথ, জলপথ এবং বিমান পরিচালনার ও দেখভাল করায় অনেক মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও বোর্ড জড়িত। তাই এককভাবে কাউকে দোষারোপ করা যায় না। শুধু বড় সড়ক নির্মাণ করলেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া বাস-ট্রাক চালানোর ফলে প্রতিদিন বহু মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে এবং এর দায় চালক সমিতি, মালিক সমিতি নিতে এবং সড়ক আইন মান্য করতে চায় না। বরং শাস্তি হলে সড়ক অবরোধ করে জনগণের পথ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। একটি শিশুকে সুশিক্ষিত চরিত্রবান ও সুনাগরিক হতে বাবা-মাকে যেমন সজাগ ও সর্তক থাকতে হয়, তেমনি সড়ক নির্মাণ করার পর কর্তৃপক্ষকে এর রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও চলাচলের যোগ্য রাখার জন্য সদা সচেষ্ট থাকতে হয়।

সড়ক বিভাগ : এখানে পক্ষ অনেকগুলো, যেমন- ১. সরকার; ২. চালক ও জনগণসহ সড়ক ব্যবহারকারী; ৩. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত; ৪. সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

চালক ও জনগণসহ সড়ক ব্যবহারকারীর সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার। দুর্ঘটনার জন্য চালকদের এককভাবে দায়ী না করে বরং তাদের প্রশিক্ষণ ও বিশেষ শিক্ষা দেয়া (Indoctrination) সরকারের দায়িত্ব। শতকরা ৯৫ ভাগ চালক জানে না, রাস্তার দাগের তাৎপর্য কী? অথচ লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে রাস্তায় ওই সব দাগ/রঙ লাগানো হয়। ডাবল হলদে লাইন অতিক্রম করে কালিয়াকৈর রেলওয়ে ওভারব্রিজে এবং টাঙ্গাইল যমুনা ব্রিজের ওপর এক বাস আরেক বাসকে ওভারটেক করে থাকে। অন্য দিকে কাঁটাতারের বেড়া ও লোহার প্রাচীর ভেঙেও জনগণ রাস্তা অতিক্রম করছে। কারণ তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য জানানো হয়নি। দূরপাল্লার চালক ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালালে তাদের অবসাদ বা ক্লান্তি দেখা দেয়। এই অবসাদের পরের ধাপ হচ্ছে নিদ্রালু। এর পরের ধাপ নিদ্রা যাওয়া, তার পরের ধাপ ঘুমানো। এগুলো অতি দ্রুত ঘটে যায়।

ড্রাইভিং ফ্যাটিগের ভুক্তভোগী আমি নিজেও। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কয়েকটি জনসভা শেষে আমরা ব্রিটেনের বার্মিংহাম থেকে (১১০ মাইল) ফেরার পথে প্রায় চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে মরহুম ফজলে লোহানীকে লন্ডনের ওয়ারিক অ্যাভিনিউ ও জাকারিয়া খান চৌধুরীকে কিংসক্রসে নামিয়ে দিয়ে একা প্রায় ১২ মাইল গাড়ি চালানোর পর স্টিয়ারিং হুইলে ঘুমিয়ে পড়ি। তখন রাত ৩টা ২০ মিনিট। স্ট্রাটফোর্ড চার্চের গোলচক্করে অনেকগুলো থেমে থাকা গাড়ি দেখে ডান পায়ে সজোরে ব্রেকে চাপ দিলে ইমার্জেন্সি ব্রেকের বিকট শব্দ শুনে সামনের ও পেছনের ড্রাইভার ও পুলিশ এসে আমাকে রক্ষা করেন। চালক যখন দেখছে মহাসড়কে তার সামনে একটি সিএনজি বা মাইক্রো বাস বা নছিমন, করিমন কাঁপতে কাঁপতে চলছে, একটু ভেঁপু বাজানোর পর ধাক্কা দিয়ে ২০-২৫ ফুট নিচে ছুড়ে ফেলে দেয়। তাকে কেন হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে না? এই দেশে রাস্তা অবরোধ করে স্লোগান দিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করলে সরকার দাবি মেনে নেয়। কঠোর হস্তে আইন প্রয়োগ করা হয় না।

সড়কে দুর্ঘটনা নিবারণের দায়িত্ব সরকারের। ৩৬ বছর বাস করছি উত্তরায়। টঙ্গী থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত রাস্তায় কোনো নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ডের চিহ্ন দেখা যায় না। নানা উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তার দুই পাশে সমানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। কখনো বা ফুটওভারব্রিজ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ফুটপাথের পাশে অনেক পিলার থাকে, যেমন- ইলেকট্রিক্যাল খাম্বা, টেলিফোন খাম্বা ইত্যাদি। ওই সব খাম্বায় সাধারণত বাসস্টপ বা বাসস্ট্যান্ড কথাটা গোল বোর্ডে স্পষ্টভাবে লাগানো থাকে। লেখা আছে, ‘যত্রতত্র বাস থামবে না। শুধু নির্ধারিত স্ট্যান্ডে বাস দাঁড়াবে।’ স্ট্যান্ডগুলোর ব্যবধান থাকতে হবে কমপক্ষে ৩০০-৩৫০ গজের। ঘন ঘন বাসস্টপ থাকলে বাসের গতি কমে যাবে, তাতে যানজট বৃদ্ধি পাবে। বাসগুলোকে অবশ্যই ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াতে হবে, যাতে যাত্রীরা নিরাপদে ওঠানামা করতে পারে। ফুটপাথ ও বাস দাঁড়ানোর মধ্যে কোনো গ্যাপ থাকলে, সেই গ্যাপ দিয়ে মোটরসাইকেল, সিএনজি বা অন্য ছোট যানবাহন বাস থেকে নামা যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। এতে বহু যাত্রী হতাহত হয়। উদাহরণ- কারওয়ান বাজার স্টপে প্রখ্যাত সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী কয়েক বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন।

পাশাপাশি দু’টি বাস দাঁড়াতে পারবে না যতই জ্যাম হোক না কেন, একটি বাসের পেছনে অন্য বাস দাঁড়াবে। এই নিয়ম কার্যকর করার দায়িত্ব পুলিশ ও চালকদের। যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে।

ব্রিটেনে ড্রাইভিং টেস্টে পাস করার পর পরীক্ষক হাতে সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে হাত মিলিয়ে দু’টি বাক্য বলেন, See and/or be seen- দেখো ও দেখাও। Consider all other road users as stupids and drunks. You are the only sane driver on the road. এ দেশে আইনের প্রয়োগ না থাকার কারণে এবং বেছে বেছে (ভিআইপি, সিআইপি) আইন প্রয়োগ করার কারণে আইন অমান্য করা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দীর্ঘকাল লন্ডনে বসবাসকালে ভিআইপি, সিআইপি দেখিনি। মন্ত্রীর যাতায়াতের জন্য রাস্তা বন্ধ করতেও দেখিনি। জনস্বার্থে সব আইন সমানভাবে দ্রুত প্রয়োগ করার জন্য সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ


আরো সংবাদ



premium cement