১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যুদ্ধের ৬ মাসে লক্ষ্যের কাছে পৌঁছাতে পারেনি ইসরাইল

এই অভিযানে উচ্চমূল্য চুকাতে হচ্ছে গাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের
-

গত বছর ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন হামলার শিকার হওয়ার পর সংগঠনটিকে ‘গুঁড়িয়ে দেয়ার এবং নিশ্চিহ্ন করে ফেলার’ প্রতিজ্ঞা নিয়ে গাজার উপর সর্বাত্মক ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাইল, যাতে হামাস আর কোনো দিন দেশটির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারে। গাজায় ইসরাইলের সেই অভিযানের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এ ছয় মাসে ৩৩ হাজারের বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। গাজার বেশির ভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষের সবাই বাস্তুচ্যুত, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং ছোট্ট এই ভূখণ্ডটিতে দুর্ভিক্ষ আসন্ন।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ‘হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে এবং সব বন্দীদের মুক্ত করে আনার’ প্রতিজ্ঞা করে গাজা যুদ্ধ শুরু করেছিল, সে যুদ্ধে নিজেদের লক্ষ্য পূরণে তারা ঠিক কত দূর অগ্রসর হয়েছে? বিবিসি আইডিএফ-র বিবৃতি, সোস্যাল মিডিয়ায় তাদের পোস্ট এবং ইসরাইল যেসব প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের লক্ষ্যে অবিচল রয়েছে সেগুলো যাচাই এবং মূল্যায়ন করে দেখেছে।
এখন পর্যন্ত কতজন হামাস নেতা নিহত হয়েছেন?
আইডিএফ কমান্ডারদের বরাত দিয়ে প্রকাশ করা বিভিন্ন সংবাদ অনুযায়ী ৭ অক্টোবরের আগে গাজায় হামাসের ৩০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে বলে ধারণা করা হত। তবে ইসমাইল হানিয়ার মত হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বিদেশে অবস্থান করেন। হামাসের সশস্ত্রবাহিনীর নেতারা অবশ্য গাজার ভেতরেই থাকেন বলে ধারণা করা হয়। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আইডিএফ দাবি করেছে, গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা হামাসের প্রায় ১৩ হাজার যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। যদিও কিভাবে তারা এই হিসাব করেছে সে বিষয়ে কিছু জানায়নি।
শুধু সংখ্যা নয় বরং ইসরাইল বেশ কয়েকজন হামাস নেতার নামও উল্লেখ করেছে যাদের তারা অভিযানে হত্যা করার দাবি করেছে। গত অক্টোবর থেকে আইডিএফ মোট ১১৩ জন হামাস নেতার নাম উল্লেখ করেছে। যাদের হত্যা করা হয়েছে বলে তারা দাবি করেছে। এদের বেশির ভাগকেই যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় এ বছর মার্চ মাস পর্যন্ত শেষ তিন মাসে আইডিএফ হামাসের কোনো নেতাকে গাজায় হত্যা করার খবর দেয়নি।
আইডিএফ এ রকম কয়েকজনের নামও প্রকাশ করেছে। বলেছে, এরা হামাসের সিনিয়র নেতা যারা তাদের অভিযানে নিহত হয়েছে। আইডিএফ যে নামগুলো প্রকাশ করেছে তারা আসলেই হামাসের সদস্য ছিল কি না তা যাচাই করা সম্ভব না। আইডিএফ গাজা যুদ্ধে নিহত হামাস নেতাদের নামের যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানে একটি নাম মোস্তফা থুরাইয়া। যিনি আদতে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ছিলেন। গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ গাজায় দায়িত্ব পালনের সময় তার গাড়িতে হামলা চালায় ইসরাইল। ওই তালিকায় ভুয়া নামও পাওয়া গেছে।
বিবিসি কয়েকজন বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলেছে এবং তারা বলেছেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ গাজায় হামাসের পরিচিত অনেক নেতাই এখনো জীবিত আছেন বলে তাদের বিশ্বাস।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইসরাইল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক মিরাভ জোন্সজেইন বিবিসিকে বলেন, আইডিএফ এখনো হামাস নেতৃত্বের শীর্ষে থাকা নেতাদের নাগাল পায়নি। উভয়ই প্রধান নেতাদের কাছে যাওয়ার প্রতীকী স্তরে এবং হামাসকে ভূখণ্ডের অধিকারী হিসেবে প্রতিস্থাপনের স্তরেও, এটি এমন কিছু যা এখনো তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
কতজন বন্দী এখনো গাজায় রয়ে গেছেন?
ইসরাইল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া তথ্যানুযায়ী গত ৭ অক্টোবর হামাস দেশটি থেকে ২৫৩ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে, গত নভেম্বরে ছয় দিনের যুদ্ধবিরতির সময় বন্দী বিনিময় চুক্তিতে ১০৯ বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। তিন বন্দীকে সরাসরি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মুক্ত করে এনেছে ইসরাইলি বাহিনী। ১২ বন্দীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন ইসরাইলের অভিযানে সময় তাদের গুলিতে নিহত হয়েছে। শনিবার ইলাদ কাৎজির নামে আরেক বন্দীর লাশ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে ইসরাইল। যিনি গাজার আরেক সংগঠন ইসলামিক জিহাদের হাতে বন্দী ছিলেন। এখনো বেঁচে থাকা বন্দীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ১৮ বছর এবং সবচেয়ে বেশি ৮৫ বছরের ব্যক্তিরা রয়েছেন। বাকি ১২৯ বন্দীর মধ্যে অন্তত ৩৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরাইল।
হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কতটুকু ধ্বংস হয়েছে?
বিবিসি থেকে আইডিএফ কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তারা কতগুলো সুড়ঙ্গ এবং মোট সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কত শতাংশ ধ্বংস করতে পেরেছে। জবাবে তারা বলেন, তাদের সেনাবাহিনী গাজায় সন্ত্রাসীদের অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস করেছে।
আইডিএফ মাঝেমধ্যেই হামাসের বিভিন্ন সুড়ঙ্গের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে। সেগুলোতে তারা প্রবেশ করেছে। আইডিএফ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে সুড়ঙ্গ নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করেছে তা এক জায়গায় করে হিসাব নিকাশ করেও এর পরিষ্কার কোনো চিত্র পায়নি বিবিসি।
ইসরাইলের অভিযানের উচ্চমূল্য চুকাতে হচ্ছে
ইসরাইলের এই অভিযানে উচ্চমূল্য চুকাতে হচ্ছে গাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের। যুদ্ধে এরই মধ্যে ৩৩ হাজারের বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিহতের যে চিত্র প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে নিহতদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু। হামাসের অবকাঠামো ধ্বংস করার নামে ইসরাইল যেভাবে নির্বিচারে আকাশ হামলা চালিয়েছে তাতে গাজার অধিকাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। জাতিসঙ্ঘের হিসাব মতে গাজার ভেতরেই ১৭ লাখের বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে পড়েছেন।
আবাসিক এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, রাস্তা-ঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে গেছে, কৃষিজমি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজার ৫৬ শতাংশের বেশি ভবন হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু গাজা যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ইসরাইল এ যুদ্ধে তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে কি না তার স্পষ্ট কোনো চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement