Naya Diganta

যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান কি ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারবে?

রাশিয়ার মিসাইল ইউক্রেনের চেয়ে ঢের শক্তিশালী

নিচে থেকে ইউক্রেনের নির্দেশনাটা ছিল পরিষ্কার– রাশিয়ান এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান তাদের সিলকা এয়াক্র্যাফটের দিকে মিসাইল ছুঁড়েছে। পাইলট জানে যে জীবন বাঁচাতে তার এখন এই মিশন পরিত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই।

ইউক্রেনের পাইলট যার সাংকেতিক নাম ‘সিল্ক’ তার মিগ-২৯ বিমানটি দ্রুত নিচের দিকে নামিয়ে আনেন। এটা এতটাই নিচ দিয়ে উড়তে থাকে যে গাছের উপরটা পরিষ্কার দেখা যায়।

সোভিয়েত আমলে পুরনো এই বিমানে যখন সর্বোচ্চ গতিবেগ তোলা হয় তখন বিমানটি কাঁপতে থাকে।

সিল্ক বিভিন্ন টাওয়ার ও পাহাড় টপকে উড়ে চলে যায়, এই জায়গাগুলো সে আগেই মানচিত্রে দেখে রেখেছিল যাতে জরুরি প্রস্থান করা যায়।

“মাটি থেকে সামান্য উচ্চতায় উড়াটা সবচেয়ে কঠিন, সর্বোচ্চ মনোযোগ রাখতে হয়। আর যেহেতু খুব নিচ দিয়ে চলে তাই হঠাৎ নিরাপদে এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় ও স্থান কোনোটাই পাওয়া যায় না।”- বলেন সিল্ক।

সিল্কের ব্যবহৃত এমন জেট ফাইটারগুলো দিয়েই সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত ইউক্রেনের বাহিনী।

‘সিলকার’ মিশন হলো আকাশে রাশিয়া তাদের বিমান লক্ষ্য করে যে মিসাইলগুলো ছুড়ছে সেগুলো ঠেকানো। কিন্তু আসলে ইউক্রেনের এই পুরনো বিমানগুলো খুব সামান্য কিছুই করতে পারছে।

আরেক মিগ-২৯ পাইলট যার সাংকেতিক নাম ‘জাস’ বলছিলেন– “আমাদের প্রধান শত্রু হলো রাশিয়ান এসইউ-৩৫ ফাইটার জেট।”

“রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষার অবস্থান সম্পর্কে আমরা অবগত, তাদের সীমানাও আমরা জানি। এটা অনুমান করা খুবই সহজ, ফলে সেভাবে আমরা হিসাব কষতে পারি যে কতক্ষণ তাদের অঞ্চলে আমরা থাকতে পারবো। কিন্তু ফাইটারের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। তারা দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, সবটা পরিষ্কার দেখতে পারে, তারা সহজেই জেনে যায় যে কখন আমরা উড়ে সামনা-সামনি যাবো।”

রাশিয়া যখন থেকে তাদের দেশে অভিযান শুরু করেছে, ইউক্রেনের বিমান বাহিনী তখন থেকে মারাত্মক ক্ষতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-যদিও এ ব্যাপারে কোনো পরিসংখ্যান তারা কখনো প্রকাশ করেনি।

রাশিয়ার দাবি তারা চারশোর বেশি ইউক্রেনিয়ান বিমান ধ্বংস করেছে। কিন্তু এটা অসম্ভব মনে হয়। কারণ নিরপেক্ষ হিসেবে জানা যায় ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর মোট বিমানের সংখ্যাই এর অর্ধেকের মতো।

দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মিলিটারি ব্যালান্স ২০২২ এর হিসাব বলছে, রাশিয়া পুরোদমে সামরিক অভিযান শুরুর আগে ইউক্রেনের কাছে ১২৪টি যুদ্ধবিমান ছিল।

বিমান যুদ্ধে রাশিয়ার সমকক্ষ হতে, ইউক্রেন তাদের পশ্চিমা মিত্রদের কাছে ইউএস এফ-১৬ মাল্টি-রোল ফাইটার জেটের মতো আধুনিক যুদ্ধবিমান চেয়ে আসছে।

“আমাদের পাইলটদের ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে উড়তে হয়,” বলেন ইউক্রেন বিমান বাহিনীর এভিয়েশন উন্নয়ন বিভাগের প্রধান কর্নেল ভলোদোমির লোগাশভ। “এফ-১৬ বিমান আমাদের শত্রুদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।”

এই বিমানগুলোর মিসাইল ১৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, ফলে ইউক্রেন বাহিনী রাশিয়ান এয়ারক্র্যাফটকে আক্রমণেও সক্ষম হবে।

“অবশ্যই আমরাও আগের মতো তাদের নিশানা হব”– বলছিলেন জাস।

তবে এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলোর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রাডার ধেয়ে আসা মিসাইল শনাক্ত করতে পারে। বর্তমানে যে কোনো বিপদ দেখতে পেলে নিচে কাজ করা ইউক্রেনিয়ান গ্রাউন্ড টিম পাইলটদের মুখে মুখে সতর্ক করে দেয়।

“আমাদের বিমানে স্বয়ংক্রিয় সতর্কতার ব্যবস্থা নেই। সবকিছু ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের উপর নির্ভরশীল। আপনি যদি দেখতে পান তাহলে হিট ট্র্যাপ চালু করে ও একেঁবেকেঁ পালানোর চেষ্টা করতে হবে।”– বলছিলেন এসইউ-২৫ অ্যাটাক এয়ারক্র্যাফট চালানো একজন পাইলট।

যেহেতু রাশিয়া আকাশপথে অনেক বেশি এগিয়ে, তাই সম্মুখযুদ্ধে ইউক্রেন খুব অল্পকিছু যুদ্ধবিমান পাঠাতে পারে, যা দিয়ে ভবিষ্যতে যে কোনো পাল্টা আক্রমণে সফলতা পাওয়া কঠিন হবে তাদের জন্য।

জাস বলেন, তারা রাশিয়ান বিমান বাহিনীর তুলনায় ২০ গুণ কম বিমান উড়ায়। আর ইউক্রেনের যুদ্ধ বিমানগুলোতে থাকে সোভিয়েত আমলের বোমা ও দিশাহীন মিসাইল। এছাড়া এগুলোর পরিমাণ কম হওয়ায় দ্রুত ফুরিয়েও যায়।

তাদের সামরিক বাহিনী বলছে পশ্চিমা এয়ারক্র্যাফট পেলে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো মজবুত হবে।

কর্ণেল লোগাশভের ব্যাখ্যা- “আমাদের বিমানের রাডারগুলো পুরনো যা রাশিয়ান ক্রুজ মিসাইল শনাক্ত করতে পারে না। অনেকটা অন্ধ বিড়ালের মতো আমরা তাদের দিকে গোলা ছোঁড়ার চেষ্টা করি।”

এফ-১৬ যুদ্ধবিমানে থাকা পশ্চিমা অস্ত্র সরঞ্জাম দিয়ে অনেক দূর একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি থাকতেই ক্রুজ মিসাইল শনাক্ত করা যাবে বলে মনে করেন জুস। ফলে তাদের আর ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলে এসে এগুলো ধরার চেষ্টা করতে হবে না।

সম্প্রতি মিগ-২৯ বিমান ইউক্রেনে পাঠিয়েছে পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া।

কিন্তু এতে তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে বলে মনে করেন না ইউক্রেনের পাইলটরা। কারণ এই বিমানগুলোর অবস্থাও সেই একই, পুরনো সব অস্ত্র সরঞ্জাম ও কার্যক্রম ইউক্রেনের বিমানগুলোর মতোই।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এখনি ইউক্রেনে এফ-১৬ পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা নেই, তাদের শঙ্কা এতে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।

এছাড়া এসব বিমান চালাতে ইউক্রেনের পাইলটদের প্রশিক্ষণ বিষয়টি এখনো অনুমোদন পায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রে ডেপুটি ডিফেন্স সেক্রেটারি কলিন কাল বলেন, যদি এরকম কোন সিদ্ধান্ত নেয়াও হয়, তাহলেও ইউক্রেনে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পাঠাতে দেড় বছর লেগে যাবে। তাই এত আগে পাইলটদের প্রশিক্ষণের কোনো মানে নেই।

তবে কিয়েভের আশা ইউরোপিয়ান দেশগুলো থেকে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। এজন্যও যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন লাগবে, তবে প্রক্রিয়াটা অনেক দ্রুততম হবে।

চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য “আমরা অল্প কিছু লোককে সীমিত সময়ের জন্য পাঠাতে পারবো, যাতে এদিকে আমাদের সামরিক শক্তি কমে না যায়,” বলেন কর্নেল লোগাশভ।

"এজন্য আমরা চাই এখন থেকেই ছোট ছোট দল পাঠাতে যাতে যখন বিমান এসে পৌঁছাবে সেই সময়টায় আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত চালক থাকে।"

যেটাই হোক এটা পরিষ্কার যে এই বিমানগুলো ইউক্রেনের যে পাল্টা আক্রমণ শুরুর কথা বলা হচ্ছে তার আগে এসে পৌঁছাবে না। প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কি ইতোমধ্যে বলেছেন ইউক্রেন পশ্চিমা দেশগুলোর এফ-১৬ পাঠানোর আশায় বসে থাকবে না বরং তাদের ছাড়াই আক্রমণ শুরু করবে।

তবে এফ-১৬ যে যুদ্ধের গতিপথ একেবারে বদলে দেবে সে নিয়ে কিছু বিশেষজ্ঞের সন্দেহ আছে।

জাস্টিন ব্রঙ্ক, যিনি রয়্যাল জয়েন্ট ডিফেন্স রিসার্চ ইন্সটিটিউটের একজন রিসার্চ ফেলো ও যুদ্ধ বিমান বিশেষজ্ঞ, বলছিলেন “এই বিমানগুলো বাড়তি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যুক্ত করবে হয়তো কিন্তু যুদ্ধে প্রকৃতি বদলাতে পারবে না।”

এমনকি এফ-১৬ বিমানগুলো নিয়েও “ইউক্রেনের পাইলটদের রাশিয়ান হামলা থেকে বাঁচতে সম্মুখযুদ্ধের সময় অনেক নিচ দিয়ে উড়তে হবে, যা এর মিসাইল নিক্ষেপের ক্ষমতাও কমিয়ে দেবে।”-ব্যাখ্যা করেন প্রফেসর ব্রঙ্ক। “এটি দিয়ে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান ও ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।”

এফ-১৬ নিয়ে আরো সমস্যা আছে। শুধু চালক ও মেকানিকদের প্রশিক্ষণ দিলেই হল না, আপনার সামরিক কাঠামোরও উন্নতি আনতে হবে।

এফ-১৬ তৈরিই হয়েছে একেবারে সমান ও লম্বা রানওয়ের জন্য। ইউক্রেনের বর্তমান যে এয়ার ফিল্ড রয়েছে সেটার মেরামত করে আরো বর্ধিত করতে হবে এর উপযোগী করতে।

“কিন্তু রাশিয়ানরা গোয়েন্দা সূত্র ব্যবহার করে এটি ওপর থেকে দেখতে পাবে এবং হামলা চালাবে” বলেন প্রফেসর ব্রঙ্ক।

“তাই প্রশ্ন হলো- যে পরিমাণ প্রশিক্ষিত জনবল, রাজনৈতিক চেষ্টা ও অন্যান্য সহায়তা এক্ষেত্রে দিতে হচ্ছে সেটা কি অন্য দিক যেমন ট্যাঙ্ক, কামান বা গ্রাউন্ড বেজড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ক্ষেত্রে দেয়া যেতো না?”

আপাতত ইউক্রেনের পাইলটদের নির্ভর করতে হচ্ছে সোভিয়েত আমলের ফাইটার ও অ্যাটাক এয়ারক্র্যাফটের ওপরই।

যেগুলোর কোনোটা হয়তো ১০০ বারে বেশি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এ পাইলটরা জানে যে প্রতিটি যুদ্ধ আসলে তাদের শেষ যুদ্ধ হতে পারে। সূত্র : বিবিসি