Naya Diganta
বিবিএসের রহস্যজনক জরিপ

সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন কী

বিবিএসের রহস্যজনক জরিপ


বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা জনস্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে তা নিয়ে ক্রমেই প্রশ্ন উঠছে। এগুলো জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের তাগিদে কার্যক্রম চালনার পরিবর্তে সরকারের উদ্দেশ্য পূরণে নিয়োজিত বলে মনে হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানকে আগেই অকেজো করে দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্র মানবাধিকার ও দুর্নীতি রোধে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এর মধ্যে পড়ে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোরও একই পরিণতি হতে চলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে বেকারত্বের হার নিয়ে জরিপ প্রকাশ করেছে। তাতে নানা অসঙ্গতি ও অযৌক্তিক তথ্য-উপাত্ত পরিবেশনের অভিযোগ উঠেছে। জরিপে বলা হয়েছে, দেশে বেকারের সংখ্যা কমেছে। কেবল সরকারের পক্ষে ইতিবাচক প্রচারণার অংশ হিসেবেই এই জরিপ কিনা এমন সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
গত বুধবার বিবিএস শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় ২০২২-এ বেকারত্বের হার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। বেকার কমেছে ৭০ হাজার। নতুন জরিপে, শ্রমশক্তির মধ্যে কৃষি খাতে তিন কোটি ২২ লাখ, শিল্পে এক কোটি ২০ লাখ পাঁচ হাজার ও সেবা খাতে দুই কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিয়োজিত। জরিপ অনুযায়ী, এই সময়ে কৃষি ও সেবা খাতে নিয়োগ বেড়েছে। আরো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬.৩ থেকে বেড়ে ৪২.৬৮ শতাংশ হয়েছে। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দাবি করা হয়, করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও বেকারত্বের হার কমেছে। বেকার পুরুষের সংখ্যা ১৬ লাখ ৯০ হাজার ও বেকার নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার।


দেশের বিরাজমান আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে এই জরিপের সামঞ্জস্য পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। জরিপটি চালানো হয়েছে ধনী দেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে বেকারদের ভাতা দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ পেলে তাকে কর্মে নিয়োজিত হিসাবে ধরা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) বেকারত্ব নির্ণয়ে ব্যবহৃত জরিপ নীতির অংশ। ওইসব দেশে এক ঘণ্টার যে মজুরি তা দিয়ে জীবন ধারণের ব্যয় কিছুটা হলেও মেটে। আমাদের দেশে এক ঘণ্টার কাজে তেমন অর্থ আসে না। কেউ পরিবারে হাঁস-মুরগি পালন করলেও জরিপে তাকে কর্মরত ধরা হয়েছে। এ ছাড়া জরিপের অসঙ্গতির চিত্র স্পষ্ট হয় শিল্প খাতে শ্রমিক কমে গিয়ে কৃষি খাতে বৃদ্ধির প্রবণতায়। করোনার কারণে শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাই হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এ শ্রমিকের কৃষিশ্রমে নিযুক্ত হওয়া স্বাভাবিক নয়। কৃষিতে আগে থেকেই উচ্চ ছদ্মবেকার রয়েছে। কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রমিকের চেয়ে বেশি শ্রমিক নিয়োজিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে এটি কোনোভাবেই হওয়ার কথা নয়। কারণ এ অর্থনীতিতে শিল্প খাত থাকে বিকাশমান। আমাদের দেশজ উৎপাদনে শিল্প খাতের অবদান বাড়ছে। প্রতি বছরের বাজেটে তার প্রতিফলন আছে। সত্যিকার অর্থে শিল্প থেকে কৃষিতে শ্রমিক স্থানান্তর হলে তা অর্থনৈতিক দুরবস্থারই ইঙ্গিত। অন্য দিকে, নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির তথ্যও আমাদের অর্থনৈতিক প্রবণতার সাথে খাপ খায় না।
এ ধরনের জরিপে আইএলও একজন শ্রমিকের উপার্জন তার দৈনন্দিন ব্যয়ের কতটুকু মেটাতে পারে সেটিও যাচাই করে। তারা এটি করে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের আয় দিয়ে পুরো সপ্তাহের ব্যয় মেটানো সম্ভব কি-না সেই নিরিখে। আমাদের দেশে পণ্যমূল্য বিবেচনায় একটি শ্রেণীর আয় এতটাই কম যে ন্যূনতম খাদ্যের সংস্থান করতেও তারা অপারগ। সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে নিত্যব্যয়ের জোগান দেয়া তো অসম্ভব। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হাসানের মতে, আইএলওর মানদণ্ডে বাংলাদেশে বেকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বিবিএসের জরিপকে রহস্যজনক বলেছেন। সরকার বেকারের হার কমিয়ে দেখাতে আগ্রহী। এই জরিপ তারই প্রতিফলন কি-না খতিয়ে দেখা দরকার।