Naya Diganta

এখন আলো বিচ্ছুরণেরই সময়

আশ্বাস প্রতিজ্ঞা প্রতিশ্রুতি প্রদান, প্রত্যয় ব্যক্ত করার পর। সেসব অঙ্গীকারের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা তখনই জন্মাতে পারে যখন দেখা যাবে ওই সব ‘কমিটমেন্টে’ বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটছে। তবে চমৎকার সেই কথাগুলো যদি নিছক বায়বীয় হয়েই ওঠে, সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে, সকল পর্যায়ে আস্থার ভিত নড়ে উঠছে, দুলছে। তখন দুঃখ হতাশাই কেবল জন্ম নেবে, তাই নয়। অচিরেই মানুষ আশা ভঙ্গের কারণে মানুষের ভেতর হতাশা সৃষ্টি, ক্ষুব্ধও হয়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। এমনও হতে পারে, ভবিষ্যতে অর্থপূর্ণ কোনো বক্তব্য দেয়া হলেও সেটি হাসি-তামাশার ব্যাপার বলে সবার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে। কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে না।

কিছুকাল পূর্বে অত্যন্ত স্পষ্ট করে পরিষ্কার ভাষায় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, জনগণের কল্যাণে ও প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব কিছু করা হবে। এই চমৎকার বক্তব্যের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত করার অবকাশ থাকতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘সম্ভাব্য সব কিছু করার’ সীমা পরিসীমা কতটা এবং কী। আর জনগণের প্রয়োজন কোনটি সেটিই বা নির্ণয় করবে কোন সংস্থা। দূর আকাশ থেকে পাখির চোখে যা কিছু দেখা হয় সেটি কোনোক্রমেই পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। এ জন্য জনগণের সাথে থেকে নিবিড়ভাবে তাদের চাওয়া-পাওয়াকে বুঝতে ও দেখতে হয়। শুধু এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলেই জনগণের মর্মের কথা শোনা, বোঝা ও তাদের সত্যিকার প্রয়োজনটা বিবেচনায় নেয়া সম্ভব হবে। হঠাৎ করে, হুট করে কেউ এক দিন মুহূর্তের মধ্যে সব দেখা বোঝার কথা বলা হয়। তা কিন্তু সঠিক পর্যবেক্ষণের নীতি-পদ্ধতি হওয়া ঠিক নয়। এমন মুহূর্তেই কোনো কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া বা কথা বলা দায়িত্ব পালনের কোনো বাস্তবসম্মত উপায় হতে পারে না। এটা একটা চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন, দেশে এখনো সে ব্যবস্থার কোনো অনুশীলন নেই। কোকিল যেমন কেবল শীত মৌসুমে এ দেশে অতিথি হিসেবে হাজির হয়; ঠিক তেমনি এখানে মানুষের প্রয়োজনের কথা, ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহের কথা বলে কেবল মৌসুমভিত্তিকই উচ্চারণ। কিন্তু বছরব্যাপী তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। এতে যা হয়, সেটি কেবল বাকসর্বস্ব বা বাগাড়ম্বরের ব্যাপার। যেকোনো সিদ্ধান্তের সময় বিভিন্ন জনের মত নিতে হয়। হঠাৎ মনে হলো, এখন কিছু বলা দরকার, সে জন্য কিছু বলা কওয়া। এসবের কোনো অর্থ হয় না। তার পর সব প্রতিশ্রুতিই অন্তঃসারশূন্য বলে প্রতীয়মান হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক একটা গবেষণাপত্রের ফাইন্ডিং তথা তথ্য এখানে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে; যাতে দেশের মানুষ বুঝতে পারেন, এসব গবেষণার তথ্য-উপাত্ত কতটা জীবনঘনিষ্ঠ। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে সেই গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, যা এখানে তুলে ধরা হলো। ‘গ্রাম বা শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় রোজগারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও গত কয়েক মাসের ব্যবধানে তাদের ব্যয় ও খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। ছয় মাসের ব্যবধানে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর খরচ ১৩-১৪ শতাংশ বেড়েছে; পক্ষান্তরে, তাদের আয় কমেছে। সে কারণে নিম্ন আয়ের ৯০ শতাংশের বেশি পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন তথা কাটছাঁট করেছে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, গোশত খাওয়া কমিয়েছে ৯৬ শতাংশ পরিবার, মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার, ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ পরিবারের মানুষ, তেল খাওয়া কমিয়েছে ৮১ শতাংশ মানুষ, চাল খাওয়া হ্রাস করেছে ৩৭ শতাংশ পরিবার, আটা খাওয়া কমিয়েছে ৫৭ শতাংশ মানুষ। নি¤œ আয়ের অনেক পরিবার মাঝে মধ্যে একবেলা কম খেয়ে থাকেন। অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারকে সঞ্চয় ভেঙে বা ঋণ করে চলতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমিয়েছে।

এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। দেশের ৮ বিভাগে এই জরিপ পরিচালিত হয়, ৯ থেকে ১৮ মার্চ ’২৩ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে।

এর সাথে আরো একটি গবেষণালব্ধ তথ্য এখানে সংযোজন করলে হয়তো আরো একটা চিত্র পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে।

উল্লিখিত গবেষণার তথ্য নিয়ে অপর এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে ‘সুখী দেশের তালিকায় পেছাল বাংলাদেশ’। সে রিপোর্টে রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস উপলক্ষে জাতিসঙ্ঘের প্রকাশিত সুখী দেশের তালিকায় পিছিয়েছে বাংলাদেশ।’ সম্প্রতি প্রকাশিত ওই তালিকার ১৩৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮তম। গত বছর ১৪৭ দেশের মধ্যে ৯৪ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর ২০১১ সালের প্রতিবেদনে ১৪৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০১তম। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস-২০২৩ এ প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেখা গেছে।

এ কথা কারো ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন স্বদেশ ভূমি হিসেবে পাওয়ার জন্য যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নের রূপকার ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও সর্বোচ্চ ‘সেক্রিফাইস’ কারো ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। তার অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা প্রদর্শনের সর্বোকৃষ্ট প্রয়াস হতে পারে। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য স্বাধীনতা এসেছে। তার সেই বক্তব্যের পর ৫২ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজকের হাল অবস্থা কতটা সঙ্গীন হয়েছে, সেটি উপরে উক্ত দুই গবেষণাপত্রে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আর কথা বাড়ানোর কোনো অর্থ আছে বলে মনে করি না।

তিনি স্বাধীনতার পরপরই সময়ের উপযোগী করে জাতিকে একটি চমৎকার সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন যাতে একটি বিধিবিধান ও সংবিধানের আলোকে দেশ পরিচালিত হতে পারে। আজকে খুব সততা নিয়ে কারো পক্ষে এ কথা বলা সম্ভব নয় যে, দেশ এখন ঠিক সেভাবে সংবিধানকে পাশে নিয়ে চলছে। আমাদের চলার পথ ও সংবিধানের দিকনির্দেশনার মধ্যে এখন দূরত্ব এতটাই তৈরি হয়েছে, যাকে বলা যায় যোজনের ব্যবধান। বঙ্গবন্ধু তার জীবিতকালে এটাও দেখিয়ে গেছেন, প্রয়োজনের নিরিখে এই মহান আইন গ্রন্থটি সংশোধন করা যেতে পারে। অথচ দেশের বর্তমান প্রয়োজনের দিকে লক্ষ করলে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য জাতি এখন উন্মুখ আছে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ বা সংশোধনীর জন্য। অথচ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নির্বাহী এ ব্যাপারে কোনো সায় দিচ্ছেন না। সেটি করা হলে কিন্তু অসংখ্য মানুষের রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষিত হতে পারত। জনগণের অধিকার সংরক্ষিত হলো কি হলো না তা আজ আর হয়তো দাবি অগ্রাহ্য হলে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মারাত্মক অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। বিষয়টি উপলব্ধি করে পক্ষ শক্তি দেশের ও দশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত হবে বলে দেশের মানুষই শুধু নয়- আমাদের আন্তর্জাতিক বলয়ের অধিকাংশ বন্ধু সুহৃদরা তাই মনে করছেন।

সেই সাথে এ কথা কারো ভুলে থাকা ঠিক হবে না যে, জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক পূর্ব শর্ত হচ্ছে, সেই কাঙ্ক্ষিত সংশোধনী গৃহীত হওয়ার ওপর। সেখানে যদি কোনো ব্যত্যয় ঘটে, তাতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত হতে না পারে, তবে তার পরিণতি হবে অকল্পনীয়। দেশের গণতন্ত্র শুধু তমসাচ্ছন্ন হবে না। জাতীয় অর্থনীতি আরো দ্রুতগতিতে তলানিকে অতিক্রম করে এক ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে। রাজনীতি সমাজ নীতি ঘোর অমানিশার অন্ধকারে হারাবে। সর্বত্র এক ভয়ঙ্কর শূন্যতা-অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকবে। এসবের যোগফল হবে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে।

আপাতত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি ‘ভুলক্রমেই’ হয়তো মনে করছে, এমন পদক্ষেপ (নির্বাচনকালীন সরকার) তাদের রাজনৈতিক পরিপন্থী হতে পারে। আমরা বিনয়ের সাথে এ কথা বলতে চাই, অতীতে সে একই রকম ব্যর্থতায় দেড় দশকের বেশি সময় থেকে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। অথচ ক্ষমতাসীনরা এখন নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থাকে তাদের স্বার্থের প্রতিকূলে বলে সাব্যস্ত করে বসে আছেন। আজ যদি তাদের সেই ব্যবস্থা সম্পন্ন না করে চলে যেতে হয় তবে আগামীতে কিন্তু তাদের দারুণভাবে পস্তাতে হবে।

এ কথা আজ কেউ-ই অস্বীকার করতে বা দ্বিমত করতে পারবে না বাংলাদেশের জন্মের অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও। আজো ক্ষমতা গ্রহণ ও হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো সিস্টেম বা পথ পদ্ধতি স্থিরীকৃত করতে সক্ষম হইনি আমরা। অতীতে যা কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, তা-ও অদূরদর্শিতার জন্য ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এতে আপাতত রাজনৈতিক শক্তির স্বার্থ রক্ষিত হলেও দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার এক বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। সন্দেহ নেই, ক্ষমতা ত্যাগ করা ও নতুন কারো ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়, যা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ জন্য এতটা সময় জাতীয় জীবন থেকে মুছে ফেলার জন্য যার যতটুকু ভূমিকা তা অবশ্যই ভবিষ্যতে নিক্তিতে তোলা হবে। এ জন্য যার যতটুকু ‘অবদান’ (!) রয়েছে, তার জন্য আসলে পস্তাতে হবেই। সেই সাথে এ কথা সত্য, যারা এ জন্য যতটুকু ইতিবাচক ছিলেন সেটি কেউ ভুলে যাবেন না।

আজকে একটা বিষয় অত্যন্ত অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক ব্যক্তি যাদের মনে করা হতো জাতির ‘বাতি ঘর’, যারা জাতির দুঃসময়ে আলো হাতে নিয়ে সবার সম্মুখে থাকবেন, যাদের বিবেচনায় অবশ্যই দেশ দশের কথা থাকবে, তারা দূর আকাশের ধ্রুব তারার মতো একা আশাজাগানিয়া সুর তুলে দেহ মনকে প্রশান্তি এনে দেবেন। কিন্তু এখন তারা মর্ত্যেেনমে এসে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকছেন’। তারা তো স্মরণীয় বরণীয়; তাদের হারানোর কিছু নেই, অতীতে মানুষের অনেক শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেয়েছেন, এখন আর কি বা তাদের পাওয়ার বাকি? জাতির এমন দুঃসময়ে ব্যক্তি-দল-গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায্য কথা বলাই সময়ের দাবি। তাদের আলো বিচ্ছুরণ করার সময় এখনই।

ndigantababar@gmail.com