Naya Diganta

গাজার রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে বিশ্বকে

গাজার রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে বিশ্বকে

ইসরাইলি সশস্ত্রবাহিনী গাজায় ‘এথনিক ক্লিনজিং’ চালাচ্ছে। গত ৭৫ বছর ধরে তারা আক্রমণ, হত্যা, জেল, নির্যাতন ও আগ্রাসনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে। ফিলিস্তিনিদের প্রাণের স্পন্দন মসজিদে আকসাকে অপবিত্র করছে। এমন যুদ্ধাবস্থার মধ্যে হামাস গত ৭ অক্টোবর একটি পাল্টা আক্রমণ করে। ইসরাইলি বাহিনী প্রতিশোধের অজুহাতে পুরো ফিলিস্তিনি জাতিকে নিধন করে তাদের শেষ আবাস গাজা দখল করতে চাচ্ছে। বিশ্ববাসী বিশেষ করে পশ্চিমারা গাজাবাসীর এই জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়ায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পুরো মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো নির্লিপ্ত; দু’-একটি দেশ ছাড়া। ইসরাইলের এই নৃশংসতার সরব সমর্থক আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকার মূল্য বিশ্বকে দিতে হবে! গাজাবাসীর রক্তের এই ঋণ বিশ্বকে পরিশোধ করতে হবে হয়তো চরম মূল্যে ।

ইসরাইলি সশস্ত্রবাহিনীর নৃশংসতা পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত সব সংঘর্ষের নির্মমতাকে হার মানিয়েছে। গত তিন মাসের হামলায় তারা ১০ হাজার শিশু, সাত হাজার নারী, অসংখ্য অন্তঃসত্ত্বা মাকে হত্যা করেছে। দিনে ১০টি শিশু পঙ্গুত্ব বরণ করছে। কত শিশু-নারী যে, বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে তার হিসাব নেই। গাজার প্রায় সব হাসপাতালে বোমা মেরে ধ্বংস করে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। বস্তিগুলোতে বিমান হামলা করে শত শত মানুষকে কয়লা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। মসজিদ, গির্জাও ধ্বংস করা হয়েছে অসংখ্য। প্রায় ১৫০ জাতিসঙ্ঘ কর্মী এবং শতাধিক সাংবাদিককেও হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট, জ্বালানি ইত্যাদি পুরোপুরি বন্ধ করে সর্বাত্মক অবরোধ করে রাখা হয়েছে গাজাকে। ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট একটি জায়গা অবরুদ্ধ করে ২৬ লাখ মানুষের ওপর ৯০ দিনে ৬৫ হাজার টন বোমা ফেলা হয়েছে। পুরো গাজাকে পোড়ামাটিতে পরিণত করছে। গাজা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১১৩৯ জন ইসরাইলি হত্যার বিপরীতে ইসরাইলি বাহিনী সাড়ে ২৩ হাজার ফিলিস্তিনি হত্যা করেছে এবং ৫৯ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করেছে। নিখোঁজ রয়েছে আরো সাত হাজার মানুষ। (প্রথম আলো, ৭ জানুয়ারি ২০২৪)
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মানবাধিকারের স্বঘোষিত বিশ্ব অভিভাবক যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমারা ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার আগ্রাসনে মাঝে মধ্যে ইউক্রেনের সেনারা নিহত হলে তাদের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। আর ইসরাইলি সশস্ত্রবাহিনীর সেনারা হায়েনার মতো আক্রমণ চালিয়ে প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি শিশু-নারী ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করলে সেটি হয় ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার! জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মার্কিনিরা বারবার ভেটো দিয়ে নিস্ক্রিয় করে দিচ্ছে। ইসরাইলে বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ, লজিস্টিক ও বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষক পাঠিয়ে সরাসরি হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত হচ্ছে।

ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর নির্বিচার নিধনযজ্ঞের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। গাজাবাসীর রক্তের ঋণ ব্যাপক মূল্য দিয়ে পরিশোধ করতে হবে পুরো বিশ^কে। এই যুদ্ধ চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক, ইরানের মতো মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে এই যুদ্ধে। স্পষ্টত ইসরাইল নিজের নিরাপত্তায় শঙ্কিত হয়ে এই দেশগুলোকে বিশেষ করে সিরিয়া, লেবানন ও ইরানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই জড়াচ্ছে। হামাসের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় গাজায় হত্যাযজ্ঞ শুরুর সময় থেকেই ইসরাইলি বাহিনী সিরিয়ায় হামলা জোরদার করেছে। লেবাননের হিজবুল্লাহর ওপরও ‘প্রিএম্পটিভ’ আক্রমণ করেছে বারবার। সম্প্রতি লেবাননে ড্রোন হামলা চালিয়ে হামাসের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সালেহকে হত্যার মাধ্যমে ইসরাইল হিজবুল্লাহকে চরম উসকানি দিয়েছে। হিজবুল্লাহও পাল্টা সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে ইসরাইলকে। হামাস এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের সাথে শান্তি আলোচনা স্থগিত করেছে। তারা যেকোনোভাবে ইসরাইলের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। ইতিহাস বলে, ‘ননস্টেট অ্যাকটরের’ প্রতিশোধ হয় অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর কোনো নির্দিষ্ট স্থান-কাল-টার্গেট থাকে না! হামাসের হারানোর কিছু নেই! তাদের যোদ্ধারা মৃত্যুর জন্য সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। ফিলিস্তিনিরা তো বেঁচে থেকেও মরে আছে! কাজেই তাদের প্রতিঘাত হতে পারে ভয়ঙ্কর যার মূল্য ইসরাইল রাষ্ট্র এবং তাদের সহযোগীদের অত্যন্ত বিয়োগান্তভাবে দিতে হতে পারে। ইতোমধ্যেই ইয়েমেনের হুথি সম্প্রদায় ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা লোহিত সাগরে ২০টি ইসরাইল সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক জাহাজে ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন আক্রমণ করে হামাসের সাথে একাত্মতার জানান দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তার জন্য মার্কিন নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কাসহ ২২টি দেশ অপারেশন প্রসপারিটি গার্ডিয়ান নামক অভিযানের নামে যৌথ নৌটহল ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশে^র ১৫ শতাংশ বাণিজ্য এই পথে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সম্প্রতি মার্কিন নৌটহল চারটি হুথি গোষ্ঠীর আক্রমণকারী নৌকায় হামলা চালিয়ে ১০ জন হুথি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। এভাবে এটি স্পষ্ট যে, হুথিদের সাথে পশ্চিমারা সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল।

জানা যায়, ইয়েমেনে হুথিদের ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খসড়া পরিকল্পনা প্রস্তুত করে ফেলেছে। (নয়া দিগন্ত, ৬ জানুয়ারি ২০২৪) ইয়েমেনে মার্কিন যেকোনো আক্রমণ পুরো আরববিশ্বকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে। এদিকে, যুক্তরাজ্যও হুথি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপত্তার নামে পশ্চিমা নৌসেনাদের আনাগোনায় ইরান নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং এলাকায় তাদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। এতে যেকোনো সময় দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়ে পড়তে পারে। এর পরিণতি ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের সাথে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর লাগাতার রকেট হামলা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ইরাক ও সিরিয়ার মার্কিন লক্ষবস্তুসমূহে শতাধিক হামলা হয়েছে। (ডেইলি স্টার, ৫ জানুয়ারি ২০২৪) এসব হামলায় মার্কিনিদের ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিনিরা বাস্তবিক পক্ষেই সমূহ হুমকির মুখে পড়েছে।

গাজার গণহত্যা বন্ধে জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে বিশ্ব সংস্থাটি মাত্র তিন মাসে ১০ সহস্রাধিক শিশুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সেই সংস্থার প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব গুতেরেস গত বছর ৭৭তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ভাষণে নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘লক্ষ্য অর্জনের বদলে আমরা একে অন্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমনভাবে জড়িয়ে গেছি যে, সংস্থাটি তার চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।’
(প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩) কাজেই এই বিশ্বসংস্থাটি দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। অথবা শুধু পশ্চিমাদেরই একটি বাফার সংস্থা হিসেবে টিকে থাকতে হবে। একই সাথে ‘ওআইসি’ একটি ঠুঁটো জগন্নাথ সংস্থায় পরিণত হয়ে আরো অকার্যকর হয়ে পড়বে। এই সংস্থাটি মুসলিম বিশ্বের যৎসামান্য আস্থাটুকুও হারাতে বসেছে।

ইসরাইলি বাহিনীর চলমান এই গাজা ধ্বংসযজ্ঞে ধীরে ধীরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ^ জড়িয়ে পড়ার সুবাদে রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের আক্রমণ জোরদার করেছে। ইতোমধ্যেই পশ্চিমা মনোযোগ ইউক্রেন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সরে আসায় ইউক্রেনে সামরিক প্রতিরোধ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ, ইসরাইলকে সহযোগিতা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেনে সাহায্য করার তহবিলে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হয়তো বা ২০২৪ সালেই ইউক্রেনের পরাজয় ঘটতে পারে। অন্যদিকে চীনও তার তৎপরতা জোরদার করেছে দ্রুত তাইওয়ানকে একীভূত করার প্রয়াসে। এসব সত্য প্রমাণিত হলে হয়তো বা পৃথিবী আবার দ্বিমেরুর বিশ্বব্যবস্থা দেখা পেতে পারে যখন অপর মেরু চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে থাকতে পারে। এমনটি ঘটলে বিশ্বব্যাপী একনায়কত্ব, ফ্যাসিজম ও স্বৈরতন্ত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

ইসরাইলি সশস্ত্রবাহিনীর নৃশংসতাকে ‘আত্মরক্ষার’ অধিকারের আড়ালে সমর্থনের অপরাধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নৈতিক ভূমি হারাতে পারে বিশ্বব্যাপী। মানবাধিকারের বিষয়ে তাদের দ্বৈতনীতি ও বর্ণবাদী চরিত্র পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ফলে মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার প্রতি ঢালাওভাবে ঘৃণার সৃষ্টি হতে পারে। এমন পটভূমিতে আরো নতুন কোনো চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান হতে পারে। আইএস, আল-কায়েদা, আল-শাবাব, বোকো হারাম ইত্যাদি চরমপন্থী গোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ বিশ্ব অনেকবার দেখেছে। গাজাবাসীর হত্যাযজ্ঞ ও মানবতার চরম অবমাননার পটভূমিতে নতুন কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিশোধ গোষ্ঠীর জন্ম হলে তার দায়-দায়িত্ব ইসলামের ওপর চাপানো যাবে না। যেকোনো ধর্মের মানুষের এমন দুরবস্থায় সংশ্লিষ্ট ধর্মের মানুষগুলো প্রতিশোধে এগিয়ে আসে। এটি স্বাভাবিক মানবিক প্রক্রিয়া। কাজেই ইসরাইল বিশ্বকে আরো একটি চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। গাজায় মানবিক বিপর্যয়ে মুসলিম বিশে^র সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানরা নির্বাক দর্শক থাকলেও সাধারণ মুসলিম জনতা এর প্রতিবাদে মুখরিত করেছে রাজপথগুলো। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এই প্রতিবাদ অত্যন্ত তীব্র ছিল। জনগণের চাপে রাষ্ট্রগুলো কিছু কিছু প্রতিবাদী বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু তারা অত্যন্ত ভয়ের সাথে দিনাতিপাত করছে। কারণ, এই ফিলিস্তিনি নিধনপ্রক্রিয়া যেকোনো সময় দ্বিতীয় আরব বসন্তের সূত্রপাত করতে পারে। এসব ঘটলে, হবে ব্যাপক রক্তপাত আর নাগরিক হত্যাযজ্ঞ। মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোনো ব্যাপক সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো আরো বিপাকে পড়বে। বৈশ্বিক বাণিজ্য সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। ধনী দেশগুলোর অর্থের বিশাল অঙ্ক অস্ত্র কেনাবেচা এবং যুদ্ধ পরিচালনার খাতে প্রবাহিত হবে। ফলে বিশ^ব্যাপী খাদ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। সব মিলে মনে হচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনের রক্তের ঋণ বিশ^কে অনেক মূল্য দিয়ে শোধ করতে হবে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com