Naya Diganta
দি ব স

দূষণমুক্ত পানির বিকল্প নেই

দি ব স

আজ ২২ মার্চ শুক্রবার বিশ্ব পানি দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা প্রদানসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও পানি দূষণ কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে পানি এবং টেকসই উন্নয়ন একে-অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পানি ছাড়া যেমন আমাদের জীবন অচল; তেমনি জলবায়ু ও প্রকৃতি- যা আমাদের জীবন ও জীবিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্যও পানি অপরিহার্য। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিণত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নকার্যক্রম চলমান রয়েছে। পানির অপর নাম জীবন। জীবন বাঁচাতে পানির কোনো বিকল্প নাই। এক চুমুক পানির জন্য জীবন বাজি রাখতেও প্রস্তুত। এ প্রতিযোগিতা এখন বর্তমান বিশ্বের দৈনন্দিন দৃশ্য। পানি সমস্যার সমাধানকল্পে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে রাষ্ট্রসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিইডি) এজেন্ডা ২১-এ প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। এর পর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা বাড়বে ৪০ শতাংশ। এখন যে পরিমাণ পানি আছে, তাতেই আমাদের প্রচণ্ড হাহাকার। ফলে নতুন করে বিশুদ্ধ পানি কোথা থেকে আসবে, তা কেউ জানে না। বিদ্যমান পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার আর পানির অপচয় রোধ করেই আমাদের এগোতে হবে। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয় ৯০ শতাংশের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ভূ-উপরস্থ পানিতে ফেলা হয়। এর অর্থ আমাদের ভূ-উপরস্থ পানি শিল্পবর্জ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের শহর এলাকায় অর্ধেকের বেশি মানুষ বস্তিতে বসবাস করবে, যেখানে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা থাকবে না। বিশ্বের ৮৮৪ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ খাওয়ার পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন লোক বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পানির অধিকার এবং পানির কথা আমরা বলি। এখানে সাম্য প্রতিষ্ঠা একটি বড় ব্যাপার, যা বাংলাদেশ এবং বিশ্ব বাস্তবতায় একইভাবে প্রযোজ্য।
আমরা নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি চোখে দেখা যায় না বলে পানি বললেই মানুষ সাধারণত নদ-নদীর পানিকে বোঝে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের অনেক বেশি নির্ভরতা। পানি রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সুরক্ষার কথা বলতে গেলে সবাই শুধু নদী রক্ষার কথা বলে। দৃশ্যমান হওয়ায় নদীর পানির বিষয়টি দ্রুত আমাদের সামনে আসে সত্য। কিন্তু কৃষি, সুপেয় পানি ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের নির্ভরতা অনেক। অথচ ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণে আমরা একেবারেই মনোযোগী নই। আন্তর্জাতিক নদী বিশ্বের ৬০ শতাংশ মিঠা পানির চাহিদা পূরণ করে। ১৪৫টি আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের শুধু ঢাকাতেই ওয়াসার গভীর নলকূপ আছে এক হাজার। আর বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের রয়েছে সাত হাজার। প্রতি বছর তিন মিটার করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। খরায় আক্রান্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর। ঢাকায় প্রতিদিন পানির চাহিদা প্রায় ২৫০ কোটি লিটার এবং এটি বাড়ছে। দেশের উপকূলীয় এলাকায় একজন মানুষকে পানি সংগ্রহের জন্য গড়ে ২ ঘণ্টা হাঁটতে হয়। আর মোট আয়ের ২৫-৩০ শতাংশ খরচ হয় শুধু পানির জন্য। তার পরও উপকূলীয় এলাকার ২৩ শতাংশ মানুষ লবণাক্ত ও অনিরাপদ পানি পান করে।
জাতিসঙ্ঘের এক গবেষণায় উঠে এসেছে ৭৪ শতাংশ পানি সংগ্রহের কাজ নারীরা করেন। ৬৩ শতাংশ মানুষের খাওয়ার পানি পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ৭৫ শতাংশ মানুষ হ্যান্ড টিউবওয়েলের ওপর নির্ভর করে, যদিও অনেক এলাকায় সেগুলো থেকে ঠিকমতো পানি মিলছে না। প্রায় ৪১টি জেলায় আর্সেনিকের প্রভাব রয়েছে। কেবল ৩৪ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়। খুব রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলেও দেখা যায়, উপকূলের মানুষ পানি পেতে ঢাকার মানুষের চেয়ে চার গুণ বেশি অর্থ খরচ করে। ৭০ শতাংশ বস্তিবাসীর পানি পাওয়ার বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। সরকার পানির জন্য যত অর্থ ব্যয় করে, তার ৮০ শতাংশই খরচ করে শহরের মানুষের জন্য। কৃষি খাতে পানি বেশি অপচয় হয়। সমুদ্রের আগ্রাসনের জন্য আমাদের সুপেয় পানির অনেক আধারই লবণাক্ত হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে এটি আরো বাড়বে।
দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুপেয় পানির বড় সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে জলাভূমি হারানোর হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। যদিও সংবিধানে জলাশয় রক্ষাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা রয়েছে। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে উচ্চ আদালতে রায় হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করে নদ-নদী ও জলাশয়ের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। ভূমি দখলকে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে এ রায়ে। তার পরও নদী দখল থেমে নেই। দখলদারদের উচ্ছেদে সরকারের দৃশ্যত উদ্যোগ নেই। উপকূলীয় এলাকা, দক্ষিণাঞ্চল ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সঙ্কট প্রকট। এ তিন অঞ্চলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। উপকূলীয় এলাকার জন্য অবশ্যই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কথা ভাবতে হবে। ডিপ টিউবওয়েল নিরুৎসাহিত করতে হবে। জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ই-মেল : drmazed96@gmail.com