রক্তস্নাত আরব বিশ্ব
- আলফাজ আনাম
- ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৪১
আরব বসন্তের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন করে রক্তাক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা চলছে বিদায়ী বছরে। গত এক বছরের ঘটনাপ্রবাহে এ অঞ্চলের আরব দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ বেড়েছে। দেশগুলো আরো বেশি বিচ্ছিন্ন ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ফলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসরাইল। তবে গত এক বছরে আরব দেশগুলোর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাবের বিপরীতে এ অঞ্চলে রাশিয়ার ভূমিকা বেড়েছে। একই সাথে মুসলিম বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী দেশ তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী দেশে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখনো দুঃস্বপ্নই রয়ে গেছে। তাদের দুঃখগাথা আরো নতুন মাত্রা নিচ্ছে। সিরিয়া ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের শেষ পরিণতি এখনো দেখার বাকি। যদিও একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছে বলে আশা করা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে এ অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ। ২০১৭ সালের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কথা জানান। এই ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে নিয়ে আসা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিরা দখলদার রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিশ্বজুড়ে এই ঘোষণার নিন্দা জানানো হয়। ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এই আন্দোলনে বহু ফিলিস্তিনি হতাহত হয়। জেরুসালেমকে রাজধানী ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই পবিত্র স্থান নিয়ন্ত্রণে ইসরাইলের প্রচেষ্টা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।
জেরুসালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনিরা যে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে আসছে, তাতে আরেকবার কুঠারাঘাত করার সুযোগ করে দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। এই ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিদের ওপর থেকে আরব রাষ্ট্রগুলো যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরব দেশগুলো এক ধরনের নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে। সৌদি আরব নীরবে ইসরাইলের নীতিকে সমর্থন করে। ট্রাম্প প্রশাসন তথাকথিত যে শান্তি ফর্মুলা দিয়েছে, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। যেখানে জেরুসালেমের পরিবর্তে আবুদিস গ্রামকে ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যার মাধ্যমে আল আকসার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ইসরাইলের হাতে। জেরুসালেম নিয়ে ইসরাইলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে অবৈধ বসতি স্থাপনপ্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। গাজার ওপর এক দশকের বেশি সময় চলা অবরোধ আরোপ করে লাখ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু দিন পর পর চলছে বিমান হামলা। গাজার অকুতোভয় মানুষ ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরব দেশগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। বিদায়ী বছরটি ছিল ফিলিস্তিনিদের জন্য অত্যন্ত বেদনার আর রক্ত ঝরানো আরেকটি বছর। নতুন বছরটিও তাদের জন্য রক্তস্নাত হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়।
শুধু ফিলিস্তিনি নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে মানুষের রক্ত ঝরছে। ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে প্রাণ হারাচ্ছে নারী ও শিশুরা। ইরান-সৌদি আরব বিরোধে প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ইয়েমেন। ২০১৫ সাল থেকে চলা গৃহযুদ্ধে সৌদি-আমিরাতি হস্তক্ষেপে যুদ্ধ প্রলম্বিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুদ্ধে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ মারা গেছে। এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে দুর্ভিক্ষে। শুধু খাবারের অভাবে ৮৪ হাজার শিশু মারা গেছে। সৌদি কোয়ালিশনকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন দিয়ে আসছে। সম্প্রতি পরিস্থিতি উন্নতির কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে; পশ্চিমা দেশগুলো ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন দেয়ার নীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির গৃহযুদ্ধ অবসানে নতুন করে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইয়েমেনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রথম এ বিষয়ে সমঝোতা হতে হবে। কারণ, গেরিলাদের দুই পক্ষ এ দুই দেশ থেকে সমর্থন পাচ্ছে। যদিও তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে সৌদি আরব যদি যুদ্ধ থেকে সরে আসে, তাহলে প্রাণহানির সংখ্যা কমে আসবে। শান্তি ফিরিয়ে আনা সহজ হতে পারে।
সিরিয়া যুদ্ধ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। সাত বছরের গৃহযুদ্ধে চার লাখ মানুষের প্রাণহানি আর ৬৩ লাখ মানুষ শরণার্থী হওয়ার পর কার্যত দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আসাদ পরিবারের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে যারা রাস্তায় নেমেছিল, তাদের সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। দেশটা হয়ে পড়েছে নানাভাবে বিভক্ত। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সিরিয়া হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইসরাইল ও তুরস্কের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের কেন্দ্র। শেষ পর্যন্ত প্রলম্বিত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দেশটি থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। রাশিয়া ও ইরানের ছত্রছায়ায় আসাদ সরকার সিরিয়ার ওপর পূণর্ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। অপর দিকে সিরিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বাড়িয়েছে। তার বিরোধী পক্ষ কার্যত দুর্বল হয়ে পড়েছে। নতুন বছরটি সিরিয়ার জন্য ভালো কিছু খবর বয়ে আনতে পারে। সীমিত পরিসরে শরণার্থীরা দেশে ফিরে আসতে পারে। তবে বিরোধী সশস্ত্র যোদ্ধাদের সাথে আসাদ সরকারের আচরণ কী হয় তা দেখার বিষয়। তুরস্ক বিপুল শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে কুর্দি যোদ্ধারাও দুর্বল হয়ে পড়বে। এর ফলে তুরস্ক সংহত হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি প্রভাব বলয় আরো সংহত করতে ইরানের ওপর আগামী দিনে চাপ বাড়বে। ইরান এবং রাজনৈতিক ইসলামকে চাপে রাখা এখন ইসরাইলের প্রধান কৌশল। ২০১৫ সালে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পর ইরানের ওপর আরো নতুন ধরনের অবরোধ আরোপের চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এসব অবরোধ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যে বাড়ছে। অপর দিকে নীরবে লেবানন ও ইয়েমেনের রাজনীতিতে ইরান গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। হামাস ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলোর সাথে ইরানের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ফলে ইরানকে দুর্বল করার প্রচেষ্টার মধ্যেও দেশটির প্রভাব খর্ব করা সহজ হবে না।
তবে আরব বিশ্বে নতুন করে সহজেই গণজাগরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, সেনা নিয়ন্ত্রিত স্বৈরশাসক ও বাদশাহরা নিজেদের মধ্যে একটি বোঝাপড়ায় আসতে পেরেছেন। ২০১৮ সালের মার্চে নির্বাচনের নামে এক প্রহসনের মাধ্যমে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি তার ক্ষমতা আরো সংহত করেছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পাশাপাশি সামাজিক শক্তি হিসেবে তাদের টিকে থাকার ভিত্তিগুলোতে আঘাত হানা হচ্ছে। মিসরে গণতন্ত্রের পরাজয় আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের আগামী সম্ভাবনাকে বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র সৌদি আরব নানা দিক দিয়ে চাপের মুখে আছে। নতুন বছরে দেশটিতে সঙ্কট আরো বাড়তে পারে। কাতারের সাথে অবরোধ আরোপের পর সৌদি আরবের ভেতরের চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণার পর রাজপরিবারের ভেতরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। এর ফল হিসেবে বছরের শেষে এসেও দেশটির মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল করতে হয়েছে। গত অক্টোবরে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৌদি আরবের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণœ করে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সৌদি আরব দুর্বল হয়ে পড়ছে। আরব দেশগুলোর ওপর সৌদি আরবের একচ্ছত্র প্রভাব নেই। ইয়েমেন যুদ্ধের বদনাম ও বোঝা দুটোই দেশটির ঘাড়ে চেপে বসেছে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও লিবিয়ায় সঙ্কটে সৌদি আরব যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। কাতারের ওপর অবরোধ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্কের সাথে দেশটির সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। আঞ্চলিক রাজনীতিতে আগামী দিনে সৌদি আরবের প্রভাব আরো কমতে থাকবে।
নতুন বছরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস বইবে, এমনটি আশা করার সুযোগ না থাকলেও নতুন করে কোনো দেশ হয়তো আর যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠবে না। ইরাক ও সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরব শাসকেরা যদি ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন, তাহলে নতুন বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত এ অঞ্চলে পুনর্গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা