Naya Diganta
সমকালীন প্রসঙ্গ

পাখির চোখে ২৮ অক্টোবর

সমকালীন প্রসঙ্গ
পাখির চোখে ২৮ অক্টোবর

২৮ অক্টোবরের কালো অধ্যায় নিয়ে আপনি যদি কিছু লিখতে চান তবে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন দিনটি নিয়ে লিখবেন। অর্থাৎ ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর নাকি ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর। দুটোই কালো দিবস। একটির কলঙ্ক ইতিহাসে নির্ধারিত হয়ে গেছে এবং অপরটির কালিমা ২০২৩ সালের ২৮ তারিখের পর থেকে ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। আপনারা যারা চলমান কলঙ্ক দেখেছেন এবং আদি কলঙ্ক সম্পর্কে শুনেছেন তাদের সদয় অবগতির জন্য দুই কলঙ্কের মহামিলন প্রেক্ষাপট ও ফলাফল নিয়ে আলোচনার জন্যই আজকের শিরোনামটি।

আপনাদের মতো আমিও অতীতের লগি-বৈঠার তাণ্ডব সম্পর্কে জানতাম। কিন্তু কলঙ্কময় সেই দুর্ঘটনাটি যে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর হয়েছিল তা ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে লগি-বৈঠার সেই ট্র্যাজেডির নেপথ্যে আওয়ামী লীগের আন্দোলন বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক প্রধানরূপে প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মেনে না নেয়ার দাবি ছিল অন্যতম কারণ। সারা দেশ ছিল উত্তপ্ত, রাজপথে বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢল এবং ক্ষমতাসীনদের অনড় অবস্থার মধ্যেই ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে ২৮ অক্টোবর ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ সরকারি কর্মদিবস। দিনটিকে নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের জেদাজেদির ফলে ঢাকার পল্টন ময়দান-পুরানাপল্টন ও নয়াপল্টন এলাকায় আওয়ামী লীগ-জামায়াত এবং বিএনপি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শনের যে চেষ্টা করেছিল তার ফলে- একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়, যা কি না ইতিহাসে লগি-বৈঠার যুদ্ধরূপে কুখ্যাতি পেয়েছে।

লগি-বৈঠার প্রথম যুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের পতন হয়েছিল আর জিতেছিল আওয়ামী লীগ। সেই যুদ্ধের ভয়াবহ সেসব দৃশ্য আজও মানুষকে যেভাবে আতঙ্কিত করে- তা বাংলার শত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষকে বিষাক্ত সাপের মতো লাঠিপেটা করে মেরে ফেলা- মৃত ব্যক্তির লাশের ওপর সদলবলে পুনরায় লাঠিপেটা করে মনের ঝাল মেটানো এবং লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করার দৃশ্য কে কবে দেখেছেন কিংবা শুনেছেন তা আমি বলতে পারব না। তবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার পুরানা পল্টন মোড়ের আকাশ-বাতাস-মাটি-বৃক্ষ-লতা দুনিয়া ও আখিরাতে লগি-বৈঠার যে তাণ্ডব হয়েছিল তা নিয়ে যে মহান আল্লাহর দরবারে অঝোরে কেঁদে কেঁদে অমানুষদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, তার ইঙ্গিত আমি পেয়েছি ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর।

২০০৬ সালের মতো ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরও আওয়ামী লীগের বিজয় দৃশ্যমান। তবে অতীতের চেয়ে চলমান সহিংসতায় আওয়ামী লীগ যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তা যদি ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধজয়ী তিন মহানায়ক যথা- সম্রাট বাবর, সম্রাট আকবর ও বাদশাহ আহমদ শাহ আবদালী জানতে পারতেন তবে নিশ্চয় তারা পুনরায় যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করে সবচেয়ে কম খরচে বেশি মুনাফা হাসিলের উদ্দেশ্যে অনেকের ছাত্র হওয়ার জন্য নিজ নিজ দেশ থেকে হিজরত করে ২৮ অক্টোবরের নায়কদের পদধূলির জন্য বঙ্গদেশে আসতেন।

পানিপথের যুদ্ধগুলো ছিল বলতে গেলে অসম। একপক্ষের ঝুলিতে ছিল জনসমর্থন, বিপুল সেনাবাহিনী ও দেশমাতৃকা রক্ষার সর্বোচ্চ আকুতি। আর অন্যপক্ষের হাতে ছিল অভিনব মারণাস্ত্র, ব্যতিক্রমী যুদ্ধকৌশল, দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের প্রণোদনা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়াবহ ও দানবীয় নৃশংসতা। ফলে বিজয়ীরা প্রকৃতির অভিশাপে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন। শত জলুস-ক্ষমতা-বিত্ত-বৈভবের পাহাড় এবং রাজমুকুটে কোহিনূরের ঝলকানি যে তাদেরকে সুখী করতে পারেনি সেই কাহিনী লিখতে গেলে একটি বড়সড় উপন্যাস হয়ে যাবে। সুতরাং আলোচনা সে দিকে না নিয়ে বরং পানিপথে কেন পরপর তিনটি যুদ্ধ হয়েছিল এবং হাজার বছরের রাজনীতির ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধ কেন এত আলোচিত তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে ২৮ অক্টোবর প্রসঙ্গে চলে যাব।

ঐতিহাসিক পানিপথের প্রান্তরটি বর্তমান ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে অবস্থিত। স্থানটির ভৌগোলিক গুরুত্ব এবং এই স্থানে সংঘটিত তিনটি মর্মান্তিক যুদ্ধ ভারতের সর্বকালের ইতিহাসকে তিনবার সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছিল। পানিপথের যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর যুদ্ধ পৃথিবীতে হয়েছে। ওয়াটার লু, গাওঝে মেলা, পিরামিডের যুদ্ধের মতো অসংখ্য যুদ্ধ রয়েছে যেগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব পানিপথের চেয়ে বেশি। কিন্তু পানিপথের প্রান্তরে যেভাবে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে সেভাবে মানবজাতির ইতিহাসে কেবল আরেকটি যুদ্ধের সাথে তুলনা করা যেতে পারে আর সেটি হলো পিউনিখের য্দ্ধু। রোমান সাম্রাজ্য এবং বন্দরনগরী কার্থেজের মধ্যে মোট তিনটি যুদ্ধ হয়েছিল প্রাচীন দুনিয়ায় এবং সেই যুদ্ধের মহানায়ক মহাবীর হানিবল ও তার পিতা মহাবীর হামিলকার এখনো যুদ্ধবিদ্যার ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন।

পানিপথ ও পিউনিথের মতো ২৮ অক্টোবর কেন বারবার বাংলাদেশে সংঘটিত হচ্ছে এবং পানিপথের প্রান্তর এবং কার্থেজের উপকূলের মতো পুরানা পল্টন-নয়াপল্টন, বায়তুল মোকাররম কেন বারবার মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে তা যদি আমরা খুঁজে বের করতে পারি তবে অনাগত ইতিহাসের অভিশাপ থেকে হয়তো রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যারা গবেষণা করবেন তাদের বলব, ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা ও হিরোডোটাসের দ্য হিস্টিরিয়া বইটি পড়তে। কারণ পৃথিবীতে অতি প্রাকৃত কিছু বিষয় রয়েছে- রয়েছে নিয়মিত জাল এবং ভূ-পৃষ্ঠের বিপজ্জনক স্থান-কাল ও ব্যক্তি। যখন বাস্তবতার সাথে অতি প্রাকৃত বিষয়াদির রসায়ন ঘটে তখন জমিনে এমন বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, যা কি না দেশ কাল জাতির ইতিহাস শুধু বদলে দেয় না, কিছু ক্ষেত্রে উল্টিয়ে দেয়।

আমাদের দেশের গত ৫০০ বছরের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করেন, তবে ঢাকার পল্টন-রমনা রেসকোর্স, গুলিস্তান এবং জিঞ্জিরা ও সদরঘাটের মধ্যবর্তী বুড়িগঙ্গাকে একটি বিশেষায়িত অঞ্চল হিসেবে দেখতে পাবেন। সুলতানি জমানার আগে অর্থাৎ সেন রাজবংশের সময় থেকে ওইসব অঞ্চল ঘিরে বারবার এমন সব কুলক্ষণে দুর্ঘটনা ঘটেছে যা বাংলার ইতিহাসকে বারবার ওলট-পালট করে দিয়েছে। আর সেসব ঘটনার মাধ্যমে অনেকে নির্বংশ হয়েছে- অনেকে নির্মূল হয়েছে এবং পুরনো ইতিহাস করতে গিয়ে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাজপথে যা ঘটল তার অনাগত পরিণতি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের চেয়েও জটিল কুটিল ও ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে। পূর্বেকার দুর্ঘটনার জন্য দেশীয় লোকজনকে দায়ী করা হয়। যাদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনীতির সাথে জড়িত পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তি। কিন্তু এবারের দুর্ঘটনায় রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষের লোকজনের তুলনায় অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ছিল অতিমাত্রায় ভয়ঙ্কর। দ্বিতীয়ত, এবারের দুর্ঘটনার দ্বারা একটি অসম শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।

রাজনীতির ময়দান থেকে পরাজিতরা আপাতত পিছিয়ে পড়েছে এবং তাদের শূন্যস্থানে প্রবল পরাক্রান্ত বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের প্রতিক্রিয়া, প্রতিহিংসা এবং প্রতিফল যে ২০০৬ সালের চেয়ে জটিল কুটিল ও ভয়ঙ্কর হবে যা সহজেই বুঝতে পারা যায়- আর যারা সহজে বুঝতে চান না তারা দয়া করে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পরিণতিটি ইতিহাসের বই থেকে জেনে নিতে পারেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য