Naya Diganta

কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি সে দিন

লেখক সালাহউদ্দিন বাবর।

একটি উদারনৈতিক রাষ্ট্রের শক্তি সামর্থ্যরে স্তম্ভ হচ্ছে সেখানকার শিক্ষিত ও বোধ মেধাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। এই মধ্যবিত্ত জনশক্তি হচ্ছে রাষ্ট্রের সব দিকে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম চালিকাশক্তি। রাষ্ট্রশক্তি সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বৈষম্য নিরসনের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ জ্ঞান-গরিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যুৎপত্তির জন্য দ্রুত সমাজে তার নির্দিষ্ট স্থানটি অধিকার করে এবং সব রকম প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সমাজের স্টিয়ারিংটা হাতের মুঠোয় নিতে সক্ষম হয়। তাদের অগ্রসর বোধ-ভাবনা দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধির পথনির্দেশ দিতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতার প্রায় এক দশক পর থেকেই এই মধ্যবিত্ত সমাজ অব্যাহতভাবে এগিয়ে আসতে থাকে। তবে শুধু সংখ্যায় নয় তাদের জ্ঞানের রাজ্যেও তারা আরো সমৃদ্ধ হতে থাকে। এই দুইয়ে এগিয়ে যাওয়ার পিছনে অনেক কারণ তো ছিলই। কিন্তু তার অন্যতম কারণ ছিল- সে সময় তাদের এগিয়ে আসার জন্য সম্মুখে ছিল একটা আশাবাদ, আরো ছিল উন্নত সমাজ বিনির্মাণে তাদের তথা মধ্যবিত্তের প্রয়োজন সমাজ রাষ্ট্র গভীরভাবে অনুভব করত এবং তাদের ভূমিকার মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি দিতো। সে সুবাদেই এই শ্রেণীর মানুষের, সমাজ রাষ্ট্রের প্রতি অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বও এগিয়েছিল মধ্যবিত্ত সমাজ। এই শ্রেণীর জন্যই বড় একটা ভোক্তা শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল যা কি না অর্থনীতির চাকা সম্মুখের দিকে ছুটতে শুরু করার নিয়ামক ছিল। কিন্তু গত প্রায় দেড় দশকে সমাজ রাষ্ট্রে অব্যবস্থা, অনিয়ম দূরাচারীদের উৎপাত দৌরাত্ম্য এবং কোভিড-১৯ পরবর্তীতে দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সে কারণে মানুষের আশা-ভরসার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে আঁধারে মিলিয়ে যায়। সে পরিস্থিতি তথা মানুষের আর্থিক দুর্যোগ দুর্বিপাক মোকাবেলা করার কোনো পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে পারেনি। তার জের টেনে চলছে সমাজ থেকে বিলীয়মান মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের অসংখ্য মানুষ। তার একটা দালিলিক প্রমাণ সম্প্রতি এক গবেষণা নিবন্ধে সবিস্তার প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, মানুষের আয় রোজগার নিত্যদিন কমছে অথচ সব ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিজনিত কারণে লাখো মানুষ তাদের একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যসহ নানান ভোগ্যপণ্য সংসারের তালিকা থেকে বাদ দিতে বা কৃচ্ছ্রতা অলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি একবেলা খেলে আরেক বেলার খাবার মতো কিছুই থাকছে না তাদের। এই মুহূর্তে এর প্রতিক্রিয়া আমরা খুব অনুভব করছি না বটে। কিন্তু বেলা শেষে দেখা যাবে দেশের হাজার হাজার মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগতে ভুগতে অসংখ্য মানুষের দেহে হাজারো রোগ শোক বাসা বাঁধবে। আমরা একটা অসুস্থ নির্বীর্য জাতিতে পরিণত হবো। এ থেকে ফেরানোর কোনো দায় বর্তমান কর্তৃপক্ষ অনুভব করছে না। সেই গবেষণায় আরো রয়েছে যে, মানুষ তাদের চিকিৎসাব্যয়ও ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।

উপরের কথাগুলো অবশ্য মুদ্রার একটা পিঠ। মুদ্রার অপর পিঠে ঘটছে এলাহি কাণ্ড। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে দ্রুত নিচের দিকে নামছে ঠিকই- কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ বিত্তবানদের বিলাসী জীবন আরো ভোগ সম্ভারে ভরে উঠছে। জানা গেছে, দেশের দুটো বড় শহরে উচ্চবিত্তের মানুষ নিয়তই তাদের গাড়ির মডেল পরিবর্তন করছে।
প্রতি মাসে সেই দুই শহরের বিত্তবানরা তাদের পুরনো মডেলের গাড়ি পাল্টে একেবারে হালফ্যাশনের গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছেন। এভাবে দু’শরও বেশি গাড়ি প্রতি ৩০ দিন অন্তর অন্তর রাস্তায় নামছে ঠিক সেই সময়, যখন দেশের মানুষ চরম কৃচ্ছ্রতার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে। অপর দিকে ধনীর দুলালরা অভিজাত সব হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাদ্যবিলাসে মত্ত। আমাদের দেশের যে সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ তথা সংবিধান সেটি কিন্তু এমন বৈষম্যের ঘোর প্রতিপক্ষ। কিন্তু এখন কোথায় কোন নির্দেশনা রয়েছে তার হদিস করার কারো কোনো সময় নেই। সবাই যেন কেবল তাদের আখের গোছানোর চিন্তায়। এভাবেই যদি সব কিছু চলতে থাকে তবে শত বছরেও এ দেশের চেহারা পরিবর্তনের আশা করার কোনো কারণ নেই। এই জাতির স্থপতির সব সাধ মরীচিকা হয়ে থাকবে। অথচ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে তাল রেখে অতীতে যেভাবে বাড়ছিল সকল শ্রেণীর মানুষের স্বপ্ন পূরণ সেই সাথে মধ্যবিত্তের সংখ্যাও স্ফীত হচ্ছিল। একই সাথে উচ্চ নিম্নবিত্তের বহু মানুষ অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে উপরে উঠে এসে মধ্যবিত্ত সমাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। এ সময় ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বঞ্চিত, দরিদ্র ও মেহনতি মানুষের পক্ষে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। রাজনীতিতে ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেও এগিয়েছিল মধ্যবিত্তরা। কিন্তু উপরে যে দুটো কারণের কথা বলা হয়েছে সেসব কারণে, বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্তের বিকাশ এখন কোথায়! বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিগত ২০ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমতে শুরু করেছিল। ফলে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে। এখন কিন্তু সেই ক্রমবিকাশ আর নেই। বরং এখন চরম অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক ছন্দপতনের কারণে মধ্যবিত্তের সংখ্যা উপর্যুপরি হ্রাস পেতে চলেছে। উল্লিখিত কারণে মধ্যবিত্তের আকার ছোট হয়ে পড়ায় রাজনীতিতে তথা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাদের সুদৃঢ় অবস্থান থাকছে না। সেখানে বুদ্ধিবৃত্তির লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটছে, তথা বুদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাপক ছন্দপতন ঘটেছে। সেসব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেধাবী সদস্যদের অনেকে দেশান্তরি হয়েছে অথবা বাইরে চলে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমন যে ধারা এখন চলছে, তার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। দেশে কেউই এখন আর আশাবাদ তৈরি করতে পারছে না। বাস্তবতা এই যে, সেটা তৈরি করার জন্য আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজনীয় ভ‚মিকা রাখতে কতটা আন্তরিক তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অথচ এভাবে যদি মেধা পাচার অব্যাহত থাকে তবে নিকট ভবিষ্যতে দেশ একটা মেধাশূন্য বিরান জনপদে পরিণত হবে। অথচ কর্তৃপক্ষের কাছে এটা পরিষ্কার, আজকের বিশ্বে উত্তর উত্তর এগিয়ে যাওয়ার যে যুদ্ধ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, সে যুদ্ধের প্রধান সেনা সামন্তরা হচ্ছেন মেধাসমৃদ্ধ সব মধ্যবিত্ত মানুষের দল। এখন অবশ্য সেসব মানুষকে এ জনপদে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাহলে যে যুদ্ধের কথা স্মরণ করেছি, সেখানে জাতিকে বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করা কতটা গ্লানিকর, সেটি বোঝার সামান্য জ্ঞানটুকু সবারই থাকার কথা। সেটা কী এখন দেখা যাচ্ছে! মহাসমরে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কী দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে আর।
এর আগে মধ্যবিত্তের ক্রমবিকাশের যে ধারণার কথা বলা হয়েছে তার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যার দিক থেকে অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে এই জনপদ মধ্যবিত্তের বিকাশমান তালিকায় বিশ্বে ১১তম স্থানে পৌঁছে যাবে। অথচ ২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৮তম স্থানে। এখন গবেষণা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহু নিচে নেমে গেছে। অথচ স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল, আগামী দশকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আওতাভুক্ত। ইন্দোনেশিয়া, মিসর, ভিয়েতনাম, মেক্সিকোসহ অন্যান্য দেশে অসংখ্য মানুষ আগামীতে মধ্যবিত্তে যুক্ত হবে।

কিন্তু দুঃখ আমরাই শুধু পিছিয়ে গেলাম। এর অন্যতম কারণ আমাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দূরদৃষ্টির অভাব, যথাসময়ে যথাযথ কাজটি করতে দক্ষতা সক্ষমতা পারঙ্গমতা দেখানোর ব্যাপারে আমরা অক্ষম হয়েছি। তাছাড়া আমরা ক্ষমতার রাজনীতিতেই যেন বিকারগ্রস্ত, অন্য কিছু ভাবার কোনো অবকাশ আর নেই। প্রশ্ন জাগে, আমাদের সোনালি সেই দিনগুলো আজ কোথায় হারিয়ে গেল।

এখানে একটা কথা খুবই জরুরি, প্রতিটি রাষ্ট্রই উল্লিখিত বোধ বিবেচনার আলোকে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের বর্তমান অবস্থান দৃঢ় করার সব প্রচেষ্টাই জারি রেখেছে। মূল্যায়ন করে দেখা গেছে। এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে না উচ্চবিত্তের কোনো অবদান রয়েছে না অন্য কারো আছে। সেজন্য একটা উদারনৈতিক রাষ্ট্র সবক্ষেত্রে মধ্যবিত্তকে একটি শক্ত স্তম্ভ হিসেবে ধরে সব ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সেই বিত্তের মানুষকে সবার সম্মুখে নিয়ে চলছে। আমরা এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা তো দূরের কথা এসব বিবেচনা আমাদের এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে। একটি সরকার আমলে সব কিছুই মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়, যখন তাকে জবাবদিহির আওতায় থাকতে হয়। একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব কিছুরই মূল্যায়ন ও অনুশীলন করতে হয়। কিন্তু সে সমাজ রাষ্ট্র এমন সব কিছুর বাইরে অবস্থান করে থাকে। তাকে আর তখন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত করা সম্ভব নয়। সেসব রাষ্ট্র তখন কর্তৃত্ববাদী ধারণার সাথে একীভূত হয়ে যায়। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে শৈলী এখন অনুসৃত হচ্ছে এই দুইয়ে কোনোটার মধ্যেই আমাদের ফেলা সম্ভব নয়। বলতে হয় বর্ণহারা এক দেশ। অনেকে এটাকে সুবিধাবাদী ব্যবস্থা হিসাবে ধরে নিতে পারেন বা দু’নৌকায় রাখার সাথেও তুলনা করতে পারেন এসব রাষ্ট্রের কিন্তু বিপদ হলে কেউ তাদের কাছে এসে দাঁড়াতে শতবার ভাববে। সব ‘বন্ধু’রাষ্ট্রই বুঝতে চাইবে প্রকৃতপক্ষে সে কতটা আমার বন্ধু আর কতটা তার প্রতিপক্ষের ঘনিষ্ঠ। এমন আচরণ শুধু পরাশক্তি করতে পারে। যাদের কারো ধার ধারতে হয় না। আমাদের ক্ষণে ক্ষণে আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ব ব্যাংক বা যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে পেছনে ছুটতে হয় ঋণ পাওয়া বা অনুদানের জন্য।

ndigantababar@gmail.com