Naya Diganta

ব্যালটে নির্বাচন হওয়াই যথেষ্ট নয়

ব্যালটে নির্বাচন হওয়াই যথেষ্ট নয়।

উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রচেষ্টা প্রকৃতপক্ষে পলায়নপর মানসিকতারই পরিচায়ক। দেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রায়ই এমন করে থাকে। অতীতে অনেকবার এমন প্রমাণ রয়েছে। তাদের (ইসির) কোনো স্খলন, অদক্ষতা, দূরদর্শিতার অভাব অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ‘সাফসুতরা’ বলে প্রমাণ করার প্রচেষ্টাই করে। একেবারে হালে চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে তাদের সেই একই আচরণ পরিলক্ষিত হলো।

পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ পেয়েছে, ইসিই সেই একই অজুহাত তুলেছে। প্রকাশিত সেই খবরটির শিরোনাম হচ্ছে ভোটার (চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে) ‘উপস্থিতি খুব কম। কমিশন দুষলেন দুই প্রার্থীকে।’ এই উপনির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ। রাজনীতিকরা মনে করেন, সংখ্যা আরো কমই হবে।ভোটারদের এমন উপস্থিতি আসলে এই নির্বাচনকে অর্থহীন করে তুলেছে বলে অনেকে মনে করেন। স্মরণ করা যেতে পারে, এ আসনে নির্বাচনেও মাত্র ২৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সেই সংখ্যাও কিন্তু উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয় নয়।
এবারের উপনির্বাচনে এত কম ভোট পড়ল কেন, সেটা নিয়ে চলছে আলোচনা পর্যালোচনা। অপর দিকে নির্বাচন কমিশন এই প্রশ্নে প্রধান দুই প্রার্থীকে দুষলেন। দুই প্রার্থীর শোডাউনের কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে সাহস করেনি। তবে প্রধান দুই প্রার্থীসহ অন্য প্রার্থীদের অভিযোগের তীর কিন্তু কমিশনের দিকে। তারা যেসব অভিযোগ তুলেছেন তা এমন, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি বসানোর দাবি ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। ভোটারদের ভয়ভীতি দূর করার জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ ইসির সক্ষমতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন অযোগ্য ও মেরুদণ্ডহীন, এই নির্বাচন কমিশন যে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে না, তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করবে, কিন্তু সেটা হয়নি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে এবার তার উত্তরণ ঘটবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। অভিযোগ আরো আছে, যেমন ভোটকেন্দ্রে ‘ভূত’ আসতে না পারে, সেজন্য সিসিটিভি দেয়ার অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া কোনো এক প্রার্থীর নেতাকর্মী ও এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী (সরকারি দলের) প্রার্থীর লোকজন নানা হুমকি ধমকি দিয়েছে। ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না আসে সেজন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। মূলত এসব কারণেই ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অস্বাভাবিক কম। এক প্রার্থী এও দাবি করেন, এই উপনির্বাচনে ৫ থেকে সর্বোচ্চ মাত্র ৭ শতাংশ ভোট পড়েছে।

এসব অভিযোগের বাইরে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, প্রকৃতপক্ষে ইসি তাদের স্বাধীন সত্তাকে সপ্রমাণ করতে অতীতে যেমন পারেনি, এবারও পারল না, ভবিষ্যতে পারবে সেটা কোনোভাবেই আস্থা রাখার পর্যায়ে নেই। ক্ষমতাসীনদের যে অপছায়া কমিশনের ওপর রয়েছে, তা থেকে তাদের বেরিয়ে আসার ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান থাকার বিষয়টি এখনো রয়েই গেল। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান যে বিপুল ক্ষমতা তাদের (ইসি) দিয়েছে, সেটা তারা অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেজন্য এখনো নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন আর জটিলতা থাকছে। একটু ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে বলা যাবে, তাদের ব্যর্থতাজনিত কারণে বাংলাদেশের নির্বাচনে যে ম্যালপ্রাক্টিস হচ্ছে। সেটা যেমন গোটা দেশের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশবাসীকে হতাশা ও বিপর্যয়ের দ্বারে নিয়ে গেছে, তেমনি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে। বহু দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অমর্যাদাকর যত বক্তব্য বিবৃতি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যা ক্ষমতাসীনদের তেমন স্পর্শ করতে পারছে না।

চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে দেখা যেতে পারে সম্প্রতি ইসির একটি সিদ্ধান্তের বিষয়। কিছুকাল আগে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হবে। এটি একটি নির্দোষ ঘোষণা হলেও তা সাধারণ মানুষের মধ্যেও, সেই সাথে বোদ্ধা সমাজের ভেতর ব্যাপক কৌত‚হলের জন্ম দিয়েছে। কেননা যে ইসি এতকাল ইভিএমের (যাকে বহু মানুষ জাদুর বাক্স বলে। কেননা কোনো মন্ত্র পড়লেই এর দ্বারা নির্বাচনের ফলাফলে নাকি দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে দেয়া যায়) মাধ্যমেই ভোটগ্রহণ করা হবে বলে সারাক্ষণ এমন যপতপ করত, অবাক করার বিষয়, তারা হঠাৎ করে কেন মত পাল্টে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করার কথা বলল? ইসির এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, ইতোপূর্বে যারা ব্যালটে ভোট করা নিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, তাদের এখন এ কথা বলে অনেককে ভোটে আসতে প্রলুব্ধ করার একটি কৌশল হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে সব মহলের নানা ওজর আপত্তি ছিল, তার বড় একটা ‘অবস্ট্রাগল’ সরিয়ে দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করার প্রয়াসই হতে পারে।

অপর দিকে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন, ব্যালটে ভোট নেয়া উচিত বলে যারা মনে করতেন, অবশ্য তাদের এটা একটি বড় দাবি ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের মৌলিক দাবিটা কিন্তু আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। ভোট ব্যালটে হবে এটি বললেই যে নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যাবে এর কোনোই নিশ্চয়তা নেই। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই, এই সিদ্ধান্তের ফলে সবাই সাধু হয়ে যাবে। এর আগেও ব্যালটে ভোট হয়েছে, কিন্তু সেখানে নির্বাচনে জনগণের পক্ষে নিরাপদভাবে এবং সুষ্ঠুভাবে ভোট দেয়ার মতো পরিবেশ কিন্তু সৃষ্টি হয়নি। সেজন্য ব্যালটে ভোট হলেই ভালো পরিবেশ রাতারাতি তৈরি হয়ে যাবে তা ভাবার কোনো অবকাশই নেই। সেজন্য এমন একটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতায় থাকতে হবে (যাকে সবাই নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকার বলে মনে করে), তাদেরই ক্ষমতায় থাকতে হবে যেহেতু তারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে আলোকে যা কিছু করা দরকার সবটাই তারা করবেন। বিশেষ করে বারবার এটি প্রমাণ হয়েছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন একেবারেই অক্ষম। প্রশ্নমুক্ত কোনো নির্বাচন করার সক্ষমতা তাদের নেই। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নিয়ে যদি মনে করেন, ভালো নির্বাচনের জন্য এই ইসিকে পাল্টে উপযুক্ত ইসি গঠন করবে, তবে সেটাই হবে যুক্তিযুক্ত। প্রশাসনকে যদি ঢেলে সাজানোর প্রশ্ন আসে তাহলে সেটাই তাদের করতে হবে। কেননা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন একান্ত জরুরি। তাছাড়া আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যা সম্পন্ন করতে না পারলে ভালো নির্বাচন করা কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়। সেসব করার জন্য সেই সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।

নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান এতটা ক্ষমতা কর্তৃত্ব করার অধিকার দিয়েছে তার একটা সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সবাই জানেন যে, ভালো বীজ বুনলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তেমনি একটি ভালো নির্বাচন হলে এর অনেক ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে রাষ্ট্রীয় জীবনে। যেমন যোগ্য এবং জনগণের পছন্দের প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারেন, আর জনগণের হিসাব নিকাশ কিন্তু পাকা, অত্যন্ত পোক্ত। একটি ভালো সংসদ হলে অবশ্যই যোগ্য দক্ষ মন্ত্রিসভা হবে। তারা জবাবদিহিমূলক প্রশাসন কায়েম করতে পারবে। তখন সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সংসদকে কার্যকর ও প্রাণবন্ত করে তুলতে পারবে। এসবই নির্ভর করে কেবল একটি ভালো নির্বাচন হলেই। তেমন নির্বাচন ভালো হওয়া নির্ভর করে কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ওপরই। সেজন্য বিষয়টি নিয়ে সবাইকে এই মুহূর্তে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এমন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে যে প্রশাসন কায়েম হবে তারা দেশের জন্য কল্যাণ করবে। কেবল তাই নয়, আন্তর্জাতিক বলয়ে এখন বাংলাদেশের যে বিপর্যস্ত ভাবমর্যাদা তারও মেরামত সম্ভব হতে পারে। সবশেষে এটা বলছি যে, এ কথা সবার মনের গভীরে ও জীবনাচরণে প্রোথিত করতে হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ভিন্ন আমাদের পরিত্রাণের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

ndigantababar@gmail.com