২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দেশে কতটা জনপ্রিয় টিকটক?

- ছবি : সংগৃহীত

কয়েকদিন ধরে চুলে ফ্লুরোসেন্ট সবুজাভ ধাঁচের রং করা এক তরুণের ছবি খবরে বেশ দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও তাকে নিয়ে বেশ আলাপ চলছে।

'অপু ভাই' নামের এই টিকটকার অবশ্য তার ভাইরাল ভিডিওর জন্য খবরের শিরোনামে আসেননি। এসেছেন রাস্তায় মারপিট করে গ্রেফতার হওয়ার পর।

এরপর জোর আলাপ শুরু হয়েছে টিকটকে কি ধরনের ভিডিও বানানো হচ্ছে তা নিয়ে।

অ্যাপটি ডাউনলোড করে দেশে টিকটক সেলেব্রিটিদের পাতাগুলোতে দেখা যায় তাদের কারো কারো ভ্যারিফাইড অ্যাকাউন্টে ফলোয়ারের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ।

যেমন 'শামিমআফরিনমনি', তার ফলোয়ার প্রায় ২০ লাখ। তার অ্যাকাউন্টে লাইকের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। 'রাফিভাইইউ' অ্যাকাউন্টে ঢুকে দেখা গেলো তার লাইকের সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ।

দেশে টিকটক কেন জনপ্রিয় হচ্ছে?
কয়েক বছর আগেও ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করা খুব চমকপ্রদ একটা বিষয় ছিল। এখন কিছুদিন পরপরই নতুন কিছু আসছে।

ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট এরকম বেশকিছু অ্যাপের পর গত কয়েক বছরের ধরে নতুন যে অ্যাপটি অনেকের আকর্ষণ কেড়েছে তা হল চীনের অ্যাপ টিকটক।

দেশে টিকটক জুড়ে রয়েছে নানা ধরনের জনপ্রিয় গান, সিনেমার ডায়ালগ অথবা কোন ভাইরাল হওয়া কোন বক্তব্যের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে অভিনয়, নাচ দিয়ে মূলত হাস্যরসের ভিডিও।

রাশাত রহমান জিকো বছর দুয়েক হল টিকটকে ভিডিও তৈরিতে ঝুঁকেছেন। তবে মূলত তিনি লেখালেখি করেন।

তিনি বলছেন, "টিকটক খুব সহজ। ধরুন, একটা বই লিখতে গেলে কয়েক মাস লাগে। এত কয়েক মাস রাত জেগে কষ্ট করে একটা বই লেখার পর সেটা পাবলিশ হচ্ছে , তারপর বইটা কেউ পড়ছে, তারপর আমি ফিডব্যাকটা পাচ্ছি। কিন্তু টিকটকের ক্ষেত্রে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আপনি একটা টিকটক ভিডিও বানাবো। সেটা বানাতে আমার সর্বোচ্চ সময় লাগছে এক মিনিট। ভিডিও আপলোড করার সাথে সাথে খুব সহজে মানুষকে রিচ করতে পারছেন এবং প্রতিক্রিয়া পেয়ে যাচ্ছেন।"

তিনি বলেছেন, অনেক সহজে, অল্প পরিশ্রম করেই প্রতিক্রিয়া পাওয়া, মানুষের প্রশংসা পাওয়া সেটা একধরনের আত্মতৃপ্তির কাজ করে।

তার ভাষায়, এই আবেদনই বেশিরভাগ মানুষকে টিকটকের দিকে আগ্রহী করে তুলছে।

জিকো নামে পরিচিত এই টিকটকার বলছেন, "আমি টিকটক করছি স্ট্রেস রিলিজ করার জন্যেও। আমি ব্যাংকে কাজ করি। ব্যাংকের কাজ খুবই স্ট্রেসফুল। টিকটকে একটু সময় দিয়ে স্ট্রেস রিলিজ করার চেষ্টা করি।"

কাদের মধ্যে জনপ্রিয় টিকটক
বিশ্বব্যাপী অ্যাপ ডাউনলোড চার্টের শীর্ষের দিকে রয়েছে টিকটক। টিকটকের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বব্যাপী ৮০ কোটি মানুষ এটি ব্যাবহার করছে।

২০১৯ সালে জনপ্রিয় অ্যাপ ইন্সটাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাটকে পিছে ফেলে বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ ডাউনলোডকারী অ্যাপে পরিণত হয়েছে টিকটক।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে 'ইনফ্লুয়েন্সার' হিসেবে জনপ্রিয় রাবা খান বলছেন, "চারপাশে অনেক নেতিবাচক বিষয় ঘটছে এখন। সেগুলো মানুষের কানে আসে। সেসব বিষয়ে খবর পড়তে হয়। মানুষ খুব একঘেয়ে বোধ করছে এবং বিনোদনের উপায় খুঁজছে। টিকটক খুব সহজ একটা বিনোদন।"

ভিডিও কন্টেন্ট স্ট্রিমিং সাইট বঙ্গবিডি'র অপারেসন্স বিষয়ক পরিচালক ফাইয়াজ তাহের বলছেন, "দেশে মূলত তরুণ প্রজন্ম, যাদেরকে বলে মিলেনিয়াল তারাই এটি বেশ ব্যাবহার করছেন। মূলত হাসির জিনিস বানাতেই বেশি দেখা যায় তাদের।"

তিনি বলছেন, বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়ে টিকটক অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।

লকডাউন আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ঘরে বসে অনেকেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে বা বিনোদনের জন্য টিকটক বেছে নিয়েছেন।

তার ভাষ্যমতে, "আজকের দিনে তরুণ প্রজন্মের সামনে ঠিক তেমন কোন নির্দেশনা নেই। কোন রোল মডেল নেই। তারা মজার কিছু একটা পেয়েছে।"

টিকটক যেভাবে কাজ করে
জনপ্রিয় হতে হলে হয়ত কোন টিভি অনুষ্ঠানে, সিনেমায় অভিনয়ের জন্য অডিশন দিতে হয়। টিকটকে অডিশনের দরকার নেই। অ্যাপটি ডাউনলোড করুন, একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন। অ্যাপটিতে রয়েছে নানা ধরনের জনপ্রিয় গান, সিনেমার ডায়লগ আর সাউন্ড এফেক্টস।

অ্যাপটির মাধ্যমে নিজেকে ভিডিও করুন, তার আগে জুড়ে দিন অ্যাপটিতে থাকা পছন্দমতো গান, ডায়ালগ বা সাউন্ড এফেক্টস, ভিডিওতে গানটির সাথে ঠোঁট মেলান, সাথে ইচ্ছে হলে নাচ যোগ করতে পারেন, অ্যাপে নানা ধরনের ফিল্টার রয়েছে সেগুলো যোগ করতে পারেন, ভিডিও হয়ে গেলে পছন্দমতো যায়গায় ভিডিও এডিট করুন, খুব কম সময়ে তৈরি হয়ে গেল কন্টেন্ট, তারপর শেয়ার করুন।

এসব কিছু ছাড়াও শুধু ভিডিও করতে পারেন।

দেশে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময়কার একটি ভিডিও হয়ত অনেকের মনে আছে।

ভোটকেন্দ্রে লাইনে দাড়িয়ে থাকা নারীদের মুখে 'খুশিতে, ঠেলায়, ঘোরতে' - এই কথাগুলো অনুকরণ করে বিখ্যাত হয়েছেন অনেকেই।

কোন বিশিষ্ট ধর্মীয় বক্তার ওয়াজ, কোন রাজনিতিকের বক্তৃতার মতো গলা উঁচিয়ে অনুকরণ করে ভিডিও শেয়ার করে বেশ লাইক পেয়েছেন অনেকেই।

টিকটকের ভিডিও দেখা যায় ফেসবুকে অথবা ইন্সটাগ্রামে। বাংলাদেশে মূলত হাসির ভিডিও তৈরির প্রবণতাই বেশি মনে হল।

আগে 'ভাইন' নামে একটি 'কন্টেন্ট ক্রিয়েটর' ছিল। তবে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।

অনেক জনপ্রিয় গান, সিনেমার ডায়ালগের ব্যবহারের অনুমোদন নিয়ে রেখেছে টিকটক। যা অন্য অ্যাপগুলোতে নেই। সেটাও এর জনপ্রিয়তার কারণ হতে পারে।

সহজে জনপ্রিয় হওয়ার উপায়?
ফাইয়াজ তাহের বলছেন, "এখন আর ভিডিও তৈরিতে আর প্রফেশনাল ক্যামেরা, শব্দ যন্ত্র, নানা ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ এসব কিছুই দরকার নেই। টিকটক এতটাই সহজ। আপনার দরকার একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ। এটা হয়ত এর জনপ্রিয়তার একটি কারণ।"

কোন খরচ ছাড়াই, খুব সহজে মনোযোগ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে টিকটক?

রাবা খান বলছেন, "আমি অন্যদের হয়ে কথা বলতে পারবো না। তবে আপনার যদি কোন মেধা না থাকে তাহলে আপনি কাউকে আকর্ষণ করতে পারবেন না। আপনাকে চার্মিং হতে হবে। ইন্টারেস্টিং কিছু দিতে পারতে হবে। কোন কারণ ছাড়া এমনিই কেই বিখ্যাত হয় না।"

তবে তার মতে, "এখন ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে অনেক বেশি। আর জন্য সবচেয়ে সহজ অ্যাপগুলোর একটি হল টিকটক যা অনেকদিন আমরা পাইনি।"

টিকটকে টাকা কামাই
ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অনেকেই। টিকটকেও সেই সুযোগ রয়েছে। সেটা সম্ভব হতে হলে অবশ্য আপনার অনেক ফলোয়ার থাকতে হবে।

ভিডিওর মাধ্যমে কোন পণ্যের বিক্রি বাড়াতে অনেক ব্র্যান্ড টিকটকে যাদের ফলোয়ার বেশি রয়েছে তাদের অর্থ দিয়ে থাকেন।

অনেক সময় নতুন কোন পণ্য বাজারে আনার আগে বিজ্ঞাপনদাতারা টিকটকে সেলেব্রিটিদের পণ্যের বিক্রি বাড়াতে কাজে লাগান।

আপনাকে টিকটক সেলেব্রিটি হতে হবে না তবে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় ফলোয়ার থাকলে টিকটকে লাইভ করতে পারেন ব্যবহারকারীরা।

তারাই মূলত পণ্যের বাজারজাতকরণে বেশি গুরুত্ব পান। টিকটকে এমনকি লাইভ চলাকালীন নিলামের নমুনাও রয়েছে।

আপনার টিকটক অ্যাকাউন্টে বিজ্ঞাপন দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েও অর্থ উপার্জন সম্ভব।

অর্থাৎ, জনপ্রিয় ভিডিও দেখার সময় এসব বিজ্ঞাপন দেখা যাবে আর তাতে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন ভিডিওটি শেয়ার করেছেন যে টিকটকার।

দেশে এভাবে সেলেব্রিটিরা কত অর্থ উপার্জন করছেন সে সম্পর্কে কোন উপাত্ত নেই।

তবে এটা হয়ত বলা যায় যে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যটার কারণেও সম্ভবত এখন মোবাইল ভিত্তিক অ্যাপ নিয়ে কিছু একটা পরখ করে দেখার নেশাও বেড়েছে তরুণদের মধ্যে। বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement