১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একজন আদর্শ সৈনিকের প্রতিকৃতি

মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী - ছবি : সংগ্রহ

সৈনিকের জীবন নিঃসন্দেহে সম্মান ও গৌরবের। কৃতিত্বপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী। তিনি সম্প্রতি চলে গেলেন বহু দূরে অজানা-অচেনা না-ফেরার দেশে। রেখে গেছেন বন্ধু, সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের। পেছনে ফেলে গেছেন অগণিত শুভানুধ্যায়ী, সুহৃদ, গুণগ্রাহীদের। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম রব্বানীর ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মময় ও সফল সৈনিক জীবন। গৌরবময় জীবনের অধিকারী এই দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার বাগখালী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার মরহুম পিতা সৈয়দ আলী আহমেদ ছিলেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খ্যাতিমান প্রধান শিক্ষক। আর তিনি ছিলেন আদর্শ পিতার আদর্শ সন্তান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ১৯৫৮ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তির মাধ্যমে তিনি প্রথম মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

একই কলেজ থেকে মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জনের পর দেশসেবার অদম্য আকাক্সক্ষা নিয়ে ৩৩তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের ক্যাডেট হিসেবে ১৯৬৩ সালে যোগদান করেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে। এখানে দুই বছর কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১৯৬৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পদাতিক বাহিনীর অফিসার হিসেবে পাক-ভারত যুদ্ধের ময়দানেই যোগ দেন সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে। শুরু হয় কঠোর সৈনিক জীবন। কনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে দ্রুত সেনাবাহিনীতে তিনি সম্মান ও মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হন। একজন বাঙালি অফিসার হয়েও পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর লে. জেনারেল মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের এডিসি হিসেবে রব্বানীর নিয়োগ লাভ ছিল সবার কাছে ঈর্ষণীয়। সম্ভবত তিনিই একমাত্র বাঙালি অফিসার, যিনি এই গুরুত্বপূর্র্ণ পদে নিয়োগ লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা একজন নবীন অফিসারের পেশাদারিত্বের স্বীকৃতি বহন করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হলে অন্যান্য বাঙালি অফিসারের সাথে তিনিও আটকা পড়েন পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে। ১৯৭৪ সালে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসে যোগদান করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক কোর তথা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই রেজিমেন্টের সার্বিক উন্নতি ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে কর্মনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের কারণে মেজর রব্বানী আদর্শ দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে সবার প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হন। সুযোগ লাভ করেন কয়েকটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে নিজের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব প্রমাণের। অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৮০ সালে মিরপুরের সামরিক স্টাফ কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে পিএসসি লাভ করেন। দ্রুত তার পেশাদারিত্বের সুনাম সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে। এবার তিনি পেলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ রেজিমেন্ট পরিচালনার গুরুদায়িত্ব। রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আস্থা লাভ করেন। কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের কারণে হয়ে ওঠেন আদর্শ সৈনিকের প্রতিচ্ছবি। দক্ষতার সাথে একাধিক পদাতিক ব্যাটালিয়ন পরিচালনার মাধ্যমে লাভ করেন পেশাদার অধিনায়কের মর্যাদা ও স্বীকৃতি। সেনাবাহিনীর দু’টি পদাতিক ব্রিগেড কমান্ড করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করে পেশাদার ‘সামরিক নেতা’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রব্বানীকে আমার জানার প্রথম সুযোগ আসে যখন তিনি সিলেটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইনফেন্ট্রি স্কুলের কমান্ড্যান্ট (অধ্যক্ষ) ছিলেন। আমি তখন সেখানে প্রশিক্ষণার্থী। আশির দশকের প্রথম দিকের কথা, দীর্ঘকাল পরও তার ব্যক্তিত্ব এবং কথনশৈলীর কথা আজো ভুলতে পারিনি। যেমন ছিল তার ভাষা, তেমনি বাচনভঙ্গি এবং সর্বোপরি উপস্থাপনার জাদুকরী দক্ষতা। তার বক্তৃতায় অভিভূত হতাম এবং তা হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দিত। তার কথায় অনুপ্রাণিত বোধ করতাম। প্রায়ই তিনি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রের বাইরে এবং জুমার নামাজের সময় সুযোগ পেলেই উপদেশ দিয়ে এবং প্রণোদনামূলক বক্তৃতা করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তিনি সবার উদ্দেশে একটি কথা প্রায়ই বলতেন- ‘You are what you are in the dark’।

আশির দশকের শেষের দিকে হবে, তখন আমি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলাম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রব্বানী এই সময়ে একাডেমির কমান্ড্যান্ট (অধ্যক্ষ) হিসেবে যোগদান করেন। এই প্রথম তার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত হলাম। অল্প দিনের মধ্যেই তার সাথে আমার আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তার স্নেহের পাত্রে পরিণত হলাম। এবার তার মতো একজন আদর্শ সামরিক নেতৃত্বকে খুব কাছ থেকে দেখা ও বোঝার সুযোগ পাই। এমন সুশৃঙ্খল, আদর্শ ও পেশাদার সৈনিক খুব কমই দেখা যায়। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও আদর্শ সৈনিক। তার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলাম একজন আদর্শ সৈনিকের প্রতিকৃতি।

ব্রি. জেনারেল রব্বানী দেশ ও সমাজ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন এবং সব বক্তৃতায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠত। সুযোগ পেলেই সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতেন। মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে আসা বেসামরিক অফিসাররা তার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। বিএমএতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা বেসামরিক অফিসারদের কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে আজো ব্রি. জেনারেল রব্বানীর নেতৃত্বের প্রশংসা করতে তারা ভোলেন না। সহকর্মীদের ওপর প্রভাব বিস্তারের এক জাদুকরী দক্ষতা ছিল তার। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কখনো তাকে কথা বলতে দেখিনি। নেতৃত্বের গুণাবলি প্রসঙ্গে তিনি প্রায়ই Character, Dedication and Courage (CDC)-কে অধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন, সৈনিকের দৃষ্টি এমন তেজোপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক হবে, যেন কোনো গাছের দিকে দৃষ্টিপাত করলে ওই গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। তার মতে, সৈনিকের জন্য “Slow and steady wins the race” নয়, বরং “Fast and accuracy wins the race”। প্রযুক্তির এই যুগে তার বক্তব্য যে কতটা সঠিক, তা সহজেই বোঝা যায়। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার কথা এবং কর্মময় জীবন আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এমন আদর্শবান ব্যক্তিত্বকে কি সহজে ভোলা যায়?

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি ঢাকার নিউমার্কেটের দক্ষিণ গেটে তার সাথে সাক্ষাৎ। কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে তার কর্মস্থল কোথায়, জিজ্ঞেস করায় তিনি সহজভঙ্গিতে উত্তর দিলেন- ‘অস্ত্র থেকে বস্ত্রে’। অর্থাৎ আগে ছিলেন সেনা সদরের অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি পরিদফতরে, আর এখন আছেন রেশম উন্নয়ন বোর্ডে। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন ‘কথার জাদুকর’। তখন মনে হয়েছিল, এ কথার মধ্য দিয়ে হয়তো বা তার সব যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকার পরও মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি না পাওয়ার হতাশাই ক্ষোভের সাথে ব্যক্ত করেছিলেন। চায়নার প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনডিইউ লাভ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বুনিয়াদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন তার পেশাদারিত্বের পরিচায়ক। অথচ তার প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। আমাদের সমাজ আজো যোগ্য ও মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে দেশ ও জাতি যোগ্য নেতৃত্বের সেবা থেকে বঞ্চিত। মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করার অর্থই হচ্ছে জাতির ধ্বংস ডেকে আনা।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রব্বানী ছিলেন কঠোর সামরিক শৃঙ্খলাসচেতন এবং প্রখর শিষ্টাচারসম্পন্ন মানুষ। তিনি মনেপ্রাণে কঠোর সামরিক শৃঙ্খলা, রীতিনীতি ও শিষ্টাচারে বিশ্বাস করতেন। তাই ক্ষয়ে যাওয়া রীতিনীতি ও শিষ্টাচারের সঠিক জ্ঞান ও চর্চা অক্ষুণœ রাখার প্রতি সব সময় জোর তাগিদ দিতেন। নিজেও সামরিক রীতিনীতি ও শিষ্টাচার পালনে ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। এ জন্য অনেকের কাছে তিনি ছিলেন ‘অপ্রিয়’। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল প্রধানের দায়িত্ব পালন শেষে প্রকৃতপক্ষে তার সৈনিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

বর্তমানে একই এলাকার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও রব্বানী সাহেবের সাথে দেখাসাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। অবসর জীবনে তিনি নিজেকে সমাজ থেকে অনেকটাই দূরে রেখেছিলেন। মাঝে মধ্যে বাসায় গিয়ে তার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতাম। তার মৃত্যুর প্রায় তিন মাস আগে দীর্ঘ সময়ব্যাপী তার সাথে দেশ ও সমাজের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে শেষবারের মতো আলোচনার সুযোগ হয়েছিল আমার। এর কিছু দিন পর তার বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম, তিনি অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি আছেন। মাঝে মধ্যে তার খবর রাখার চেষ্টা করেছি। সিএমএইচে গত ৩ মে শুক্রবার সকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি হারাল একজন আদর্শবান দেশপ্রেমিক সৈনিককে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও ধার্মিক। বারবার মনে পড়ছে তারই কথা- ‘দুনিয়ায় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাকে ব্রিগেডিয়ার বানিয়েছেন সত্য, কিন্তু আমার আফসোস আজো আখিরাতের সাধারণ সৈনিকের যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি।’ আমরা দোয়া করি, পরকালে আল্লাহ তায়ালা তাকে যেন জান্নাতবাসী করেন। আমীন।
লেখক : পরিচালক, সামরিক ইতিহাস কেন্দ্র, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement
বুয়েটে নতুন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক নিয়োগ পঞ্চগড়ে নৌকা ডুবে নিহতদের পরিবারের সাথে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ সখীপুরে সাংবাদিকের ওপর হামলাকারী সেই আ'লীগ নেতা কারাগারে ফরিদপুরে দুর্ঘটনায় মা-ছেলে নিহত, আহত বাবা-মেয়ে দিরাইয়ে বজ্রপাতে ২ জনের মৃত্যু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের পাঠ্যক্রম গ্রহণের আহ্বান রাষ্ট্রপতির বগুড়ায় পুলিশ পরিচয়ে ট্রাকভর্তি কলা ছিনতাই : গ্রেফতার ৪ ওয়ালটনের আদর্শ ও নীতিমালার পরিপন্থী নাটক প্রচার করায় বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানকে আইনি নোটিশ, চুক্তি বাতিল স্নান করতে গিয়ে দূর্গাসাগর দীঘিতে ডুবে একজনের মৃত্যু ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ককে লালন করে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে : শ্রিংলা মানবতার কল্যাণে জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে হবে : জামায়াত আমির

সকল