Naya Diganta

ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশ : একটি সমীক্ষা

ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশ : একটি সমীক্ষা।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে-পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া নামে। ইন্ডিয়া শুরু থেকেই পরিচালিত হচ্ছে ধর্মপ্রাণ হিন্দু নেতাদের মাধ্যমে তাদের হিন্দুত্ববাদ অনুসরণ করে এবং এখনও ৮৬ বছর যাবত দেশকে টিকিয়ে রেখেছে হিন্দুত্ববাদের নীতি কঠোরভাবে অনুসরণের মাধ্যমে। কাশ্মির, সিকিম ও আরো ১৩টি প্রিন্সলি স্টেট দখলে নিয়েছে। বশে রাখার চেষ্টা করছে আশপাশের সব দেশকে। চীনের মতো শক্তিশালী দেশের সাথে টেক্কা মেরে নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রেখেছে সাবলীলভাবে। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইউকে, রাশিয়া সব বিশ্বশক্তি ইন্ডিয়াকে তোয়াজ করে চলে। এখনো তারা তাদের ধর্মকে অত্যন্ত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। ধর্মবিরোধী একটি কাজও তারা করে না। একজন ধর্মগুরুকেও তারা আঘাত দেয় না। একের পর এক মসজিদ ভেঙে মন্দির করছে, মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন-নিপীড়ন করে দেশ ছাড়া করে যাচ্ছে। সাড়া বিশ্বের সব হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করছে। অন্যান্য দেশের হিন্দু সরকারপ্রধানরাও একই নীতি ও একই সুরে কথা বলছে। এত অত্যাচার নিপীড়নের পরও তাদের কেউ মৌলবাদী, সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয় না; আন্তর্জাতিক মহলও তাদেরকে নিষিদ্ধ তো দূরের কথা, একটি শব্দও তাদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করে না। দিন দিন তারা শক্তিশালীই হচ্ছে। কেননা, তারা তাদের দেশ চালাচ্ছে খাঁটি হিন্দুত্ববাদ দিয়ে; অর্থাৎ ডিজেলের গাড়ি ঠিকই খাঁটি ডিজেল দিয়ে চালিত হচ্ছে। তাই কোনো ম্যালফাংশন হচ্ছে না। তা ছাড়া, একজন ইন্ডিয়ান নাগরিকও খুঁজে পাওয়া যাবে না, হোক সে মুসলমান, যে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলে, কাজ করে। ভারতের আমলা, সামরিক বাহিনী, বিচারক, পুলিশ প্রশাসন ও জনগণ দেশপ্রেমিক, পাকিস্তান বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিবাজ ও ভোগবিলাসী নয়। অথচ, লোক দেখানো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পোস্টার কিন্তু ঠিকই ঝুলছে। সেই ১৯৪৭ থেকেই আমাদের দেশের অনেকে জিকির করছে যে, ইন্ডিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে! টুকরো তারা হয়নি, টুকরো হয়েছে পাকিস্তান।

অন্য দিকে, পাকিস্তানি তথাকথিত মুসলিম নেতারা দেশ পরিচালনায় শ্রেষ্ঠতম ধর্ম অনুসরণ করা তো দূরের কথা, তারা ইসলামবিরোধী সব কার্যকলাপের সাথেই জড়িত ছিল। তারা ইসলামের সাম্য-মৈত্রী, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কোনো কিছুকেই পরোয়া করত না। দেশে যে দল, নেতা ও মানুষ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের অনুসারী ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন তারাই রাষ্ট্রযন্ত্রের কঠোর নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ক্ষমতার দ্ব›দ্ব ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মুসলমানের সংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তানে ইসলামের কোনো আদর্শ অনুসরণ করেনি। মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ, প্রশাসনে আমলাদের দৌরাত্ম্য, কলোনিয়াল আইন চালু রাখা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অসম বণ্টন বিভাজনকে আরো শক্তিশালী করে। গ্রাম্য অর্থনীতি, কুটির শিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসার প্রতি নজর না দিয়ে শুধু শহরভিত্তিক কিছু ব্যবসায়ী, প্রশাসনিক ও সামরিক আমলাদের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি, বাড়ি দিয়ে শাসন চলে। মুসলমানরা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্ষমতা, অর্থ, বিলাসী জীবনযাপন, জনগণের হক নষ্ট করার কারণে মুসলিম রাষ্ট্রের অধঃপতন ঘটে। প্রজাহিতৈষী সরকারের অভাব, স্বৈরাচার ও রাজপ্রথা মুসলিম দেশগুলোর ধ্বংসের প্রধান কারণ। দেশের শাসনব্যবস্থায় ভিআইপি, ভিভিআইপি কুলীন শ্রেণী সৃষ্টি উন্নত মানবিক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রে অগ্রহণযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি বৈরিতা, শোষণ চলতে থাকে। সুতরাং যা হবার তা-ই হয়েছে। মাত্র ২৩ বছরের মাথায় মদ-নারীতে আসক্ত তথাকথিত মুসলিম সামরিক-বেসামরিক নেতারা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদেরই জাতভাই নিরীহ নাগরিকদের ওপর। মুসলিম মুখোশধারী মোনাফেক মানুষগুলো হঠাৎ হানাদার বাহিনীতে রূপ নেয়। গণহত্যা-নারী নির্যাতন কোনোটাই বাদ দেয়নি। অসংখ্য তথাকথিত মুসলমান পাওয়া যায়, যারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই পাকিস্তানও বিভক্ত হয়ে পড়ল। এখনো পাকিস্তানে চলছে সেই স্বৈরতন্ত্র বা শয়তানিতন্ত্র। ইয়াহিয়া, ভুট্টোর মতো নরপিশাচদের প্রেতাত্মা হয়ে নওয়াজ, শাহবাজ, জারদারি, বাজওয়া, আসিফ মুনিরদের আবির্ভাব ঘটেছে। নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে তারা আজ অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে নিজ দেশে বন্দী হায়েনা শাসকদের হাতে। সেই ১৯৭১-কেই তারা ফিরিয়ে এনেছে নিজ দেশে! নিয়তির কী নির্মম পরিহাস!

হায়েনাদের নির্মম থাবা থেকে মুক্ত হয়ে সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ। বিগত ৫৩ বছর যাবত আমরাই শাসন করছি আমাদের দেশকে। সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মা আবারো জেঁকে বসেছে। বিচার, প্রশাসন, আইন প্রণয়ন, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি কোথায় অবস্থান করছে! কী হচ্ছে বাংলাদেশে এখন! সেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মতোই অনৈতিক ইসলামবিরোধী পথই অনুসরণ করছে শাসক শ্রেণী। যদিও জনসংখ্যার ৯৩% মানুষ মুসলমান। ইসলামকে আজ পরিণত করা হয়েছে জঙ্গিবাদে। ইসলামী নেতারা বন্দিশালায়; ভণ্ডদের আস্ফালন সর্বত্র। চতুর্দিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার! শাসক শ্রেণী নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে মেজরিটি মানুষের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যারা দেশের মালিক। তারা দেশ চালাচ্ছে দেশবিরোধী পন্থায়। ইসলামী কায়দায় না চালিয়ে, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পন্থাই অনুসরণ করছে। অর্থাৎ, খাঁটি অকটেনের পরিবর্তে ভেজাল কেরোসিন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে গাড়ি। ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উভয় সরকার দেশের জনগণের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, মাড়িয়ে যাচ্ছে দেশের মালিক জনগণের সব আশা। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের, ৯০% আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও জনগণের দেশপ্রেমের অভাব, লোভ লালসা, দুর্নীতি ও অনইসলামিক চেতনা আমাদের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

পাকিস্তান টিকতে পারল না ২৩ বছর, বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ! অথচ ইন্ডিয়া টিকে আছে ৮৬ বছর যাবত; হয়েছে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী, পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। সুতরাং যারা বলছেন ইন্ডিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তারা দিবা স্বপ্ন দেখছেন। বরঞ্চ ইন্ডিয়াই আপনাদের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণকে বিভক্ত বা টুকরো টুকরো করে রেখেছে।

লেখক : নিরাপত্তার বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক
Email : hoque2515@gmail.com