Naya Diganta

মানুষ অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে

মানুষ অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে

রোজা বা সিয়াম ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। রোজা পালনের উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া অর্থ খোদাভীতি। আল্লাহর ভয়ে সব মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। সংযম অবলম্বন করা। এই পুণ্যটি হাসিলে যৎসামান্য পণ্য বা অর্থের বিষয় আছে। তবে এ খরচ মোটেই ইসলামের আরেক স্তম্ভ হজ পালনের ধারে কাছে নয়। পরিমাণে অনেক কম। ইফতার-সাহরিতে বুট ছোলা খেজুর, যথাসম্ভব কিছু ফলফলাদি আর মাছ-গোশতের ব্যবস্থা থাকলে ভালো। এরপর ঈদ ঘনিয়ে এলে কিছু পোশাক পরিচ্ছদ কেনা, ভালো খানাপিনার আয়োজনের বিষয় আছে। রোজা রমজানের এই পণ্য-বিষয়ক চাহিদাটিকেই মওকা হিসেবে নিয়েছে ধড়িবাজরা। এটি তাদের কাছে লক্ষ্য নয়, একদম উদ্দেশ্য। যাবতীয় অরাজকতা ও বাজারে আগুনের ফের এখানেই।

মাহে রমজান ও রোজার ফজিলত নিয়ে বহু বর্ণনা রয়েছে ধর্মগ্রন্থে। বলা হয়ে থাকে, এ মাসে কবরের আজাব বন্ধ থাকে। এ মাসে শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয় বলেও কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতিসহ নানা বয়ান আছে। প্রশ্ন আসে, তাহলে এ মাসে শয়তানি কাণ্ড কে করে? কে করায়? অল্প বা স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধিতে এর জবাব মেলে না। রোজার ধর্মীয় গুরুত্বের সাথে সামাজিক ও মানবিক অনেক গুরুত্ব জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রমজান উপলক্ষে বড় বড় চেইনশপ থেকে শুরু করে ছোট দোকানে দেয় বিশাল বিশাল ছাড়। কে কত বেশি মূল্যছাড় দিতে পারে তা নিয়ে চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় ছাড়ের মাত্রা কখনো কখনো ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। মূলত রোজাদারের অর্থকষ্ট লাঘবের পাশাপাশি অধিক সওয়াবের আশায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসে এমন ছাড় দেন বিক্রেতারা। ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর ঘোষণা এবং সেগুলোর মূল্য তালিকা দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সংস্কৃতি কেবল মুসলিম নয়, অন্যান্য ধর্ম-অধ্যুষিত দেশেও।

অন্যসব ধর্মের লোকেরা রমজান মাসকে শ্রদ্ধা-সমীহ করে। নৈতিক-অনৈতিক বাছ-বিচার করে। অনাহারী-অভাবী প্রতিবেশীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। অতি মুনাফার মোহ সংবরণ করে। বিভিন্ন দেশ তাদের ধর্মীয় উপলক্ষ কিংবা উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমানোর ঘোষণা দেয়। এসব উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছাড়ের হিড়িক পড়ে। মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয় উৎসব। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়েও রমজান উপলক্ষে অনেক দেশে পণ্যসামগ্রীর দাম কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়। অমুসলিম দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো ধর্মীয় উৎসবের সময় দ্রব্যমূল্য বাড়ে না, রমজানে দেয়া হয় আরো বেশি ছাড়। রমজানের শুরুতে পণ্যে ছাড় দেয়া ইউরোপের দেশগুলোতে রীতিতে পরিণত হয়েছে। জার্মানিতে চলে অভাবনীয় মূল্যছাড়। ফ্রান্সেও। আমাদের কাছের দেশ থাইল্যান্ডেও রমজান মাস উপলক্ষে মুসলমানসহ সবার জন্য পণ্যে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা তাদের আগের মুনাফা থেকে ছাড় দিয়ে ব্যবসায় করেন। পণ্যের দাম না বাড়িয়ে সেখানে কমিয়ে দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী লাভবিহীন পণ্য বিক্রি করেন মাসজুড়ে।

সম্প্রীতি-বন্ধন ও সহনশীলতা বাড়াতে তারা এমন উদ্যোগ নেন। এর ঠিক উল্টা চিত্র বাংলাদেশে। রমজান মুসলমানদের ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস বলা হলেও মুসলিমপ্রধান এ দেশটির বাস্তবটা বড় নিষ্ঠুর। অনৈতিক চর্চা মারাত্মক পর্যায়ে। একটি চক্র থাকেই রমজানের অপেক্ষায়। শয়তানি কাণ্ডের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। তবে কি মাসটিতে শয়তান কোনো না কোনোভাবে ফাংশন করে? সরকারের এত চেষ্টা ধমক-অভিযানের পরও শয়তান বা তাদের অনুসারীদের কারসাজি কেন বেশি টেকসই বাংলাদেশে? বছরের বাকি ১১ মাস কোপ মারলেও রমজানের এক মাসে তারা একেবারে জবাই করে ছাড়ছে। কেউ তাদের রুখতে পারে না। রোজার আগ থেকেই কোমর বেঁধে নামে তারা। পণ্যের দাম বাড়ানোর যাবতীয় ছলাকলা, কৌশল, যুক্তিসহ যাবতীয় পরিবেশ তারা নিশ্চিত করে ছেড়েছে এবারো। কিছু পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির বন্দোবস্ত তারা আগেই করে রেখেছে। বাজারে পণ্যের সঙ্কট তৈরি করেছে দক্ষতার সাথে। বড় থেকে ছোট, মহল্লার মুদিদোকানেও শয়তানি কাণ্ড চলছে হরদম। অনেকের আবার মুখে দাড়ি এবং মাথায় টুপিও থাকছে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে পবিত্র মাসে এমন শয়তানি কর্মের ফের একেবারে অবুঝের বিষয় নয়। অন্য ধর্মের চতুর লোকদেরও দায়ী করার সুযোগ নেই। দেশে ব্যবসায়ীদের ৯০ শতাংশেরও বেশি মুসলমান, মুসলমান হয়েও পুণ্যের মাসে অপুণ্যের এমন কাজ তারা করছেন। করে আসছেন। এবার আরেকটু বেশি করছেন। বাকি ১১ মাসেও এই চর্চায় তারা কমতি দেবেন? অথচ রমজানের এক মাস বাকি ১১ মাসের নৈতিকতা ও সংযম চর্চার রিহার্সাল টাইম। বাস্তবে চলে এক আচানক রিহার্সাল। এই চক্রের কাছে রহমত, মাগফিরাত, নাজাত অবান্তর বা কথার কথা। আসল কথা রমজানে পেঁয়াজ, ছোলা, সয়াবিন তেল, চিনি, খেজুরসহ অন্যান্য ফল, ডাল, মুড়ি, আলু, বেগুন, ইসবগুল, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা, লেবু, পুদিনা পাতা ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

এবার এই চক্র রোজার আগেই এসব পণ্যের দাম বাড়ানোর যাবতীয় ব্যবস্থায় শতভাগ সফল। রমজানের দেড়-দুই মাস আগেই ছোলা খেজুরসহ নিত্যপণ্যের দাম তারা বাড়িয়ে রেখেছেন। প্রতি বছর রোজার মাসে বেশি চাহিদা থাকে তেল, চিনি, ছোলা, আদা, ডাল, খেজুর প্রভৃতি পণ্যের। রমজান মাস শুরুর প্রায় দুই মাস আগে থেকেই এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্য নিত্যপণ্যের দামেও ঊর্ধ্বগতি। উদ্বেগ বাড়ছে নি¤œ আয়ের মানুষের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানির দাম, ডলার ও এলসি সঙ্কটে দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই। বাজার পরিস্থিতি যাই হোক, এবারো রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মহল। কিন্তু রমজান শুরুর আগেই দ্রব্যমূল্যের আগাম ঊর্ধ্বগতির কারণে এমন আশ্বাসে ভরসা নেই জনগণের। তারা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের মতো এ রমজানেও অসাধু ব্যবসায়ী চক্র পুরোনো ছকে চলছে। রমজাননির্ভর পণ্যের দাম তারা আগেই বাড়াতে শুরু করে। আবার রমজানেও নতুন করে আরেক দফা বাড়ানো হয়। পণ্যের কোনো ঘাটতি না থাকলেও বেশির ভাগ পণ্যের দাম আগের বছরের তুলনায় বাড়িয়ে মানুষের গলা কাটা হচ্ছে।

সাধারণত রজমানের শুরুতে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই ভোগ্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ সময় দামও বেশ বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর দেখা যায়, রমজান শুরু হওয়ার বেশ আগেভাগেই বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। অথচ রমজানে দ্রব্যমূল্য যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে জন্য গত জানুয়ারিতে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চাল, চিনি, তেল ও খেজুরের আমদানি কর কমিয়েও দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবটা বড় বেদনার।

নৈতিকতা বা ধর্মের ভয়ে এখন বাজারে চলমান দর অর্ধেক করে দিলেও তাদের লস হবে না। কিন্তু সেই পথে যাওয়ার মর্দে মদন নন তারা। কাওরানবাজারসহ কিছু বাজারে এবার অতি সাধারণ জাতের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৫০০-১১০০ টাকা কেজিতে, যা গত রমজানে ছিল ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এবার পেঁয়াজের দাম ১৫৭ শতাংশ, আলুর ৫৪ শতাংশ, রসুন (আমদানি) ৬০ শতাংশ, আদা (দেশী) ৮২ শতাংশ বেড়েছে। পেঁয়াজু তৈরিতে ব্যবহৃত খেসারি ডালের দাম ১২০ টাকা কেজি, যা গত বছর ছিল ৮০ টাকা। এ ছাড়া ছোলার বেসন কেজিপ্রতি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ১১০ টাকা। ফল-ফলাদি, মসলাপাতির দামেও এ দশা। তাদের ঠেকায় কে? ওদেরও মতিগতি- পারলে ঠেকা। তাদের হাতে নানা অজুহাত। কড়া সব যুক্তি। ব্যবসায়ীদের দাবি, বৈশ্বিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কটে এলসি খোলায় সমস্যার কারণে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। বাধ্য হয়ে তারা পণ্যমূল্য সমন্বয় করছেন। অস্বাভাবিকভাবে কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে না বলে দাবি তাদের।

অথচ, পণ্যের দর মানুষকে এখন ঘুমে নয়, সজাগেও আঁতকে তুলছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে সবার। কিন্তু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। ঘরে বা চার দেয়ালের মধ্যে হাপিত্যেস করা ছাড়া কিছুই যেন করার নেই, প্রকাশ্যে নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। নেই প্রতিবাদ। তার মানে কি মানুষ সব মেনে নিচ্ছে? নাকি তারা অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে!

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি মনে করেন, সব মিলিয়ে দেশে একটি নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে টিসিবির কার্যক্রমের বাড়ালে সার্বিক বাজার পরিস্থিতিতে তেমন কোনো ফল না হলেও অন্তত কিছু মানুষ এতে উপকৃত হবে। এ ছাড়া পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, সরবারহ সঙ্কট, উৎপাদন কম হওয়া, ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দেশের বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। তা ছাড়া আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়লে ট্যাক্সের পরিমাণও বেড়ে যায়। এতে বাজারের অন্যান্য পণ্যের দামেও প্রভাব পড়ে। এ অবস্থায় সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকে। বেশি জোর দিতে হবে মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে, যাতে মানুষের আয়-রোজগার বাড়ে।

রোজায় বাজারদরের এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশ ব্যাংক তা রোখার চেষ্টা করেও পারছে না। সামনে মূল্যস্ফীতি আরো কোন দিকে যাবে বা যেতে পারে, তা বুঝতে মস্ত বড় অর্থনীতিবিদ হওয়া জরুরি নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত, তা কিনতে এবার ফেব্রুয়ারিতে লেগেছে প্রায় ১১০ টাকা। একই সময়ে মানুষের আয়ও বেড়েছে।
ন্যায্যমূল্যের দ্রব্য বিক্রির গাড়ির পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন কিংবা তা ধরার জন্য প্রাণপণ দৌড় দেখে কে বলবে, এ দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অথচ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধকলেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে মানুষের আয়ের আসল চিত্র। যদি সত্যিই আয় বেড়ে থাকে তাহলে মানুষ কেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ নিতে পারছে না?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com