রাষ্ট্র সংস্কারে জনমতের বিকল্প নেই
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:৫১
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা যে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি ভবিষ্যতে যেন আবারো অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় তা জেঁকে বসতে না পারে, তার জন্য রাষ্ট্রের সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার একান্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই রাষ্ট্র স্বাধীন করেছিল। কিন্তু মানুষের এই আত্মত্যাগের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিবাদ এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের খুব বেশি প্রয়োজন। রাষ্ট্র মেরামত বলতে যদি শুধু কাগজে-কলমে সংবিধান পরিবর্তন বুঝায়, তাহলে কোনো ফল আসবে না। সংস্কার হতে হবে রাষ্ট্রের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত আমূল পরিবর্তন।
যেকোনো রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হলে জনমতের প্রয়োজন হয়। জনমত ব্যতীত পরিবর্তন কোনো কাজে আসবে না। আমাদের রাষ্ট্রে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে জনমতকে উপেক্ষা করে যেভাবে ফ্যাসিবাদের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তার থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রথমেই একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের কাছে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রধান বাহন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য প্রথমেই নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার এই কাজের প্রধান সহায়ক ছিল নির্বাচন কমিশন। কাজেই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম শর্ত যদি হয় গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচন করা, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে অবশ্যই জবাবদিহি করার বাধ্যবাধকতাও থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন আইন এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশন সরকারের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য না হয়। অর্থাৎ জবাবদিহিমূলক নির্বাচন কমিশন আইন তৈরি করতে পারলে নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ড সোজা রাখতে বাধ্য হবে।
সংবিধান একটি জীবন্ত রাজনৈতিক দলিল। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে না পারলে এর কার্যকারিতা থাকে না। কাজেই সংস্কারের অংশ হিসেবে সাংবিধানিক কাঠামোকে এমনভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে যেন রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান সংবিধানের আলোকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে থাকে। কারণ, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারলে গণতন্ত্রকে বিকশিত করা যাবে না। কাজেই রাষ্ট্র সংস্কারের অত্যন্ত জরুরি বিষয়টি হলো ভবিষ্যতে সরকার এবং রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান যেন ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে তার পথ রোধ করা। তবে সরকার যেন ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যাতে আরো স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করতে পারে, তার জন্য রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য, ত্যাগী এবং শিক্ষিত লোকদের নেতৃত্বের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও তারা অধিক গণতান্ত্রিক চর্চা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রশাসনিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান কাঠামোয় রাষ্ট্রের সচিব থেকে শুরু করে যেকোনো সরকারি অফিসের পিয়ন পর্যন্ত মহাশক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা ভুলেই যান, তারা রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী। জনগণের সেবকের পরিবর্তে তারা জনগণের প্রভু হয়ে ওঠে। মূলত সরকার যদি গণতান্ত্রিক না হয় তাহলে তাদের টিকে থাকার জন্য প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই সুযোগে প্রশাসনও হয়ে ওঠে মহা স্বৈরাচার। কাজেই প্রশাসনিক কাঠামোকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের জড়াতে না পারে। সবক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে না পারলে সব ধরনের সংস্কারই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী শাসনকে মজবুত করার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের পরিবর্তে প্রশাসনের ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। মন্ত্রী-এমপিদের বাদ দিয়ে জেলার উন্নয়ন তদারকির দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকদের। ফলে জেলা প্রশাসকরা হয়ে পড়েছিলেন বনের রাজা। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে থোরাই কেয়ার করতেন। হাসিনার এই সিদ্ধান্ত ছিল জনগণের পরিবর্তে প্রশাসন দ্বারা সরকার গঠন করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করা। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে তারা সেভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এখন এই ধারা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনিক কাঠামোতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের শর্তের মধ্যে আমলাদের অবশ্যই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখার বিধান তৈরি করতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের আওতাভুক্ত অর্পিত দায়িত্ব পালন করাই হবে তাদের প্রকৃত কাজ এবং তাদের কাজের জবাবদিহি থাকতে হবে চেইন অ্যান্ড কমান্ড-এর ভিত্তিতে, যাতে করে জনগণ তাদের প্রকৃত সেবা পায়।
রাষ্ট্র মেরামত করতে হলে পুলিশ প্রশাসনের বিদ্যমান মান্ধাতা আমলের পুলিশ সার্ভিস আইন পরিবর্তন করে যুগোপযোগী আইন তৈরি করতে হবে। পুলিশ সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে জনগণের সাথে থেকে কাজ করে। কাজেই তাদেরকে এমন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে যেন তারা জনগণের শত্রু না হয়ে বন্ধুরূপে কাজ করতে পারে। পুলিশকে কেন জনগণের বিরুদ্ধে বন্দুক তাক করতে হবে? কেন তারা রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হয়ে কাজ করবে? এই জায়গা থেকে পুলিশকে বের করে আনতে হবে। পুলিশকে নৈতিক শিক্ষামূলক ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে তারা অপরাধের সাথে আপসের জায়গা তৈরি করতে না পারে। শুধু জনপ্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনীকেই নয়; হাসিনা সরকার বিচার বিভাগকে একেবারেই উলঙ্গ করে ফেলেছে। দলকানা লোকদের বিচারক নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলার ওপর খুব নিষ্ঠুরভাবে নিপীড়ন চালিয়েছে। আইনের শাসন বলতে রাষ্ট্রে কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কাজেই রাষ্ট্র সংস্কারের শর্ত হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে বিচার বিভাগের সংস্কারকে। বিচার বিভাগ যেন সরকার দ্বারা প্রভাবিত হতে না পারে তার জন্য বিচারপতিদের নিয়োগ পদ্ধতিতে যে ত্রুটি আছে তা দূর করতে হবে এবং বিচারব্যবস্থাকে অবশ্যই স্বাধীন করতে হবে।
৫ আগস্টের মহান বিপ্লবের মূল সূর হলো, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যবহার করে যেন আগামী দিনে সরকারগুলো দানবীয় শক্তিতে পরিণত না হয় এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও গণপ্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠে তার পদক্ষেপ মাত্র। ৫ আগস্ট ইতিহাসে অনবদ্য হয়ে থাকবে কারণ, বিগত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তার ক্ষেত্রও প্রস্তুত হচ্ছিল বহুদিন থেকেই। বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত সময়। সেই দিক বিচারে বাংলাদেশের ইতিহাসেই শুধু নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। আরব বসন্তেও এমন গর্জে ওঠেনি, যেমন গর্জে উঠেছিলেন সারা দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্রদের সাথে জনগণ। এই জেগে ওঠার পেছনের মূল কারণ, জনগণ পরিবর্তন চেয়েছে।
কোনো ফ্যাসিবাদের আশ্রয় প্রশ্রয় এই দেশের জমিনে যেন না হয় তার নিশ্চয়তার জন্যই এই বিপ্লবের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেই প্রয়োজনের তাগিদেই সহস্র মানুষের রক্তের বিনিময়ে হাসিনা ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ পেয়েছে। এই স্বাধীনতা যদি প্রকৃত অর্থেই রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বার্তা বহন করে, তাহলে যারা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাদের এই আত্মত্যাগ সফল হবে।
আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি তা কোনো সহজ কাজ নয়। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং আগামী দিনে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ও বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। এই কাজের জন্য সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে জনমতের। রাষ্ট্র সংস্কারের এখনই সময়। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে ভবিষ্যতে দানবীয় সরকারের উত্থানের পথ ঠেকানো সম্ভব হবে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার ভিত্তিতে, রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া সংস্কার প্রস্তাবের যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা। এমনটি হলেই রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জনভিত্তি সৃষ্টি হবে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা