২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যেভাবে টুইটার কিনলেন ইলন মাস্ক

যেভাবে টুইটার কিনলেন ইলন মাস্ক - ফাইল ছবি

ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোসে শহরে মার্চের শেষভাগে এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির জন্য এয়ারবিএনবি থেকে ভাড়া নেয়া এক বাড়িতে তাড়াহুড়ো করে আয়োজন করা হয়েছে একটি বৈঠক।

এটি টুইটারের ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইলন মাস্ক সম্প্রতি টুইটারের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডারে পরিণত হয়েছেন। এখন কানাঘুষো চলছে তিনি কোম্পানির বোর্ডেও যোগ দিতে চান।

টুইটারের চেয়ারম্যান ব্রেট টেলর সভাস্থলে এসে যা দেখলেন, সেটা তিনি প্রত্যাশা করেননি। তিনি নাকি ইলন মাস্ককে পরে টেক্সট করে বলেন, ‘এর চেয়ে আজব কোনো জায়গায় আমি সম্প্রতি এ রকম কোনো বৈঠক করিনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘এরা হয়তো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি জায়গায় কোনো এয়ারবিএনবি খুঁজছিল। সেখানে ট্রাক্টর থেকে গাধা, সবই ছিল।’

তবে বৈঠকটি বেশ ভালোভাবেই হয়েছিল। এর কয়েক দিন পরেই ঘোষণা দেয়া হয় মাস্ক টুইটারের বোর্ডে যোগ দিচ্ছেন।

তবে এটি ছিল শুরু মাত্র। পরের ছয় মাসে যা ঘটেছিল সে রকম খ্যাপাটে ঘটনা সিলিকন ভ্যালির ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। টুইটারের মালিকানা বদল নিয়ে চুক্তি একদিন এগুচ্ছে তো পরদিনই ভেঙে পড়ছে, এ রকম একটা অবস্থা।

এপ্রিলের শুরুতে ইলন মাস্ককে বেশ খুশিই মনে হচ্ছিল টুইটারের পরিচালনা বোর্ডে যোগ দিতে পেরে। তিনি ঘন ঘন টুইট করছিলেন কিভাবে এই কোম্পানি এখন বদলে যাবে।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে আসলে সমস্যা দানা বাঁধছিল। তার সাথে টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরাগ আগরওয়ালের বৈঠকে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠে। কিভাবে টুইটারের নানা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে, সে প্রশ্ন দু’জনের মধ্যে বেশ মতভেদ তৈরি হয়। এতে ইলন মাস্ক বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

‘পরাগের সাথে কথা বলে টুইটারের সমস্যার সমাধান মিলবে না’ এ রকম টেক্সট পাঠিয়ে নাকি তিনি টেলরকে তার হতাশার কথা জানান।

এরপর ইলন মাস্ক ১৪ এপ্রিল একটা ঘোষণা দিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন। তিনি টুইটার একাই কিনে নিতে চান। এজন্য তিনি ৪৪ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ চার হাজার ৪০০ কোটি ডলার দাম অফার করে বলেন, এই দামে হলে তিনি কিনবেন, নইলে নয়।

টুইটারের বোর্ড সাথে সাথেই এই দাম প্রত্যাখ্যান করল। তারা এমন কিছু ব্যবস্থাও নিল, যাতে করে ইলন মাস্ক টুইটার কিনতে না পারেন।

কিন্তু তারপরেই অবশ্য টুইটারের বোর্ড তাদের মত বদলায়। তারা বলেন, ইলন মাস্কের প্রস্তাবে তারা রাজি। ২৫ এপ্রিল টুইটার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দেয়।

ইলন মাস্ক টুইটার নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বলেন, এটি আসলে পথ হারিয়ে ফেলেছে। টুইটার খুব বেশীমাত্রায় মত প্রকাশের অধিকার সীমিত করছে এবং বিশ্বের 'টাউন হল' হিসেবে এটিকে মত প্রকাশের অধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

কানাডার ভ্যাংকুভারের একটি বাণিজ্য সম্মেলনে তিনি বলেন, এই কোম্পানির অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে তিনি মোটেই চিন্তিত নন।

তবে ইলন মাস্ক টুইটার কেনার ঘোষণা দেয়ার পরের সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে শেয়ার বাজারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম পড়ে যাচ্ছিল। কোম্পানি হিসেবে টুইটারের দামও তখন কমতে থাকে। তখন অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন, মাস্ক টুইটারের জন্য বেশি দাম দিয়ে ফেলেছেন কিনা।

তবে মাস্ক প্রকাশ্যে ভিন্ন কিছু প্রশ্ন তুলেন। তার একটা হচ্ছে, টুইটারে আসল ব্যবহারকারী একাউন্টের সংখ্যা কত?

ফোর্বস এবং ব্লুমবার্গ বিশ্বের সেরা ধনীদের যে তালিকা করেছে, ইলন মাস্ক আছেন তার শীর্ষে। তার সম্পদের পরিমাণ নাকি ২৫০ বিলিয়ন, অর্থাৎ দু’হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ইলন মাস্ক অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে যাচ্ছেন, টুইটারে বট বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি করা ভুয়া একাউন্টের সংখ্যা অনেক বেশি।

টুইটার কেনার জন্য তার দেয়া প্রস্তাব যখন গৃহীত হলো, তখন তিনি বার বার জানতে চাইলেন, টুইটারের সত্যিকারের ব্যবহারকারীর সংখ্যা আসলে কতো।

টুইটারের নির্বাহীরা তখন জানান, প্রতিদিনের সক্রিয় ব্যবহারকারীদের মধ্যে পাঁচ শতাংশেরও কম আসলে 'বট' বা স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম ব্যবহারকারী। কিন্তু এই পরিসংখ্যান শুনে ক্ষেপে যান ইলন মাস্ক।

বট একাউন্টের এই সংখ্যাটা কিভাবে তারা হিসেব করে বের করেছে, তা নিয়ে টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আগরওয়াল একটি দীর্ঘ পোস্ট দেন। মাস্ক সেই পোস্টের জবাব দেন 'পুপ' অর্থাৎ মলের ইমোজি পোস্ট করে।

টুইটারের সাথে ইলন মাস্কের চুক্তি তখন ধসে পড়ার উপক্রম। এরপর ৮ জুলাই তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চান।

ইলন মাস্ক আরো কম দামে টুইটার কিনতে দরকষাকষি করতে চান নাকি আসলেই এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চান, সেটা বলা মুশকিল।

তবে টুইটার এসব কথা মানতে চাইছিল না। তারা যুক্তি দেয় যে, টুইটার কেনার জন্য যে চুক্তি ইলন মাস্ক করেন, সেই চুক্তি মানতে তিনি আইনগত-ভাবে বাধ্য এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

দু’পক্ষই এরপর নামী-দামী আইনজীবীদের নিয়োগ করেন। ১৭ অক্টোবরে ডেলাওয়ারে এক আদালতে মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়। যেখানে মাস্ককে চুক্তি মেনে কোম্পানিটি কিনতে বাধ্য করা হবে।

আদালতে দাখিল করা কাগজপত্রে টুইটার বলেছিল, এই প্লাটফর্মের প্রকৃত ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য তারা ইলন মাস্ককে দিয়েছে।

কিন্তু মাস্ক বলেন, বট একাউন্টের সংখ্যা সম্পর্কে টুইটার প্রকাশ্যে যে দাবি করে, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো তার কয়েকগুণ। তিনি এমনকি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পর্যন্ত এনেছিলেন।

প্রকাশ্যে কোম্পানির এরকম ক্রমাগত সমালোচনা টুইটারের বেশ ক্ষতি করছিল। টুইটারের বেশিরভাগ রাজস্ব আসে বিজ্ঞাপন থেকে। বিজ্ঞাপনদাতারা ভাবলেন, তাদের বিজ্ঞাপন আসলে ঠিক কতসংখ্যাক মানুষের কাছে পোঁছাচ্ছে।

টুইটার সদর দফতরেও এসব চাপ কাজ-কর্মে বেশ ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল। টুইটারের কিছু কর্মী বেশ চাইছিলেন ইলন মাস্ক যেন তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হয়ে আসেন। কিন্তু অনেকে গোপনে এবং প্রকাশ্যে বললেন, ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নিলে সেটা হবে একটা বিপর্যয়, কোম্পানির সার্বিক লক্ষ্য থেকে শুরু করে কনটেন্ট মডারেশন সবকিছুর জন্য।

বিষয়টা যেন অবধারিতভাবেই আদালতে একটা মামলার দিকে গড়াচ্ছিল। মাস্ক নিজে, টুইটার, বিচারক ও সাংবাদিকরা সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এই মামলার জন্য। কিন্তু তারপরই ঘটনা আবারো নাটকীয় মোড় নিল।

টুইটারের বিরুদ্ধে নানা রকমের গাদা গাদা অভিযোগ করার পর আচমকা মাস্ক আবার ঘোষণা করেন, তিনি চুক্তি মোতাবেক টুইটার কিনতে চান।

তিনি বলেন, ‘টুইটার কেনার মানে হচ্ছে এক্স অ্যাপ তৈরির কাজ ত্বরান্বিত হওয়া।’ এই এক্স অ্যাপকে তিনি বর্ণনা করেছেন এভরিথিং অ্যাপ বা সবকিছু করতে পারে এমন একটি অ্যাপ হিসেবে।

কেন তিনি তার মত বদলালেন? হয়তো তিনি ভেবেছিলেন মামলায় তিনি হেরে যেতে পারেন। নিজের সিদ্ধান্ত বদলের কয়েক দিন আগে টুইটারের আইনজীবীদের এক সওয়াল জবাবের মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল তার। তিনি হয়তো একটা এরকম কড়া জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে অনেক তথ্য প্রকাশে বাধ্য হতে চাননি।

কারণ যেটাই হোক, টুইটার যে সর্বশেষ ঘোষণার পরও খুশিতে শ্যাম্পেনের বোতল খোলেনি, তার যথেষ্ট কারণ আছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement