Naya Diganta

রোহিঙ্গা সমস্যা ও করণীয়

রোহিঙ্গা সমস্যাটি এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা সমস্যার দিকে মোড় নিচ্ছে বলে মনে করা হয়। কমবেশি ১২ লাখ রোহিঙ্গার বেশির ভাগই ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে বসবাস করছে। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠন তাদের জন্য সাহায্য দিয়ে আসছে। এখন সে সাহায্য কমে এসেছে। জানা যায়, কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তা গত বছরের মার্চ থেকে মাথাপিছু প্রায় ১৭ শতাংশ কমিয়েছে জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (WFP)। দুই বছরের বেশি বয়সী শিশুদের পুষ্টি সহায়তাও কমেছে। তহবিল সঙ্কটের কারণে সামনের দিনগুলোতে সুযোগ-সুবিধা আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

খাদ্যসহায়তা কমে যাওয়ায়, ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জীবন ভবিষ্যতে আরো কঠিন হয়ে উঠবে। এখনই রোহিঙ্গাদের একটি অংশ, মাদক চোরাচালান, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচার, চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাদের এসব অপরাধমূলক কাজে জড়িত হওয়ার প্রবণতা আরো বাড়বে। এখন রোহিঙ্গাদের অনেকেই শিবিরের বাইরে গিয়ে কাজ করেন। এটিও বাড়বে। এতে শ্রমবাজারে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে, রোহিঙ্গাদের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। কারণ রোহিঙ্গারা সাধারণত স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায়, কম মজুরিতে কাজ করেন। এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে ধূমায়িত অসন্তোষ রয়েছে, তা বহুমাত্রায় বাড়বে। জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য, জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে (ঔজচ) যে পরিমাণ তহবিল আশা করা হয়েছিল, ২০২১ সালে তার ৭০ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৬২ শতাংশ পাওয়া গেছে; যা চলতি বছর আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের (UNHCR) সহায়তায়, রোহিঙ্গাদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যবহির্ভূত বিভিন্ন পণ্য দেয়া হয়। তার মধ্যে আছে কাপড় কাচার সাবান, গায়ে মাখা সাবান, নারীদের সেনিটারি সামগ্রী, শীতকালে কম্বল। এ ছাড়া রান্নার জন্য দেয়া হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার। এসব ক্ষেত্রেও সহায়তা কমেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম। আগে থেকে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকানিজ রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (এআরএসএ) বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে বিভিন্নমুখী স্বার্থান্বেষী দল, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা কক্সবাজার এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অধিকন্তু ‘মোহাম্মদ নবি গ্রুপ’ নামক একটি সংগঠনও বাংলাদেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে কাজ শুরু করেছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে। যেসব রোহিঙ্গা অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করে মধ্যপ্রাচ্য বা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে গেছে, তাদের সন্তান-সন্ততিদের একজোট করে, বাংলাদেশী নাগরিক পরিচয়ে তাদের সমন্বয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। মিয়ানমার সামরিক সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ কাজের প্রস্তুতি চলছে বলে স্থানীয় সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়।

প্রসঙ্গত, ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, স্বাধীন আরাকানের অংশ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামকে, মুঘল সাম্রাজ্যের তৎকালীন শাসকের প্রতিভূ শায়েস্তা খানের নির্দেশে, তার পুত্র বুজর্গ উমিদ খান ১৬৬৫ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলার সাথে সংযুক্ত করেন। স্বাধীন আরাকানের অবশিষ্টাংশকে, ১৭৮৫ সালে বার্মার ‘কোন বাং’ শাসকরা দখল করে, পরবর্তীতে সেখানে ‘বামার’ সম্প্রদায়কে বসবাসের জন্য স্থানান্তরিত করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভারসাম্যে তারতম্য ঘটায়। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে অবলুপ্ত হয় স্বাধীন আরাকানের অস্তিত্ব। পরবর্তীতে আরো দু’টি যুদ্ধের পর ১৮৮৫ সালে বর্ণিত ‘কোন বাং’ শাসকদের পতনের মধ্য দিয়ে পুরো বার্মা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে যায়।
উল্লেখ্য, আরাকান ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর এবং তারপর প্রশান্ত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিতে এখন বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বেশ উৎসুক। এরই ধারাবাহিকতায় এতদঞ্চলে ইদানীং বিভিন্ন পরাশক্তির সর্বশেষ নিম্নোক্ত কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষক মহলের দৃষ্টির বাইরে নয়।
গত ১৪ জানুয়ারি-২০২৩ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করেন। এর আগের সপ্তাহে হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জোটের পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার চার দিনের বাংলাদেশে এসে ৯ জানুয়ারি-২০২৩ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। এর পরের দিন (১০ জানুয়ারি) চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং, ঢাকা বিমানবন্দরে বাংলাদেশী পরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। মি. কিনের সে সফরের পরপরই, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপপ্রধান মি. চেন কোর নেতৃত্বে সিসিপির আরেকটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে।
স্মরণযোগ্য যে, ২০২০ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট মি. স্টিফেন ই বিগাম, বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে, বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে, তিনি সে সময় অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি, মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (IPS) এগিয়ে নিতে, মার্কিন প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেন। সে সময় তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ এ অঞ্চলে আমাদের (USA) কাজের কেন্দ্রবিন্দু হবে।’ সে সময় বাংলাদেশকে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে টানতে, যুক্তরাষ্ট্রের সে প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল চীন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের মে মাসে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মি. লি জিমিং, এই বলে বাংলাদেশকে সতর্ক করেন যে, চার দেশের ছোট ক্লাব অর্থাৎ কোয়াডে বাংলাদেশ যোগ দিলে, ‘চীনের সাথে ঢাকার সম্পর্ক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ বিপরীত পক্ষে চীন একদিকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানালেও, তার গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) যোগ দিতে বাংলাদেশকে প্ররোচিত করে আসছে ক্রমাগতভাবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থান, দেশটিকে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছে। তারা ভারত মহাসাগরকে, ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি মালদ্বীপে চীনা প্রভাবিত সরকার গঠিত হওয়ায় এটি নতুনভাবে বিবেচনায় এসেছে। এ ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতিতে ‘শিপিং বা পরিবহন রুট’ হিসেবে এর গুরুত্ব প্রকাশ করা হয়েছে। আর এ রুটের পাশেই আরাকান ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের অবস্থান।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তার দেশের প্রতিরক্ষা বিভাগকে ৮১৭ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অনুমোদন দিয়েছেন। এনডিএ অ্যাক্ট নামে পরিচিত, এ আইন মুখ্যত তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও, এর বৈশ্বিক তাৎপর্য অনেক। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রভাব হবে সরাসরি। কারণ এবারের এ বরাদ্দপত্রে সংযুক্ত হয়েছে মিয়ানমারকেন্দ্রিক ‘বার্মা অ্যাক্ট’।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ পাস হয়। এ বিল এবং বাইডেন প্রশাসনের ২০২৩ সালের প্রতিরক্ষা বাজেটে তার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। এই বিলে উল্লেখ রয়েছে, মিয়ানমারের ভেতরকার গণতন্ত্রের সংগ্রামকে, যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দেবে। এতে দেশটিতে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মদদ দেয়ার এবং জান্তাবিরোধী এনইউজি (NUG : National Unity Govt.) সরকারের কথাও আছে। স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকারকে, যুক্তরাষ্ট্র ‘বেআইনি’ কর্তৃপক্ষ মনে করছে। রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সহায়তা দিলে, যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেবে বলে বার্মা অ্যাক্টে উল্লেখ আছে। জান্তার শক্তি কমাতে মিয়ানমারের জ্বালানি খাতও এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় লক্ষ্যবস্তু হবে বলে এতে বলা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, খনিজ জ্বালানি এই মুহূর্তে স্থানীয় সেবা তহবিলের বড় উৎস।

বোঝা যায়, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক সামরিক জবাবদিহির অধীনে এনে মিয়ানমারকে ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। অর্থাৎ এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি যুক্ত হয়ে গেল।
মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী গেরিলা ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার সশস্ত্র দলগুলোর হাতে বর্তমানে দেশটির প্রায় অর্ধেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এ সময় বার্মা অ্যাক্ট কার্যকর করা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। মূলত নামে বার্মা অ্যাক্ট হলেও এ আইন যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় নয়। এ আইনের মনোযোগ এমন এক এলাকায়, যেখানে কেবল ভারত নয়; চীনের ও ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক স্বার্থ রয়েছে। ফলে ভারতের পাশাপাশি চীনেরও, বার্মা অ্যাক্টের ফলাফল নিয়ে খোঁজখবর নেয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও এতে দৃশ্যত কোনো ফল আসেনি। অন্তত মিয়ানমারের সামরিক সরকার এবং ১৯৮২-এর নাগরিকত্ব আইন, যতদিন সে দেশে বলবৎ রয়েছে, ততদিন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন প্রায় অসম্ভব। ইতঃপূর্বে ১৮২৩ সালের আগের মূল নাগরিকত্বকে, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনের ভিত্তি ধরা হয়েছিল- যখন বার্মায় রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল।
১৮২৬ সালে প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধে, বার্মার আরাকান : যুদ্ধের ক্ষতিপূরণস্বরূপ, ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময়কেই, বর্তমানে মিয়ানমার (বার্মা) কর্তৃক বেসলাইন ধরা হয়েছে। ওই বছর থেকেই রোহিঙ্গাদের অত্যাচারের মাধ্যমে, বাস্তুভিটা ছাড়া করা শুরু হয়।
মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইনে বর্তমানে বর্মিদের শক্ত অবস্থান থাকলেও, স্থানীয় যুদ্ধরত ইনসারজেন্ট গ্রুপ আরাকান আর্মির (এএ) প্রায় ৩০ হাজারের বেশি সশস্ত্র যোদ্ধা, আরাকানের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত। তাদের ন্যূনতম দাবি স্বায়ত্তশাসন। আরাকান আর্মি প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধাচরণ করলেও, ইদানীং তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) ঘোষণা করেছে যে, তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। তারা এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রত্যাশী। আরাকান আর্মি (এএ) যে, রাখাইনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমাণ হলো, সামরিক সরকার ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির মুখে, ইতঃপূর্বে আরাকান আর্মির সাথে যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল, তা ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে। উল্লেখ্য, ‘আরাকান আর্মি’ একাই নয়, এ সংগঠনের সাথে বৃহত্তর ঐক্য রয়েছে, ‘কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি (KIA)’, ‘কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (KNLA)’, ‘চিন লিবারেশন আর্মি (CLA)’। তদুপরি রয়েছে এনইউজি (NUG) সমর্থিত ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)’। সর্বশেষে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ‘আরাকান আর্মি’, এই প্রথমবারের মতো, ন্যাশনাল ইউনিট গভর্নমেন্টের (NUG) সাথে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। কারণ এনইউজি (NUG) ঘোষণা করেছে, তারা মিয়ানমারকে ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবে এবং সেখানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করবে। জানা যায়, বর্তমানে মিয়ানমারজুড়ে সামরিক সরকারকে, প্রায় ১৪টি বৃহৎ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আরাকান আর্মিকে বাদ দিয়ে সমষ্টিগতভাবে তাদের বলা হয় ‘কে-৩’। কে-৩, পিডিএফ এবং এনইউজির পালে নতুন করে শক্তভাবে হাওয়া লাগিয়েছে বার্মা অ্যাক্ট। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে চীন, ভারত ও জাপান তাদের নিজ নিজ কূটনৈতিক চ্যানেলে আরাকান আর্মির সাথে, তাদের বিদ্যমান বিনিয়োগের নিরাপত্তা রক্ষার আলোচনা শুরু করার তথ্য ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমান বাস্তবতায় রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু মিয়ানমার-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় অবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং রোহিঙ্গা সঙ্কটের ব্যাপ্তি, এখন বহুমুখী। এ পটভূমিতে বলা যায়, দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা সফল হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। চীন তার নিজের তাগিদেই হয়তো এককভাবে মধ্যস্থতা করতে চাইবে। মিয়ানমারের জান্তার প্রয়াস ছিল এবং থাকবে, তাদের ওপর চাপ প্রশমিত করা। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের উচিত বিকল্প কর্মপন্থা কার্যকর করা। বাংলাদেশ সরকারের সামনে কূটনীতি ছাড়া, আরো যেসব পথ খোলা রয়েছে, বর্তমান পর্যায়ে সে পথগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা অতীব জরুরি বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে, এগুলোর মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে :
বিভিন্ন রোহিঙ্গা রাজনৈতিক নেতার (যাদের বেশির ভাগ সে দেশের বাইরে আছেন), ঘোষিত একক সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অরগানাইজেশনকে (এআরএনও) সংহত করে, তাদেরকে ‘আরাকান আর্মি’, ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলও) ও এনইউজির (NUG) সাথে কাজ করানোর লক্ষ্যে, দেশীয় এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত, বর্তমান মিয়ানমারের আওতাধীন ‘মংডু, বুথিডং ও রথিডংয়ের পশ্চিমের বঙ্গোপসাগরের তটদেশ অঞ্চল’ নিয়ে গঠিত ‘মাইয়ুু ফ্রন্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট’ (যেটিকে রোহিঙ্গা বাসভূমি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল) এর আদলেই, ওই অঞ্চলকে ‘স্বায়ত্তশাসিত রোহিঙ্গা অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য, জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্টতায় বহু পাক্ষিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। সর্বোপরি জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্টতাক্রমে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে, এ দেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের, আন্তর্জাতিক সহায়তায় অন্যান্য দেশে পুনর্বাসনের জন্য চাপ অব্যাহত রেখে, তাদের অনুকূলে চলমান জাতিসঙ্ঘসহ অন্যান্য বৈদেশিক সহায়তা অধিকতর বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা। এতে হয়তো বরফ গলা শুরু হতে পারে বলে ধারণা পাওয়া যায়।