২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারসাম্যহীন উন্নয়ন

- ছবি : সংগৃহীত

মানুষ ছাড়া বন বাঁচে। কিন্তু বন ছাড়া মানুষ বাঁচে না। মানুষ ছাড়া নদী বাঁচলেও পানি ছাড়া মানুষ বাঁচে না। বাতাস মানুষের প্রয়োজন। কিন্তু দূষিত বাতাস মানুষের কী প্রয়োজন? একটি আধুনিক রাষ্ট্রের বস্তুগত উন্নয়ন কতটা মানুষের জন্য তা বোঝার জন্য অর্থনীতির মহাপণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশটির বন, নদী, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা ও মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন তা বিশ্লেষণ করলেই উন্নয়নের চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে। একটি উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতার মাপকাঠি তিনটি- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমানো। অথচ বাংলাদেশে এই সূচকগুলো বির্তকিত। উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে বাজিমাত করা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু ভারমাম্য উন্নয়ন হচ্ছে কি না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

উন্নয়নের আফিমে জাতিকে বুঁদ রেখে সোনালী, জনতা, ফার্মাস ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ বা হলমার্ক, শেয়ারবাজার লুটেরাদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো তাদের কুক্ষিগত সম্পদকে সমাজের দশজনের গড় সম্পদ হিসাবে চালিয়ে দিলে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়বেই। এটাই তো স্বাভাবিক! মানুষের মুখ দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ আনন্দ-বেদনা বোঝা যায়, তেমনি একটি দেশের রাজধানীর চেহারা দেখেও দৃশ্যমান উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অথচ এখনো রাজধানীর ফুটপাথে অসংখ্য দরিদ্র মানুষের রাত্রিযাপনের করুণ দৃশ্য দেখা যায়। ফুটপাথের ছিন্নমূল মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম। প্রাণপ্রিয় এই শহর বায়ুদূষণের ক্ষেত্রেও রেকর্ড ভাঙছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়। ভারতের রাজধানী দিল্লি আমাদের থেকে একটু এগিয়ে থাকলেও দিন কয়েকের ব্যবধানে হয়তো আমরা দিল্লিকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করব। এ বিষয়গুলোর সুরাহা করতে না পারলে উন্নয়নের গতিধারা বর্ষার বাদলে ডুবে যাবে।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়নি। যে কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। উন্নয়নের নামে আইনের শাসনকে ভূলুণ্ঠিত করা কারো কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে তিনটি লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা উন্নয়নের নামে ভূলুণ্ঠিত করার অধিকার কারো নেই। উন্নয়ন হয়নি এটা বলছি না। কিন্তু উন্নয়নের জোয়ারে ধনিক শ্রেণীর আয়তন ও জিডিপি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে কত নদী বিনাশ হলো, কত বন উজাড় হলো, বাতাস কত দূষিত হলো, মানুষের জীবন কত বিপন্ন হলো, নাগরিকদের বঞ্চনা ও বৈষম্য কত প্রকট হলো, বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নের নিষ্ঠুরতা, এসব উন্নয়নের নামে জায়েজ করা মোটেও সুখকর নয়।

এই সরকার খালি বলছে- তাদের সময়ে নাকি সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। সুতরাং দেশের স্বার্থে তাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে। তাদের অন্য রেকর্ড যা-ই থাকুক না কেন। উন্নয়নের স্লোগানে গুম, খুন, অপহরণ, গায়েবি মামলা, ভোট-জালিয়াতি সবই এখন জায়েজ করা হয়েছে। অথচ গুম হওয়া বাবার জন্য সন্তানের বুকফাটা আর্তনাদ, সন্তান হারা বাবা-মা ও স্বামী হারা স্ত্রীদের কান্নার আওয়াজ ইথারে ইথারে ভাসছে। উন্নয়ন কেবল এক সরকারই করে না। সব সরকারই কমবেশি করে থাকে। প্রত্যেক সরকার তার আগের সরকারের ভিত্তিকে পুঁজি করেই উন্নয়ন করে। একটি সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন আগের সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ করে দেয় না। বরং তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যে উন্নয়নের কথা আমরা বলছি, সে উন্নয়নের সুফল কি সব শ্রেণী পেশার মানুষ পাচ্ছে? এ প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারেন। কারণ, এক দিকে অতি ধনী হওয়ার মানুষের সংখ্যা যেমন বাংলাদেশে বাড়ছে, তেমনি বিশ্বের অধিক দরিদ্র মানুষগুলো যে পাঁচটি দেশে বসবাস করছে; সেই তালিকায়ও বাংলাদেশ আছে। সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে জিডিপি বেড়ে যাওয়ার দিনগুলোয় সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর সবেচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে এক হাজার ৫৮ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু আয়ের এই সূচক উন্নয়ন, আইনের শাসন কিংবা মানুষের ভালো থাকার কিছুই বোঝায় না। জনগণের জন্যই তো উন্নয়ন। অথচ এক শ্রেণীর মানুষ ব্যতীত উন্নয়নের ছোঁয়া সব মানুষের দোরগোড়ায় যায়নি। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান, গরিব মানুষের চিকিৎসা ব্যয় ফ্রি ও বেকার ভাতার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে উন্নয়নশীল দেশের স্লোগান সত্যিই প্রেরণা জোগাত।

সম্প্রতি তিনটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা যথা- এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ চলতি অর্থবছরে ২০১৮-১৯ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ঘোষণা করেছে। এডিবির মতে, প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতে, ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফের মতে, ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু এই আশার বিপরীতে বেশ কিছু বিষাদের খবর ও কম পীড়াদায়ক নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করে সমাজের ওপরের তলার ১০ শতাংশ মানুষ। আর বিপরীতে মোট আয়ের ১ শতাংশ ভোগ করে নিচতলার ১০ শতাংশ মানুষ। সাম্প্রতিককালে সিপিডির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সমাজের উঁচু স্তরের ৫ শতাংশ মানুষ নীচু স্তরের ৫ শতাংশ মানুষের চেয়ে ১২১ গুণ আয় বেশি করে। আয় বৈষম্যের এই প্রবণতা সামনে হয়তো বাংলাদেশকে একটি উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত করবে।

এ ধরনের ধনী বৈষম্য একটি গণতান্ত্রিক দেশে সুখকর নয়। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা অক্সফামের প্রকাশিত অসাম্য সূচকেও দেখা গেছে, দেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা বেজায় দুর্বল; যদিও দেশটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। তবে ধনী বৈষম্যের সূচকে বিশ্বের ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮। অর্থাৎ খুবই নিচে। ভুটান ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার সব কয়টি দেশ যথা- মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালের অবস্থান বাংলাদেশের ওপরে (সূত্র স্টার বিজনেন্স ১০ অক্টোবর ২০১৮)। উন্নয়নের সাথে সাথে ব্যয়ের দিকটিও বিবেচনা করা উচিত। এই সরকারের আমলে প্রচুর ভৌতিক অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। সরকার সারা দেশে বেশ কয়েকটি বৃহৎ আকারের ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

যেমন- উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতুর মতো বহু মেগাপ্রকল্প সরকার বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রায় সব ক’টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে নির্দিষ্ট সময়ের পরও অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। এমনকি ব্যয় তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় ভারত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিটি প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর প্রকল্পগুলোর চূড়ান্ত ব্যয় যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রকল্প ব্যয়ের তকমা পেতে আমাদের অসুবিধা হবে না।

গণতন্ত্র নিয়ে শাসক দলের মনোভাব বড়ই চমৎকার। তাদের যুক্তি আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। তাদের এ ধারণা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানায়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কখনো গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। এ তত্ত্ব অনুসরণ করে বড়জোর ভেলকিবাজি উন্নয়নের জিগির তোলা যায়। কিন্তু মানুষের মনের দ্রোহটা অনুধান করা যায় না।

দেশের উন্নয়নকে দৃশ্যমান করতে যত কৌশলের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে, তার সিকি ভাগ যদি আইনের শাসন ও জনগণের সামগ্রিক কল্যাণের কথা চিন্তা করা হতো, তা হলে ‘বিতর্কিত ২০১৮ ডিসেম্বর’ একটি জাতীয় নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচনের খেতাব পেত না। উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরাই শাসকদলের অন্যতম রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়েছে। অথচ চিত্রের বিপরীত দিকে তাকালে দেখা যাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নাগরিক সমাজের নিরাপত্তাহীনতা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা ক্রমাগত উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। অথচ এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে শাসকদল ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারছে না। উন্নয়নের কথা বলে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার এখতিয়ার কারো নেই। টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। গণতন্ত্রহীতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হওয়া উন্নয়নের পরিচায়ক নয়। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুদৃঢ় করতে কেবল উন্নয়ন নয়, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement