২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্যাসিনো মদ জুয়া ও অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন

-

অর্থনৈতিক উন্নতির কথা আমরা বারবার শুনছি। শুনছি জিডিপির প্রবৃদ্ধির কথাও। সম্প্রতি এশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৯ আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশের। জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ। ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে থাকবে ভারত। ভালো ফলন ও বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম কম থাকায় বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে থাকবে।

এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশকে এশীয় অঞ্চলের সর্বাধিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশ হিসেবে যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, তা আমাদের জন্য আশা জাগানিয়া ঘটনা। কিন্তু শুধু জিডিপির আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র বোঝা যায় না। দেশে বর্তমানে ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তবে এটা গড় হিসাবে। কিছু কিছু জেলায় এ হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ, গবেষকদের বক্তব্য ও পত্র-পত্রিকায় যে বিষয়টি বারবার উঠে আসছে তা হলো- বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট বৈষম্য বিরাজ করছে। এখানে গরিব দিন দিন গরিব হচ্ছে। ধনীরা হচ্ছে আরো ধনী। সরকারের উচ্চ মহল থেকে তাদের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের নানা দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ, বিদেশে অর্থ পাচার, জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসায়সহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িতের খবর কারো অজানা নয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ঢাকা মহানগরীর ক্লাবগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

ইতোমধ্যে মতিঝিলের ইয়ংমেন্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র, ওয়ান্ডারার্স ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাব, কলাবাগান ক্রীড়াচক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব ও দিলকুশা ক্লাবে অভিযান চালানো হয়েছে। ওই সব ক্লাব থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাসিনো বোর্ডসহ জুয়া খেলার বিপুল সামগ্রী, টাকা, অস্ত্র ও মদ-বিয়ার জব্দ করেছে। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ দৈনিক কালের কণ্ঠে ছাপা হয় যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় সাত ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রকের নাম। তারা হলো- ঢাকা মহানগরীর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান, সহ-সভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, সহ-সভাপতি সারোয়ার হোসেন মনা, যুগ্ম সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন। যুবলীগ নেতা পরিচয় দানকারী জি কে শামীমকে নিকেতনে তার অফিস থেকে বিপুল অর্থ ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর রিসিটসহ আটক করা হয়। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি) পরিচালক; ক্যাসিনো চালানোর জন্য ক্লাবের জায়গা ভাড়া দেন এবং র‌্যাব বলেছে, ক্যাসিনো থেকে লোকমান গত দুই বছরে ৪১ কোটি টাকা কামিয়েছে, আর এ টাকার পুরোটাই জমা করেছে অস্ট্রেলিয়ার এএনজেড ও কমনওয়েলথ ব্যাংকে।

তেজগাঁওয়ের ফু-ওয়াং ক্লাবে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুল বিদেশী মদ, সিগারেট ও সাত লাখ টাকা উদ্ধার করে। ঢাকার আওয়ামী লীগের সহোদর দুই নেতার বাসা থেকে পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও অস্ত্র জব্দ করেছে র‌্যাব, ঢাকার ওয়ারীর লালমোহন সাহা লেনের ৮৩/১ নম্বর বাড়ি থেকে দুই কোটি টাকা, অস্ত্র ও গুলি জব্দের ঘটনায় আওয়ামী লীগের গেন্ডারিয়া থানায় সহ-সভাপতি এনামুল হক অনুর কর্মচারী আবুল কালাম রহমানকে আসামি করা হয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। শুধু ঢাকা শহরে নয়, সারা দেশে এ রকম হাজারো ঘটনায় কোটি কোটি অবৈধ টাকা, মদ, জুয়ার আসর ছড়িয়ে আছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজানা নয়। দলীয় গডফাদাররা রাজনৈতিক অঙ্গন দখল করে অর্থনৈতিকভাবে দেশকে দেউলিয়া করে ফেলেছে। অথচ দেশের ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কৃষি ও শিল্প খাতে কর্মস্থানের হার হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষিত যুবসমাজের কর্মসংস্থানের হার অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের তুলনায় কম। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সাম্প্রতিককালে অনুমিত জ্ঞানের সূচকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থা সর্বনিম্নে।

অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, মদ, জুয়া, ক্যাসিনো, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ-প্রবণতা সারা দেশে এভাবে নির্বিঘেœ চলতে থাকলে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক ও জাতীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের ফাটল দেখা দেবে। রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন; তারা যদি পাবলিক পারসেপশন না বোঝেন তা হলে তাদের জনপ্রিয়তা যেমন শূন্যে পৌঁছাবে, তেমনি দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়বে। দীর্ঘ দিন থেকে শেয়ার বাজারে মন্দা, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, বিনিয়োগের স্থবিরতা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়সহ বেশির ভাগ ব্যবসায়ে মন্দাভাব। অথচ কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, বাসা ও ফ্ল্যাট বাড়িতে জমা রয়েছে চাঁদাবাজদের কোটি কোটি টাকা ও স্বর্ণমুদ্রা। প্রতিটি সেক্টরে ঘুষ, দুর্নীতিতে সয়লাবের কারণে অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়নের কবলে নিমজ্জিত।

পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায়, তাদের ছত্রছায়ায় মদ, জুয়া, ক্যাসিনো ব্যবসায় দীর্ঘ দিন থেকে চলছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশেষ করে শাসক দলের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা নানা অনিয়ম ও অপকর্ম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বাস-লঞ্চ-টেম্পো টার্মিনাল ও হাট-বাজার দখল এবং অবৈধ চাঁদা আদায়ে জড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি দলের অঙ্গ-সংগঠন ও অন্যান্যের বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে, তা যেন মাঝপথে থেমে না যায়। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশে যেন এ শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দৃঢ় মনোভাব ও কার্যকর পদক্ষেপই অর্থনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন থেকে রক্ষা করতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রী যদি এতে সফল হন, তাহলে তার প্রতি আস্থা আরো বাড়বে।

লেখক : ব্যাংকার
ই-মেইল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement