Naya Diganta

টিপু মুনশিকে ধরেননি প্রধানমন্ত্রী

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

সরকারের বয়স্ক বা কম বয়স্ক, অভিজ্ঞ বা অনভিজ্ঞ মন্ত্রীরা এত বেশি বেফাঁস কথাবার্তা বলে বসেন যে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে অন্য মন্ত্রীদের মাঝে মধ্যেই নানাভাবে পেরেশান হতে হয়। তবে এসব বেফাঁস কথার সাথে অধিকাংশ সময়ই সরকারের নীতির কোনো সম্পর্ক থাকে না। আবার একই বিষয়ে মন্ত্রীরা এক একজন এক এক কথা বলেন। ফলে বোঝা যায় না, আসলে কোনটি সরকারের নীতি বা কোন কথাটিতে প্রধানমন্ত্রীর সায় আছে বা নেই। আবার মন্ত্রিত্বের সীমা লঙ্ঘন একটি সাধারণ ঘটনা। দেখা যায়, কোনো কোনো মন্ত্রীর নিজ মন্ত্রণালয়ের বাইরের বিষয়ে কথা বলার প্রবণতা বেশি। কেউ কেউ আবার দৃষ্টি এড়ান, পালিয়ে বেড়ান। ফলে সময়ে সময়ে সরকারের অ্যাকশনে জনমনে যেসব প্রশ্নের উদ্রেক হয়, তার জবাব দেয়ার জন্য মন্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এর জন্য এখন জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থাও নেই। মন্ত্রীরা কেউ মনে হয়, কোথায়ও কারো কাছে জবাবদিহি করেন না। আবার কোনো কোনো মন্ত্রী সবজান্তা। প্রয়োজন হোক বা না হোক, যেকোনো সাবজেক্টে লাফ দিয়ে পড়েন।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অবশ্য সিন্ডিকেটের ঘটনায় নিজ মন্ত্রণালয়ের আওতার ভেতরেই প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় বাজার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট মধ্যবিত্তের পেটে অবিরাম লাথি মেরে যায়। সিন্ডিকেটবাজরা যেকোনো পণ্য নিয়ে সিন্ডিকেট করতে পারে। তাই তারা করছে। যে পণ্য সামনে পায় তাই নিয়ে তারা সিন্ডিকেট করে। পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ঢেঁড়স, চিচিঙ্গা সব কিছুতেই সিন্ডিকেট আছে। চাল, ডাল, তেল, লবণে তো আছেই। সম্প্রতি দেখলাম রোগীর শরীরে পুশ করার স্যালাইন ও ডাব নিয়ে সিন্ডিকেট করেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কখনো কখনো জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়েও এসব ব্যবসা চলে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এখন অনেক খবর রাখে। তারা যদি জানতে পারে কোনো সীমান্তে ট্রাক ধর্মঘট হতে পারে তা হলে ওই সীমান্ত পথে যা কিছু আমদানি হয় বা হতে পারে সিন্ডিকেটবাজরা সেসব পণ্য দ্রুত গুদামজাত করে ফেলে। ফলে পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হয়। তখন তারা রাতারাতি পণ্যের দাম বাড়ায়। সেভাবে তারা সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, চিনি, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এরকম লাগাম ছাড়া সিন্ডিকেটবাজির ফলে কাঁচামরিচের দাম কেজি প্রতি হাজার টাকায় উঠেছিল।

আর একটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে একেবারে চমকে উঠেছি। গাছে ধরে যে ডাব তার এক একটি ডাবের দাম দুই শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকা হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত রোগীরা ছাড়া মানুষ সারাদিনে একটি ডাবও খায় না। দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের ফলে ডাব ও স্যালাইনের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। তার মধ্যে এক দিন দেখলাম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের একটি দল বাজারে গেছেন ডাবের দাম মনিটর করতে। ওই দলের একজন খুুচরা এক বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ডাবের দাম এত বাড়ল কেন? বিক্রেতা ঝটপট জবাব দিলেন আমরা বেশি দামে কিনেছি। তখন ওই কর্মকর্তা জানতে চাইলেন কোথা থেকে কোন আড়ত থেকে কিনেছেন? কোনো ক্যাশমেমো আছে? এভাবে দাম আপনারা যারা বাড়িয়েছেন, সেসব আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতা উভয়ের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কি না বলতে পারি না। কিন্তু রাতারাতি ডাবের দাম অনেকটাই কমে আসে। এর মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গোটা দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে বললেন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তা হলে তারা বাজার অচল করে দেবে। এটি ছিল একটি অক্ষমের আত্মসমর্পণ; যা ছিল সরাসরি জনস্বার্থের বিরুদ্ধে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী ব্রিকস সম্মেলন শেষে দেশে ফেরেন এবং সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। তাতে একজন সাংবাদিক সিন্ডিকেট নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর গণবিরোধী বক্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বলেছে নাকি? আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব। পরদিনই বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ওই সংবাদ সম্মেলনের পরও প্রায় দুই ঘণ্টা তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। এটি খুব স্বাভাবিক, প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিদিন শত শত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। কোনো এক মন্ত্রীর দায়িত্বহীন উক্তি নিয়ে তাকে ধরার সময় কোথায় প্রধানমন্ত্রীর। এভাবে কত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে দ্রুত হারিয়ে যায় তার আর খোঁজ মেলে না। সিন্ডিকেটবাজরা বাজার দখল করে সব কিছু এলোমেলো করে দেয়। ভোগে সাধারণ মানুষ।

এভাবে অনেক জিনিসই হারিয়ে যায়। যেমন, সরকার এখন ব্যস্ত প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে। ইউনূস সুদখোর, ট্যাক্স ফাঁকি দেন এবং কুলাঙ্গার। একসময় বা এখনও বেগম খালেদা জিয়ার কথা বলতে গেলেই বলেন, বেগম জিয়া এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষেই মেরে খেয়েছেন কি না সেটি প্রমাণ দেয়ার কারো কোনো দায় নেই। এত সব অপপ্রচারের মধ্যেও ক্ষীণ কণ্ঠে সেই সত্য এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, জিয়া অরফানেজ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে বিদেশ থেকে তিন কোটি টাকা এসেছিল। ওই টাকা বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশী কোনো ব্যাংক থেকে নেয়া হয়নি। এবং ব্যাংকে পড়ে থেকেই ওই টাকা এখন ছয় কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সুতরাং ‘এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন, এটি মোটেও সত্য কথা নয়।’ হাজার মুখে বলতে বলতে এই অসত্য এখন প্রায় বিশ্বাসযোগ্য করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা মিথ্যাই।

কিন্তু এর বাইরেও বহু প্রশ্নের জবাব নেই। কোন যুক্তিতে বিদ্যুৎ খাতে কেনাকাটা ও চুক্তিকে দায়মুক্তি দেয়া হলো? সরকার আইন করেছে যে বিদ্যুৎ খাতে কোনো চুক্তি বা কেনাকাটা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এখন আস্তে আস্তে প্রকাশিত হচ্ছে যে বিদ্যুৎ খাতে কী বিপুল দুর্নীতি করা হয়েছে। যার খেসারত আমরা এখন দিচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও দিতে থাকব।

আরো একটি প্রশ্নের কেউ কোনো জবাব দিচ্ছে না সরকার তার পক্ষের লোকদের অবাধ দুর্নীতি ও লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছে। তার একটা উদাহরণ হচ্ছে, এস আলম গ্রুপের সিঙ্গাপুরে এক শ’ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে যারা বিনিয়োগ করেছে তাদের মধ্যে এস আলমের নাম নেই। গোটা টাকাটাই সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার ও বিনিয়োগ করেছে এস আলম গ্রুপ। আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বেশ কয়েকটি কর্তৃপক্ষকে এই পাচার তদন্ত করতে বলেছিল। কিন্তু চেম্বার আদালত প্রায় ছয় মাসের জন্য এই তদন্ত বা অনুসন্ধান স্থগিত করে দিয়েছেন। ‘সদুদ্দেশ্যে ও সরল বিশ্বাসে’ কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে এই তদন্ত বা অনুসন্ধান স্থগিত করা হলো কেন? আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সারাদিন অপ্রয়োজনীয় প্যাঁচাল পাড়েন। কিন্তু এস আলম বিষয়ে তাদের কেউ আজ পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেননি।

মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার ১৬৮টি মামলা করেছে। তার বেশির ভাগই দুর্নীতি, টাকা পাচার ও শ্রমিকের টাকা মেরে খাওয়া। এসব মামলাকে হয়রানিমূলক বলেছেন বিশ্বের ১৭৫ জন নোবেল বিজয়ী ও রাজনীতিক, এমনকি জাতিসঙ্ঘ। সরকার ও তাদের চামচারা গলা ফাটিয়ে বলেছেন, বিশ্বনেতাদের এসব বক্তব্য ও মামলা তুলে নেয়ার দাবিটি আদালত অবমাননার শামিল। এস আলমের বিরুদ্ধে শুধু সিঙ্গাপুরেই এক শ’ কোটি ডলার পাচারের প্রশ্ন করা হলে সরকারের তরফ থেকে বলার যুক্তি আছে যে এটি আদালত অবমাননা ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com