তপ্ত বাতাসে সোনারাঙা ধানের শীষে দোল খাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন
- ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:১৯
দেখলে মনে হবে মাঠের পর মাঠজুড়ে কেউ সোনালি গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বাতাসে কাঁচা-পাকা ধানের শীষ দোল খাচ্ছে। সোনারাঙা ধানের উপর রোদ পড়ে চিকচিক করছে। সোনালি ফসলের ক্ষেতে এই দৃশ্যে কৃষকের মুখচ্ছবিতে আনন্দ ফুটে উঠেছে। বোরো ধানের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। বোরোর বাম্পার ফলনে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা যায়, সোনালি ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। যতদূর চোখ মেলে দেখা যায় শুধু ধানের ক্ষেত। ছড়ায় ছড়ায় দুলছে সোনারাঙা পাকা ধান। নতুন ধানের মিষ্টি ঘ্রাণে এখন ম ম করছে মাঠ। চলনবিল অঞ্চলে পুরোদমে চলছে ধান কাটা ও মাড়াই। টানা তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির প্রভাব জমিতে না পড়ায় বোরো ধানের আশাতীত ফলন হয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় এবার প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। হেক্টর-প্রতি ধানের ফলন চার দশমিক পাঁচ ও চালের ফলন দুই দশমিক সাত মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। সে হিসাবে এ বছর জেলায় দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান ও এক লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের কিছু কিছু ক্ষেতে এখন ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে চলনবিল অঞ্চলে ধান কাটা ও মাড়াই চলছে পুরোদমে। এ দিকে তাপদাহ ও প্রচণ্ড গরমের কারণে কৃষিশ্রমিকের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। তারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ধান কাটতে মাঠে নেমে পড়েছেন। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে ধান কাটা। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর উপজেলায় ধান কাটা ও মাড়াই পুরোদমে শুরু হবে। এ বছর জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে কৃষিসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চলনবিল অঞ্চলের বিভিন্ন হাটে নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন কয়েকজন ব্যাপারির সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে হাটগুলোতে প্রকারভেদে প্রতি মণ মোটা জাতের বোরো এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা ও বোরো চিকন কাটারিভোগ, মিনিকেট ধান এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে হাটে ধানের চাহিদা নেই, ক্রেতা কম। ধানের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করছে ফড়িয়া ও দালালরা। ক্রেতার অভাবে চাষিরা ফড়িয়া ও দালালদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমান বাজারদরে ধান বিক্রি করে চাষিদের প্রতি বিঘায় আট থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। পুরোদমে কাটা ও মাড়াই শুরু হলে ধানের দাম কমতে পারে এ আশায় ব্যবসায়ীরা ধান কিনছেন না। তারা হাটে গিয়ে বাজারদর ও আমদানি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। এ দিকে কৃষকের হাতে নগদ টাকা না থাকায় তার চরম বিপাকে পড়েছেন।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি উপকরণসহ শ্রমের দাম অনেক বেড়ে চলেছে, সে হারে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম বাড়ছে না। এর পেছনে তারা সরকারের অভ্যন্তরীণ বাজারনীতিকে দায়ী করেছেন। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষকই দরিদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষি পর্যায়ের। তারা ঋণ করে ফসল উৎপাদন করেন। মৌসুমি ফসল ওঠার সাথে সাথে বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হয়। তারা একযোগে ফসল বিক্রির জন্য বাজারে আনতে বাধ্য হন। সরকারের সঠিক ক্রয়নীতি না থাকায় এ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে একশ্রেণীর ফড়িয়া ও দালাল। কৃষকের গোলা শূন্য হলে কৃষিপণ্যের দাম বাড়ে। আর এ দামের সুবিধা পায় মজুদদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা, বঞ্চিত হন কৃষক।
চলনবিলের সর্ববৃহৎ কলম গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষক হিসেবে পরিচিত আব্দুল মান্নান ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে সেচ চার হাজার টাকা, হালচাষ-রোপণে কৃষাণ চার হাজার টাকা, সার-বীজ-নিড়ানি-কীটনাশক সাড়ে চার হাজার টাকা, কাটা-মাড়াই চার হাজার টাকা এবং পরিবহন বাবদ এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবমিলিয়ে তার খরচ হয়েছে ১৭ হাজার টাকা। তিনি প্রতি বিঘায় ধান পেয়েছেন ২৩ মণ। যার বর্তমান বাজারমূল্য সাড়ে ৯ হাজার থেকে ২৭ হাজার টাকা। তার উৎপাদন খরচ বাদ দিলে প্রতি বিঘা জমিতে লাভ থাকে ১০ হাজার টাকা। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক মো: আজাহার আলী জানান, টানা তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির পরও চলতি মৌসুমে জেলায় বোরো ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে। তবে দাম আরেকটু বেশি থাকলে কৃষকের জন্য ভালো হতো।