Naya Diganta

দামুড়হুদার আড়াই শ’ বছরের জমিদার বাড়ির শেষ চিহ্ন বিলুপ্তির পথে

দামুড়হুদার আড়াই শ’ বছরের জমিদার বাড়ির শেষ চিহ্ন বিলুপ্তির পথে


চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদার নাটুদহ ইউনিয়নের নাটুদা স্টেট জমিদার বাড়ির ঐতিহাসিক নিদর্শন বিলুপ্ত হতে চলেছে। দক্ষিণ জনপদের এ অঞ্চলের জমিদারদের গোড়াপত্তন করেন মধুসূদন পাল চৌধুরীর ছেলে নফরপাল চৌধুরী। তিনি ও তার পরিবার প্রায় দেড় শ’ বছর এই জমিদারি করেন। জমিদারি প্রথা বাতিল হলে তিনি সপরিবারে ভারতে চলে যান।
দামুড়হুদার নাটুদা অঞ্চলের জমিদার নফরপাল চৌধুরীর সব কীর্তিই আজ ধ্বংসের পথে। আজ আর নেই সেই জমিদার মহলের খাজনা আদায়ের লাঠিয়ালবাহিনী, নর্তকীর নাচের ঝলকানি, পাইকপেয়াদা, চাকরবাকর, ঘোড়াশাল আর সুবিশাল অট্টালিকা। কালের বিবর্তনে প্রায় সব ধ্বংসের পথে। অধিকাংশ কীর্তি ধ্বংস হয়ে গেলেও কালের সাক্ষী হয়ে আজো স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে নাটুদহ জমিদার নফরপাল চৌধুরীর জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারে স্থাপিত দু’টি প্রধান ফটক। ব্রিটিশ শাসন আমলে লর্ড কর্নওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করা হলে সে সময়ে ভারতের ২৪ পরগনার প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব মধুসূদন পালের একমাত্র সন্তান নফরপাল চৌধুরী এই ব্রিটিশদের কাছ থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহণ করেন এবং নাটুদহ সদর স্টেট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জমিদার কার্যক্রম চালু করেন। সেই থেকে চলে প্রায় দেড় শ’ বছর। পরে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির মধ্যে দিয়ে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি হয়।

জমিদার মহলটি ছিল চার দিক বিশাল পাঁচিল বেষ্টিত চারতলাবিশিষ্ট এল প্যাটার্নের সুবিশাল জমিদার ভবন। জমিদার ভবনের সামনে ছিল বিশাল সিংহ মার্কা সুন্দর আকৃতির মেন গেট। গেটের উত্তর পাশে দু’টি বিশাল মন্দির ছিল। জমিদার ভবনের সাথে গোপন রাস্তা সংযুক্ত বিশাল খিড়কির একটি পুকুর ছিল। পাকা সিঁড়ি সংযুক্ত ওই পুকুর জমিদার গিন্নি রাধারানীসহ পরিবারের লোকজন স্নান করত। পড়ন্ত বিকেলে জমিদার বাবু তার স্ত্রী রাধারানীকে সাথে নিয়ে ওই পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতেন। জমিদার ভবনের পশ্চিম পাশে জনসাধারণের জন্য তৈরি করা হয় একটি বিশাল পুকুর। যা আজ সদর পুকুর নামে পরিচিত। ১৯৩৫ সালের শেষের দিকে নফরপাল চৌধুরী মারা যান। তার মৃত্যুর পর জমিদারি বড় ছেলে সতীষ চন্দ্র পাল মেজ ছেলে জতীষ চন্দ্র পাল ও ছোট ছেলে শ্রী ক্ষিতিষ চন্দ্র পাল এই তিন ছেলের নামে ভাগ হয়ে যায়। পরে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান এবং তৎকালীন গভর্নর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের নেতৃত্ব দেশ বিভক্ত হলে জমিদারি প্রথা বাতিল হয় এবং নফরপাল চৌধুরীর উত্তরসূরিরা ভারতে চলে যান। তার পর এলাকার একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল কৌশলে জমিদার নফরপাল চৌধুরীর জমিদার ভবন ভেঙে বিক্রি করে দেয়। বিলীন হয়ে যায় জমিদার পুত্রের হাওয়া ভবনসহ জমিদার স্টেটের সবকিছুই। কিন্তু বর্তমানে বাড়িটির শেষচিহ্নও বিলুপ্তির পথে। আগেই বাসগৃহ, অতিথিশালা, রাজদরবার, দুর্গামন্দির, মঠ, ট্রেজার, গোশালাসহ অন্যান্য নিদর্শন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু জমিদার ভবনের সেই ২৫০ বছরের দু’টি প্রধান ফটক স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরে মাথা উঁচু করে কালের সাক্ষী হয়ে শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজো দাঁড়িয়ে আছে। নাটুদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান শফি বলেন, আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে নফরপাল চৌধুরীর সব স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করে আসছি। একাধিকবার দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলেছি এবং নফরপাল চৌধুরীর শেষ ফলক দু’টি সংস্কার করার দাবি করি। আর নিজস্ব অর্থায়নে বাবু যে রাস্তা দিয়ে বিকেলে হাঁটতেন সেই রাস্তাগুলোর চার পাশে সুন্দর ফুলবাগানসহ গাছ লাগিয়েছি যা বর্তমানে অনেক মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসে। যদি প্রশাসন একটু নজর দেয় তাহলে আরো সুন্দর ও সংস্কার করা সম্ভব।

দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেলোয়ারা জামান বলেন, আমি সবে মাত্র দামুড়হুদায় যোগদান করেছি। অবশ্যই দেখব কী করা যায়। প্রয়োজনে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ডিসি স্যারের সাথে আলোচনা করে সংস্কার করার ব্যবস্থা করব। এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, প্রাচীন ঐতিহ্য বা স্মৃতিগুলো আমাদের ধরে রাখা দরকার। আগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও লোকাল প্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগ নিলে আমার প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।