Naya Diganta

৭ নম্বর ব্যাটিং পজিশনে উদ্বেগ বাংলাদেশ দলের

আফিফ হোসেন ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।

বিশ্বকাপের বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশিরভাগ জায়গাই নিশ্চিত বলছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান। তবে কিছু জায়গা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে, সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, কে ব্যাটিং করবেন ৭ নম্বর পজিশনে, এটা নিয়ে।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই পজিশনে একসময় নিয়মিত ব্যাট করতেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, গত বছরের এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি থেকেই তিনি জাতীয় দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ব্যর্থতার পর তিনি দল থেকে বাদ পড়েছেন।

রিয়াদ বাদ পড়ার পর বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে বেশ কটি পরিবর্তন এসেছে, ৫ নম্বর পজিশনে এসেই তৌহিদ হৃদয় জায়গা করে নিয়েছেন, ৬ নম্বরে চলে গিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। ছয়ে গিয়ে দারুণ ফর্মে আছেন বাংলাদেশের এই উইকেট কিপার ব্যাটার।

এখন নির্বাচকদের মাথা ব্যথার জায়গা হচ্ছে ৭ নম্বর।

‘আগের ভুল' করতে চান না নির্বাচকরা
বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আগে পুরনো ক্রিকেটারদের ডেকে একাদশে খেলিয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে সাম্প্রতিক টুর্নামেন্টগুলোতে। ২০২১ সালে সৌম্য সরকারকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ডাকা হয়েছিল, ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে নির্বাচকদের প্রথম পছন্দ না হওয়ার পরেও সাব্বির রহমানকে ডাকা হয়েছিল দলে। কিন্তু তারা কেউই ক্যারিয়ারের শুরুর প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি ব্যাট হাতে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেন, ‘হাথুরুসিংহে পুনরায় কোচ হিসেবে আসার পরে তাকে গত তিন বছরে কে কোথায় কেমন করেছে এনিয়ে ব্রিফ করা হয়েছে। এখন আর আগের ভুল পথে পা বাড়াবে না ম্যানেজমেন্ট’।

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্কোয়াড নিয়ে খেলতে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে এক সাকিব আল হাসানের রেকর্ড-গড়া পারফরম্যান্স বাদে আর উল্লেখ করার মতো ক্রিকেট কেউই খেলেননি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ১০ দলের মধ্যে ৮ নম্বরে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করে।

তাই এবারে সেই পথে পা বাড়াবেন না বলেই গণমাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছেন চিফ সিলেক্টর।

তবু সুনির্দিষ্টভাবে লোয়ার অর্ডারে খেলার মতো কোনো ক্রিকেটারে থিতু হতে পারেনি টিম ম্যানেজমেন্ট।

মিরাজ, আফিফ, রিয়াদ, রাব্বি- কারা আছেন এই দৌড়ে
সাম্প্রতিক আয়ারল্যান্ড সিরিজে মেহেদী হাসান মিরাজ খেলেছেন ৭ নম্বর পজিশনে। তিনি রানও করেছেন তিন ম্যাচে যথাক্রমে ২৭, ১৯ ও ৩৭। এর আগে ঘরের মাটিতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ৭ নম্বরে খেলেছিলেন ইয়াসির রাব্বি, তিনি এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি তেমন।

মিরাজ যেহেতু বোলিংও করেন তাই মিরাজকে ব্যাটিংয়ে এত বড় পজিশনে দেয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি আশ্বস্ত নন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম।

‘মিরাজ দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন ক্রিকেটার, কিন্তু তার পরে যদি এমন চারজন ক্রিকেটার থাকেন যারা ব্যাটিং পারেন না সেটা তার ওপর একটা চাপ তৈরি করতে পারে, এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায় আমার মতে’।

‘বাংলাদেশ যখন ছয়জন বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে মাঠে নামে, ব্যাপারটা ভাবলে ভালো লাগে, কিন্তু ব্যাটিং করার সময় এর বিপরীত বোধ তৈরি হয়। আমি মিরাজকে ৭ নম্বরে পাঠাতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবো না, এতে মিরাজের ব্যাটিংয়ের ক্ষতিও হতে পারে।’

ফাহিম বলেন, ‘মিরাজ ৭ নম্বরে ব্যাটিং করলে ব্যাটিং অর্ডারটা সমন্বয়হীন মনে হয়, মনে হয় অপর্যাপ্ত। ৭ নম্বরে আমি এমন কাউকে চাইবো যে ব্যাটিংয়ে বিশেষজ্ঞ, একটু বোলিংও পারেন, মিরাজ আটে খেললেই নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে পারবে।’

মেহেদী হাসান মিরাজ ভারতের বিপক্ষে গত বছরের শেষদিকে একটি সিরিজে ব্যাট হাতে দুটি ম্যাচ জয়ে ভূমিকা রেখেছেন, একটিতে তিনি ৮৩ বলে অপরাজিত শতক হাঁকিয়েছিলেন।

গত বছর অন্তত দুটি ওয়ানডে সিরিজ জয়ে মিরাজের ব্যাট হাতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, কিন্তু তখন তিনি ৮ ও ৯ নম্বরে ব্যাট করতেন।

মিরাজকে শেষ ব্যাটিং অবলম্বন রাখলেই বেশি নির্ভার থাকবে এই ব্যাটিং লাইন-আপ, এমনটাই মত জাতীয় দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের মেন্টর নাজমুল আবেদীন ফাহিমের।

নির্বাচকদের দৃষ্টিভঙ্গিটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তিনি, ‘দলে আসলে নির্বাচকরা কী চান সেটাই আসল ব্যাপার হবে’।

নির্বাচকদের সাথে কথা বললে তারা এখনই কোনো অনুমান বা কোনো নাম বলতে রাজি হননি, কিন্তু প্রধান নির্বাচক গণমাধ্যমে বলেছেন তারা একেক সিরিজে একেকজনকে খেলিয়ে দেখছেন, এখনো বিশ্বকাপের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসেনি।

যেমন, এ বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, আয়ার‍ল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ইয়াসির আলী রাব্বি এবং আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে লন্ডনে মেহেদী হাসান মিরাজ ৭ নম্বরে ব্যাট করেছেন।

এ তিনজনকেই প্রাথমিকভাবে ক্যান্ডিডেট মনে করা হচ্ছে, যদিও মিরাজের জায়গা নিশ্চিত হলেও বাকি দু’জনের জায়গা কোনো সিরিজের দলেই নিশ্চিত নয়।

এ তিনজন ছাড়াও আফিফ হোসেন ছিলেন ৭-তে খেলার দৌড়ে। চান্ডিকা হাথুরুসিংহে আফিফ হোসেনকে জাতীয় দল থেকে বাদ দিয়েছেন। সহজ ভাষায় তিনি বলে দিয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেই আফিফ হোসেনকে দলে ফিরতে হবে।

প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারের শুরুটা দারুণ ছিল, কিন্তু জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তিনি তার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি বলেই মনে করেন বাংলাদেশের জাতীয় দলের হেড কোচ।

শেষ ছয়টি ওয়ানডে ম্যাচে আফিফ মাত্র দু’বার ১০ এর ঘর পার করতে পেরেছেন।

তবে আফিফ হোসেন দুর্দান্ত এক ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলেছেন সম্প্রতি, ১৩ ইনিংসে তিনি ৫৫০ রান তুলেছেন, ৫৫ গড় ও ১১০ স্ট্রাইক রেটে।

তাই আফিফকে ভাবনা থেকে এখনই সরাচ্ছেন না নির্বাচকরা, পার্টটাইম বোলার হিসেবে অভিজ্ঞতা রয়েছে তার এবং একই সাথে চটপটে ফিল্ডার আফিফ।

এখানেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে পেছনে ফেলছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রিয়াদের এখন ৩৭ বছর বয়স, ফিল্ডিংয়ে গত এক দু‘বছর চোখে পড়ে এমন কিছু ভুল তিনি করেছেন।

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের স্ট্রাইক রেট ৭৭, এখানে খেলে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের স্ট্রাইক রেট ছিল ৮২, আফিফ হোসেনের ৮৫, সাব্বির রহমানের ৯১ এবং এর আগে নাসির হোসেনের ছিল ৮১।

তবে ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই পজিশনে রিয়াদের স্ট্রাইক রেট ছিল ৯৫।

এ সময়ে নুরুল হাসান সোহান ছাড়া কেউই এই গতিতে ব্যাট করতে পারেননি। তবে সোহান ৭ নম্বর পজিশনে খেলেছেন মাত্র দুটি ম্যাচ, তাই এটাকে বড় উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানো কঠিন।

সোহান ও সৈকতও আছেন ক্রিকেটারদের পুলে
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি মনে করেন, ‘মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য বিচারে এই দৌড়ে আছেন তবে একটা নাম আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি।’

সামি বলেন, বাংলাদেশে অনেক সময়ই এটা হয় নির্বাচকরা একটি ফরম্যাটের ফর্ম দেখে আর ‘আমরা আরেক ফরম্যাটে ক্রিকেটারকে বিবেচনা করি।’

‘একজনা ক্রিকেটারকে স্কোয়াড থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু সেই ফরম্যাটে সোহান খুব একটা খারাপ করেননি।’

৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে সোহান ৮২ গড় ও ৯৪ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন, অপরাজিত ছিলেন তিনটি ইনিংস।

এবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে নুরুল হাসান সোহানের অধিনায়কত্বে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব রানার আপ হয়েছে।

এই টুর্নামেন্টে ১৪ ইনিংস ব্যাট করে নুরুল হাসান সোহান ৫১১ রান তুলেছেন, পাঁচবার ফিফটি তুলেছেন তিনি, গড় ছিল ৫০ এর কাছাকাছি, স্ট্রাইক রেট ৯৪।

সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি মনে করেন, নুরুল হাসান সোহানের ওয়ানডে ফরম্যাটে রানের গতি বাড়িয়ে নেয়ার সামর্থ্য রয়েছে।

তবে স্কোয়াডে মুশফিকুর রহিম ও লিটন কুমার দাস, দু’জন অভিজ্ঞ উইকেটকিপার-ব্যাটার থাকার পরেও সোহানকে নেয়া হবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

এই ৭ নম্বরে খেলানোর জন্য মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও আছেন বিসিবির রাডারে। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘মোট ২৪ জন ক্রিকেটারের পুল আছে এখন জাতীয় দলে। এর মধ্য থেকেই ক্রিকেটার নির্বাচন করা হবে।’

সূত্র : বিবিসি