Naya Diganta

ফিরিঙ্গি বাজার ভ্রমণ

ফিরিঙ্গি বাজার ভ্রমণ্

ডিসেম্বর ২০১৬। বিকেল সাড়ে ৪টা, আমরা সদরঘাট টার্মিনালে। এমভি ফারহান-৩ হাতিয়ার উদ্দেশে ঘাট ত্যাগ করবে ৫টায়। যখন ৫টা তখন মিজান ভাই পথে। বিজয় দিবস উপলক্ষে রাস্তায় অনেক জ্যাম। মিজান ভাই এখনো নওয়াবপুরই পার হতে পারেননি। লঞ্চের লাস্ট সিগন্যাল বাজাতে শুরু করেছে। আনন্দের সূচনা নিরানন্দে শুরু হতে দেখে সবাই উৎকণ্ঠিত। যতদূর জানি, এই ফারহান সময়মতোই ছাড়ে। আমাকে সবার চেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত দেখে আতাউর-
-টেনশন নেই, এ লঞ্চের মালিক আমাদের ক্লায়েন্ট, বড় স্যারের (খলিল ভাই) সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত লঞ্চ ঘাট ছাড়তেই পারে না।
ফোন করে জানা গেল, মিজান সাহেব গাড়ি ছেড়ে রিকশা নিয়েছেন। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছাকাছি পৌঁছে রিকশা ছেড়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। জগন্নাথ কলেজের মোড় থেকে নিশ্ছিদ্র জ্যাম। জ্যামের ভেতর দিয়ে লাগেজ নিয়ে হাঁটার চেয়ে ঝুলন্ত তারের ওপর হাঁটা সহজ। এই এলো এই এলো, বলে আরো ৩০ মিনিট। মিজান সাহেব লঞ্চে পা দিতে না দিতেই লঞ্চ ছাড়ার শেষ ভেঁপু বেজে ওঠে।

রাতের খাওয়ার পর শুরু হয় এশার আজান। জাহাজের স্পিকারে রেকর্ডকৃত আজান বাজতে শুরু করলেই হেলাল সাহেব সবাইকে জামাতে নামাজ আদায়ের কথা মনে করিয়ে দেন। খলিল ভাইয়ের অ্যাসোসিয়েটসের মধ্যে হেলাল সাহেব সুন্নাহ পোশাকি। হেলাল সাহেব খলিল ভাইয়ের জুনিয়ার হলেও সুযোগ পেলে একজন আরেক জনকে খোঁচা মারতে ছাড়েন না। লঞ্চের তিনতলায় নামাজের স্থান। খলিল ভাইও সবাইকে নামাজ আদায়ের আহ্বান জানিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে অজু করতে শুরু করেন। অজু শেষ করে পানি মুছতে মুছতে সহাস্যে-
-ইসলাম বরাবরই সহজ ও শান্তির ধর্ম, ঝামেলা পাকাচ্ছে হেলালদের মতো কিছু নীতিনির্ধারক। কেউ কেউ নিজের সিদ্ধি সাধন করতে গিয়ে মনগড়া যুক্তি ও তথ্য-উপাত্তের সংমিশ্রণে শান্তির সুগম পথ ইসলামকে দুর্গম করে তুলছে।

ধর্ম ও রাজনীতি দুই মেরুর বাসিন্দা। একটি যদি তেল হয় আরেকটি জল। গায়ের জোরে তেল আর জল মেশাতে গেলে দুই-ই মৌলিকত্ব হারায়।
-ইসলাম অর্থ শান্তি। ইসলাম এক দিকে যেমন শান্তি অন্য দিকে তেমন স্বস্তি। শান্তি ও স্বস্তির পথ কখনো অস্বস্তি বা আতঙ্কের হতে পারে না। ইসলামী জীবনব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ-সরল। সহজ-সরল ইসলামকে জটিল করে তুলছে এক শ্রেণীর কাণ্ডজ্ঞানহীন মতলববাজ।
বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কহীন মতলববাজদের কারণেই একবার আমরা অনেক পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। ইসলামের সার কথা, ‘পরের হক কাড়ব না- ঘরের হক ছাড়ব না’। সার কথা সংরক্ষণ করার জন্যই ধর্মের প্রদর্শিত নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে হয়। বিশ্বনবী সা:-এর আদর্শ থেকে বিচ্যুতি বা স্খলনই অশান্তির কারণ। বিশ্বনবী সা: তার ইন্তেকালের কয়েক দিন আগে সব মুসলমানকে জড়ো করে কী উপদেশ দিয়েছিলেন মনে আছে? পরবর্তী উম্মতদের মধ্যে নবী সা:-এর শেষ উপদেশ প্রচারের জন্য বারবার অনুরোধ করে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা দিন দিন বিশ্বনবী সা:-এর উপদেশ ও আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। মার্টিন লুথার কিং মানবাধিকারের ওপর ১৯৬৩ সালে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে ১৯৬৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভ‚ষিত হন। মার্টিন লুথার কিং তার ঐতিহাসিক ভাষণে, সাদা-কালোর ভেদাভেদ দূর করতে গিয়ে যেসব কথা বলে গেছেন সেসব কথা আমাদের নবী করিম সা:-এর বিদায় হজের ভাষণ-
‘মনে রেখো, তুমি যা খাবে তোমার দাস-দাসীকে তা খেতে দেবে, তুমি যা পরবে তোমার দাস-দাসীকে তা পরতে দেবে। ক্রীতদাসও যদি দলপতি হয় তার আদেশ মেনে চলবে’-এর প্রতিধ্বনি। দণ্ডবিধি আইনের ‘জরমযঃ ড়ভ ঢ়ৎরাধঃব ফবভবহপব’ অধ্যায়ে উল্লিখিত আইন তৈরি হয়েছিল ১৮৬০ সালে। রচিত হয় থমাস ব্যাবিংটন মেকলের সভাপতিত্বে ব্রিটিশদের হাতে। অথচ, বিশ্বনবী সা: ১৪০০ বছর আগেই বিদায় হজ ভাষণে, ‘জান, মাল ও আব্রæর নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করে গেছেন। ‘মনে রেখ, স্ত্রীর ওপর স্বামীর যে প্রকারে অধিকার রয়েছে স্বামীর ওপরও সে প্রকারে তার স্ত্রীর অধিকার রয়েছে।’

মুসলিম জাহান কি এই সমাধিকার নীতি মানে? মানে না। সৌদি মহিলারা পরিচালিত হয়, ‘ফ্যামিলি অ্যাক্ট’-এর অধীনে। সউদ পরিবার যেহেতু আবদুল ওহাব নজদির বংশধর সেহেতু মুসলিম বিশ্বে প্রচার হচ্ছে ওহাবি ইসলাম। তারই অংশ হিসেবে আরব থেকে বিশ্বনবী সা-এর আদর্শ সুন্নাত, ইজমা ও কিয়াস মূল্যহীন হয় সউদ পরিবার ক্ষমতায় আসার পরপরই। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা নামাজ-রোজার ইহলৌকিক উপকারিতা স্বীকৃতির পর অমুসলিমরাও নামাজ-রোজার অনুকরণে শুরু করে যোগব্যায়াম ও উপবাসব্রত। পবিত্র কুরআনুল কারিমে, নামাজের পাশেই জাকাতের স্থান। হুবহু জাকাতের অনুকরণে বিশ্বের সর্বত্র চালু রয়েছে ট্যাক্স। যেকোনো দ্রব্য কেনাকাটার সময় আড়াই পার্সেন্ট ট্যাক্স রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়ে যায়। কোষাগার থেকে নেমে আসে সর্বসাধারণের কল্যাণে। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে নাম ভিন্ন হলেও গুণে তেমন ভিন্নতা নেই। মুসলমানদের ভুল তো এখানেই,
‘নিজের ধন পরকে দিয়ে আজ আমরা নিঃস্ব,
আমার ধনে ধনী হয়ে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব।’
ধর্ম নিয়ে তর্ক নিষেধ। (উপরের দিকে তর্জনী তুলে)
‘কেউ বলে আছেন তিনি, কেউ বলেন নেই,
থাকিলে থাকিতে পারেন, না থাকিলে নেই।’
থাকিলে থাকিতে পারেন’, এই শঙ্কাই যদি সত্য হয়ে বসে তখন কী হবে! তাই আর তর্ক নয়, বিনা তর্কে সবাই নামাজ আদায় করতে চলেন (বলেই খলিল ভাই টুপি মাথায় পরতে পরতে তিনতলার দিকে যাত্রা করলেন)।
১৭ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে ভেঁপুর শব্দে ঘুম ভাঙে। কেবিন থেকে বের হয়ে জানতে পারি, লঞ্চ কালিগঞ্জ ঘাটে। লোনাপানির জোয়ারভাটার এলাকা। চেয়ার টেনে বাইরে বসি। আমার রয়েছে ভ্রমণ বাতিক। ভ্রমণের নাম শুনলে ঘিলু টগবগ করতে শুরু করে। ভ্রমণের নাম করে যখন বাসা থেকে বেরই তখন পরিচিত জগৎটা আমার কাছে অপরিচিত হয়ে পড়ে। অপরিচিত জগতের সাথে নতুন করে পরিচয় করতে শুরু করি। নতুন রাস্তাঘাট, বন, পাখি, মানুষ, সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি সব কিছুর সাথে পরিচয়ের আকাক্সক্ষাই আমাকে ঘর ছাড়া করে। পরিণত বয়সে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চার ঘণ্টার বেশি ঘুমানো সময়ের অপচয়। সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চেয়ার নিয়ে কেবিনের বাইরে বসা ছিলাম। অন্ধকারে দুই পাড়ের বাতি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ঝিঁঝি পোকার মতো ইঞ্জিনের একটানা শব্দ ও জাহাজের মিষ্টি কম্পন অনেকের ঘুমের জন্য সহায়ক হলেও আমি পারি না। ‘আহার, নিদ্রা ও ভয়, যত করে তত হয়।’ আমি এই উক্তিতে বিশ্বাসী। তাই অনেক সাধনার পর নিদ্রাটাকে চার ঘণ্টায় নামিয়ে এনেছি। রাতের ১২টায় বিছানায় গেলেও ত্যাগ করি ৪টায়। ছাত্রকাল থেকে এই অভ্যাসটা রপ্ত হয়ে গেছে। আমার মতে, যারা প্রয়োজনের বেশি ঘুমায়... তারা নিজের আয়ু নিজে কমায়।

ভোরের আজানের পর পূর্বাকাশ আবীর রঙ ধারণ করতে শুরু করে। লঞ্চ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকের গাঁওগেরাম কিছুই মালুম হয় না। দক্ষিণ-পশ্চিমে ভোলা এলাকা। লঞ্চঘাটে-টানানো ছবি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এলাকাটি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, এমপি ও মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের। বেড়িবাঁধের মতো ভাঙনকবলিত একটি মাথা মুখব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ের ভাঙন দেখে মনে হয়, মানচিত্র থেকে খসে যেতে শুরু করেছে ভোলা।

মুখব্যাদানকৃত বাঁধের কিছু অংশ নদীতে। দিনের আলো যতই উজ্জ্বল হচ্ছে ততই উজ্জ্বল হচ্ছে ভাঙনের ভয়াবহ চিত্র। সামনেই মনপুরা। ৬০০ বছর আগে যে মনপুরায় পর্তুগিজ জলদস্যুরা আস্তানা গড়েছিল। মনপুরার পাশেই সবুজ বেষ্টনীর ভেতর চর কুকরী-মুকরী, ঢাল চরসহ আরো অনেক চর। ঢাকা ছেড়ে আসার পর আমরা কমবেশি ২০০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছি।

মনপুরা নামটি পরিচিত হওয়ার কারণ, একটি ছায়াছবির নাম ‘মনপুরা’। ব্যবসা সফল মনপুরা ছবিটি চিত্রায়িত হয়েছিল মনপুরা দ্বীপকে ঘিরে। আবহমান গ্রামবাংলার চিরায়ত ভালোবাসা ও সহজ-সরল দু’টি বালক-বালিকার প্রেম-বিরহের কাহিনী ভরপুর ‘মনপুরা’ ছবি। ছবিতে পাশাপাশি দু’টি দ্বীপ। এক দ্বীপে নায়ক আর অন্য দ্বীপে নায়িকা মাঝখানে গভীর নদী। নদীতে তীব্র স্রোত। এক হাতে কাপড় ধরে গামছা পরিহিত নায়ক নেমে পড়ছে নদীতে। স্রোত, ভয় ও গভীরতা উপেক্ষা করে নায়িকার টানে সাঁতার কাটে। মনপুরার পাশে যে নদী সে নদীর এক দেড় কিলোমিটার পরই একটি দ্বীপ। পাশাপাশি দু’টি দ্বীপের মাঝখানে যে নদী সে নদীতেই সাঁতার কেটেছিল নায়ক। ঘোলা জল। মনে হয়, স্রোতের পাকে পাকে মাটি দলা বেঁধে উপরে উঠে আসছে। পান করা দূরের কথা, ব্যবহার অযোগ্য নদীর পানি। ডান দিকের কুল ভেঙে মাটি গুলিয়ে যাচ্ছে জলে। নদীর জল ঘোলাও ভালো, জাতের মেয়ে কালোও ভালো; এই প্রবচনটি যিনি বলে গেছেন তিনি মেঘনায় এরকম ঘোলাজল দেখলে কখনো জাতের মেয়ের সাথে তুলনা করতেন না।

সামনেই হাতিয়া। আমরা ১৪ ঘণ্টা লঞ্চে। আমরা মেঘনার মোহনায়। ৩৫০ মাইল দীর্ঘ মেঘনা নদী। সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত স্রোত মেঘনা নাম ধারণ করে চাঁদপুর আসার পর পদ্মা এসে মিলিত হয় মেঘনার সাথে। চাঁদপুর থেকে ৯০ মাইল দক্ষিণে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

মেঘনার পাড়ে চাঁদপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা। পদ্মা-মেঘনার সম্মিলিত ধারাটির নাম মেঘনার মোহনা। আমরা এখন মেঘনার মোহনায় বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি। শৈশবে মেঘনার গতিপথ পড়তে গিয়ে ভাবতাম, মেঘনার মোহনা সাগরের মতোই গভীর। সম্পূর্ণ ভুল। যতই দক্ষিণে যাই ততই অগভীর মেঘনা। এতই অগভীর যে লঞ্চের ইঞ্জিনের ধাক্কায় কোথাও কোথাও নদীর তলা থেকে উথলে ওঠে মাটি। লঞ্চের গতিও কমে গেছে।

আমরা সবাই লঞ্চের ডেকের ওপরে। তাকিয়ে রয়েছি সামনের দিকে। সামনেই নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা। হাতিয়ার কাছাকাছি পৌঁছাতেই চোখে পড়ে ফিরিঙ্গি বাজার লঞ্চঘাট। বাঙ্গাল মুল্লুকে পর্তুগিজদের আরেক পরিচয় ফিরিঙ্গি। সুলতানি শাসনামলে ১৫৩৪ সালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রাম আসে। অন্যায় আচরণের অভিযোগে তাদের বন্দী করে গৌড়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সুলতান তাদের বিবেচনা করে চট্টগ্রাম ও হুগলিতে কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেন। পর্তুগিজরা এখানে আড়ত স্থাপন করে। স্থানীয়রা পর্তুগিজদের ফিরিঙ্গি নামে অভিহিত করত। ফিরিঙ্গি শব্দের উদ্ভব পর্তুগিজ শব্দ ফ্রান্সেস থেকে, যা দিয়ে ইউরোপীয় বোঝায়। ফ্রান্সেসের বাংলা ফিরিঙ্গি। ফিরিঙ্গিদের নামানুসারে এলাকাটি ফিরিঙ্গি বাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। এলাকাটি পরে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার তজুমদ্দিনের অন্তর্ভুক্ত হলেও ফিরিঙ্গি বাজার নামটি থেকেই। লঞ্চ যখন ফিরিঙ্গি বাজার পৌঁছে তখন সকাল সাড়ে ৮টা।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
mail: adv.zainulabedin@gmail.com