Naya Diganta
৪১ শতাংশ মানুষ শিক্ষার বাইরে

অবিশ্বাস্য ব্যর্থতা

৪১ শতাংশ মানুষ শিক্ষার বাইরে

দেশে শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত বয়সের ৪১ শতাংশ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এদের বয়স পাঁচ থেকে ২৪ বছর। জনসংখ্যার হিসাবে এদের সংখ্যা দুই কোটি ৬২ লাখের বেশি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে এমন এক পরিসংখ্যান অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু এটিই সত্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে শিক্ষার উপযুক্ত বয়সের শিশু ও তরুণদের মধ্যে যারা কখনো স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় যায়নি অথবা ঝরে পড়েছে তাদের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে এ পেছনযাত্রা শুধু আমাদের রাজনীতিক বা শাসকদের ব্যর্থতা বলার সুযোগ নেই। বলা যেতে পারে, এটি সার্বিকভাবে জাতিগত ব্যর্থতা। আমরা বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর সবার আগে করণীয়গুলো করতে পারিনি। বৈষম্য আরো বেড়েছে, শোষণ আরো তীব্র হয়েছে, শিক্ষায় সঙ্কোচননীতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
প্রয়োজন ছিল সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং সবার মৌলিক চাহিদা পূরণে সংবিধান ঘোষিত গণতান্ত্রিক অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ ঘটানো। কিন্তু শুরুতে সেসব লক্ষ্য থেকে আমরা পিছিয়ে যাই। নিজেরা নিজেদের ওপর শাসন শোষণের প্রক্রিয়া শুরু করি। স্বাধীনতার প্রথম সাড়ে তিন বছরে আমরা গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ি। গত ১৫ বছরের কথিত গণতান্ত্রিক শাসনে দেশের মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার খর্ব হয়ে এসেছে। গবেষণায় তথ্য পাওয়া গেছে, অর্থনৈতিক দুরবস্থায় জনগণের ৭০ শতাংশ কম খাবার খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যাচ্ছে। অসুস্থ হলে ন্যূনতম চিকিৎসা পাচ্ছে না অনেকে। দেশের শিল্প খাতে সবচেয়ে ভালো অবস্থা তৈরী পোশাক শিল্পের। আসন্ন ঈদে সেই পোশাক শিল্পের অন্তত ৫০০ কারখানা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারবে কিনা এমন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এসবের একমাত্র কারণ সমাজ, রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের ব্যর্থতা।
বিপুল সংখ্যক শিশু ও তরুণের শিক্ষার বাইরে থেকে যাওয়ারও কারণ একই। শিক্ষা নিয়ে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পেছনে মাটি ধসে গেছে। শতভাগ শিশুকে স্কুলে নেয়ার লক্ষ্য পূরণ তো হয়ইনি, উল্টো শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী ৪১ শতাংশ মানুষ বাইরে রয়ে গেছে। আমাদের ৫৩ বছরের অগ্রগতি তাহলে এই!
অথচ শিক্ষা সঙ্কোচনের প্রতিবাদে আমরাই ’৬২ সালে আইয়ুব শাহির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এখনো ছাত্রসমাজ ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন করে শিক্ষার জন্য সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে। তেমনি এক দিবসের আলোচনায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে সেই আইয়ুব আমলের মতোই ‘শিক্ষা সঙ্কোচন’ করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারী এবং এর পরবর্তী বিভিন্ন আর্থসামাজিক কারণে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ পড়ালেখা ছেড়েছে। গত দুই বছরে সে অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। শিক্ষাবিদরা বলছেন, ‘সরকার শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ না নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর বিষয়ে বেশি মনোযোগী। এমন খণ্ডিত পদক্ষেপে বিপদ আরো বাড়তে পারে। যে সমাজ জবাবদিহিশূন্য সেখানে শুধু শিক্ষা নয়, কোনো কিছুতে অগ্রগতি অর্জনের কোনো সুযোগ নেই।