Naya Diganta

আজাইরা

আজাইরা শব্দটির সাথে আমরা মোটামুটি সবাই পরিচিত। ঢাকা অঞ্চলের অধিবাসীদের, বিশেষ করে ঢাকা শহরবাসীর অত্যন্ত পরিচিত এই শব্দটি।
নাটকের সংলাপে হরহামেশাই শোনা যায়, এই শব্দটি। এর সাথে যুক্ত হয় আর একটি শব্দ ‘প্যাচাল’।
‘আরে ওই। আজাইরা প্যাচাল পাড়িস না কইলাম!’
এটা কথাবার্তার একটি নমুনা-সংলাপ।
অর্থ নিশ্চয় বলে দিতে হবে না এর। অবিধানে অবশ্য খুঁজে পাইনি আমি। ‘অপ্রয়োজনীয়’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়।
আমরা বাঙালিরা মোটামুটি কমবেশি ‘আজাইরা প্যাচাল পাইরা’ থাকি। ব্যস্তও থাকি আজাইরা কামে।
ওই যে কোন এক মনিষী বলেছেন- আপনাকে জানতে হবে কখন থামতে হবে- কথা বলার ক্ষেত্রে, কাজের ক্ষেত্রে এবং খাওয়ার ক্ষেত্রে। আমরা এর ব্যত্যয় ঘটাতে সদা তৎপর। আমরা থামতে জানি না।
রাজনীতিবিদদের কথাটাই প্রথমে আসে। তারা কথা বলেন অনবরত। কাজের কথা কতটা বলেন সেটা বিবেচ্য বিষয়। এক বিষয়ে বলতে গিয়ে হাজারটা অনাবশ্যক বিষয় টেনে আনেন এবং শ্রোতাদের বিরক্তির কারণ ঘটান প্রায়ই। এবং চামচা-ভক্তকুলের করতালিতে উৎসাহিত হয়ে অধিকতর ‘আজাইরা প্যাচাল পারেন’।
তবে সব রাজনীতিবিদের একই বন্ধনীভুক্ত করাটা অবশ্য অন্যায় হবে। তাদের অনেকেই সামান্য কটা কথা বলেই একটি পুরো জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন এবং করেছেন- এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন তার বিশ্ববিখ্যাত গ্যাটিসবার্গ বক্তৃতা দিয়েছিলেন মাত্র দুই মিনিটে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি নৃত্যানুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃৃত করার অনুরোধ করলে তিনি কোনো কারণে সময় দিতে অপারগ বলে ক্ষমা চান।
তখন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা তাকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান- ‘গুরুদেব, শুধু দু’টি কথা বলে চলে আসবেন, তবু একবার আসতেই হবে।’
কবিগুরু হেসে বলেছিলেন- নৃত্যবিষয়ে কিছু জানলে তো দু’কথায় সারতে পারতাম। আমি তো কিছুই জানি না, তাই আমাকে এ বিষয়ে বলতে গেলে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কিছু বলতে হবে এবং তাতে প্রচুর সময় লাগবে।
তাহলে বোঝা গেল, নির্দিষ্ট বিষয়ের জ্ঞানের গভীরতা স্বল্প হলে আমরা বেশি বকি। আজাইরা কথা বলি।
ক’দিন আগেই দেখলাম এক মন্ত্রী মহোদয় তার দলের মানুষদের (বিরোধীদেরও) পরামর্শ দিলেন- কথা বেশি বলবেন না- বেশি কথা বললে বাজে কথা বলতে হয়। বাজে কথা দেশের মানুষ পছন্দ করে না।
একেবারে খাঁটি কথা। কিন্তু মানছে কে?
এই ফাঁকে আমি বরং একটা আজাইরা গল্প শোনাই আপনাদের-
দশ বছরের লাল্টু এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করে-
‘বাবা আমি কোথা থেকে এসেছি’?
এ প্রশ্নে বাবা ভীষণ বিব্রত। মনে মনে তিনি শঙ্কায় ছিলেন পুত্রধন কবে আচমকা এমন বিব্রতকর প্রশ্ন করে বসে। তিনি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন-
‘দেখ পৃথিবীটার জন্ম হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছায়। এর মাটি, পানি, বাতাস, আলো, নদী, পাহাড়, সমুদ্র, সূর্য, তারা, চন্দ্র, গাছপালা, কীটপতঙ্গ সবই আল্লার সৃষ্টি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বললেন-হও। সব হয়ে গেল। পৃথিবীর আদি মানুষ হজরত আদম, বিবি হাওয়া, জন্তু-জানোয়ার সব-সব কিছুই আল্লার সৃষ্টি, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া একটি গাছের পাতাও নড়ে না-বাবাকে থামিয়ে দিয়ে ছেলে বলে-
‘আজাইরা প্যাচাল পারো কেন বাবা। আমি জানতে চেয়েছি আমি কোথা থেকে এসেছি!
বাবা আরো বিব্রত। থতমত খেয়ে বলেন- ‘হটাৎ এ প্রশ্ন কেন করছো বাবা ধন?’
ছেলের উত্তর, রেল কলোনির খোকন বলছিল ওরা বর্ধমান থেকে এসেছে তাই আমারটা জানতে চাচ্ছিলাম।
বাবা হ্যাঁ!
আমার আজাইরা প্যাচালের ইতি।