Naya Diganta

নাম উপনাম ও পদবি

নাম উপনাম ও পদবি।

সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে মানুষ নিজের পরিচিতির জন্য নাম উপনাম ও পদবি ব্যবহার করে আসছে। সৃষ্টির প্রথম মানুষ হজরত আদম আ:-কে আল্লাহপাক আদম নামে অভিহিত করেছিলেন। সেই অবধি মানুষ তার ব্যক্তি পরিচিতি ও বংশ পরিচিতির জন্য নাম উপনাম ব্যবহার করে আসছে। ইসলামী শরিয়তে নাম বা উপনামের ব্যবহার একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় চলমান। ইসলামী সংস্কৃতি অনুসারে সাধারণত পিতার নামের সাথে নিজের নাম সংযুক্ত করে মানুষের পরিচিতি প্রদান করা হয়। যেমন- আব্দুল্লাহর পুত্র মহানবী সা: তার পরিচিতির জন্য মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ বা আব্দুল্লাহর সন্তান নাম ব্যবহার করতেন। বংশগতভাবে তিনি ছিলেন কোরাইশ বংশের হাশেমীয় গোত্রের লোক।

বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত তিনি বংশীয় উপাধি ব্যবহার করতেন না। তিনি বিদায় হজের ভাষণে বংশ কৌলীন্য বা বংশমর্যাদা প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। সর্বকালের কালজয়ী এ ভাষণে তিনি বলেছেন- অকুরাইশদের ওপর কুরাইশদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, ঠিক তেমনি অনারবদের ওপরে আরবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তার বক্তব্যে তিনি আঞ্চলিকতা, গোত্রপ্রীতি ও কৌলীন্য প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। তিনি ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ ভুলে সব মানুষকে মানবতার কাতারে শামিল করেছেন। অথচ বর্তমান যুগে আমাদের দেশে এ শ্রেণীর মানুষ তাদের নামের আগে সৈয়দ, মীর, কাজী, খোন্দকার, শেখ, মোল্লা, মুন্সি, বিশ্বাস, মণ্ডল, চৌধুরী ইত্যাকার নানাবিধ উপাধি ও পদবীতে নিজেদের পরিচিতি ও আত্মমর্যাদা জাহির করে থাকেন।

মূলত বর্ণবাদী অন্য ধর্মের অনুসরণে এসব উপাধি ও পদবী ইসলাম ধর্মে আমদানি করা হয়েছে। প্রকৃতভাবে ইসলামে বংশ ও কৌলীন্যের মাধ্যমে নয়, কর্মের মাধ্যমে মানুষের উপাধি ও উপনাম ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা ও নিপুণতার জন্য পৃথিবী বিখ্যাত বীর হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা:-কে মহানবী সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ঠিক তেমনি দৈহিক শক্তিমত্তার বিচারে হজরত আলী রা:-কে আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। ঈমান ও বিশ্বাস এবং মহানবীর প্রতি আনুগত্যের শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে হজরত আবু বকর রা:-কে সিদ্দিক বা বিশ্বাসী উপনামে ভূষিত করা হয়েছিল।

তেমনিভাবে সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদকারী হিসেবে হজরত ওমর রা:-কে ফারুক বা পার্থক্যকারী উপনামে ভূষিত করা হয়েছিল। এভাবে মহানবী সা: বংশ কৌলীন্যের ওপর বিশ্বাসের ও কর্মের প্রাধান্য দিয়েছিলেন। অথচ বর্তমানে আমাদের দেশে ও সমাজে নাম-উপনাম ব্যবহারে বিশ্বাস ও কর্মের কোনো মূল্যায়ন নেই। যেমন- আমরা জানি, আমাদের সমাজে বংশীয়ভাবে সৈয়দ ও মীর উপাধিধারীরা মহানবীর বংশধর বা উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে থাকে। অথচ আমরা জানি, আমাদের দেশের অনেক সৈয়দ উপাধিধারী বিশ্বাসের দিক দিয়ে আল্লাহ ও রাসূলবিরোধী বা নাস্তিক। ঠিক তেমনিভাবে অনেক কাজী, খোন্দকার, চৌধুরী ও মোল্লা, মুন্সি গোত্রের অনেকে সমাজের নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। যুক্তির খাতিরে আমরা যদি ধরে নিই যে, কোনো বংশে একজন স্বনামখ্যাত বিচারক ছিলেন সে জন্য তার উত্তরসূরিদের কাজী নামে আখ্যায়িত করা হয়। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, বর্তমান যুগে অনেকেই যোগ্যতার মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ পাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে ওই বিচারকদের উত্তরসূরিদের কি বিচারক বংশ হিসেবে দেখা হবে! যদি তা না হয়, তাহলে কাজী সাহেবের ছেলে কেন কাজী বংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে? আমাদের দেশে কোনো কোনো আলেম-ওলামা বংশপরিচিতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য ইসলামে প্রবর্তিত কুফু শব্দ দিয়ে দলিল দিয়ে থাকেন।

প্রকৃতপক্ষে কুফু শব্দে বিয়ের দক্ষতা ও যোগ্যতাকে বোঝান হয়েছে, বংশমর্যাদাকে নয়। বিয়ে-পরবর্তী জীবনে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সাথে দক্ষতা ও যোগ্যতার মাধ্যমে পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে জীবনযাপন করতে পারে। যেমন- চাষি পরিবারের একটি মেয়ে তাঁতী পরিবারে বিয়ে হলে সে মেয়ের পক্ষে তন্তু বা সুতার ব্যবহার বা কাপড় বয়ন সম্ভব হয় না। ঠিক তেমনি একটি শহুরে মেয়ে গ্রামীণ পরিবেশের কৃষক পরিবারে বিয়ে হলে সে কৃষক পরিবারের ঘর গৃহস্থালির কাজেকর্মে মানিয়ে নিতে অস্বস্তি বোধ করে। অবশ্য কালামে পাকের সূরা হুজুরাতে আল্লাহপাক বলেন- ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে জানতে পারো। নিশ্চয় এই তোমাদের মধ্যে আল্লাহপাকের কাছে অতি সম্মানিত সে যে অধিক পরহেজগার বা খোদাভীরু। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী বা সর্বজ্ঞ।’ এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, আল্লাহপাক মানুষকে পরিচিতির জন্য বিভিন্ন বংশে ও গোত্রে বিভক্ত করছেন। এ ক্ষেত্রে মর্যাদা বা সম্মানের জন্য পরহেজগারি বা খোদাভীরুতাকে মানদণ্ড হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বংশপরিচিতি বা ব্যক্তি পরিচিতির মাধ্যমে কৌলীন্য প্রথার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা জানি, অদ্যাবধি জুমার নামাজে ইমাম সাহেব মুসল্লিদের উদ্দেশে খুতবা বা বক্তৃতা দিয়ে থাকেন যে খুতবায় মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উম্মত খোলাফায়ে রাশেদিনের নাম উল্লেখ করা হয়। তাদের নাম খুতবায় পঠিত হয় ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর ইবনে আবু কুহাফা বা আবু কুহাফার পুত্র আবু বকর, দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব বা খাত্তাবের পুত্র ওমর, তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনুল আফফান বা আফফানের পুত্র উসমান, চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবু তালিব অর্থাৎ আবু তালিবের পুত্র আলী। মুসলিম উম্মাহের সর্ব শ্রেষ্ঠ এ সাহাবিরা কখনোই নিজেদেরকে সৈয়দ, কুরাইশ ইত্যাকার উপাধিতে নিজেদের উপনাম ব্যবহার করেননি।

ইসলামের বিখ্যাত পরিচিতি গ্রন্থ আসমাউর রিজালে হাজার হাজার সাহাবি ও তাবেয়ির নাম সন্নিবেশিত আছে। সেখানে কারো নামের আগে তথাকথিত কুনিয়াত বা উপনাম ব্যবহৃত হয়নি। এমনকি মহানবীর মৃত্যুর ১৪ শ’ বছর পরও আমাদের দেশে অনেক আলেম-ওলামা তাদের নামের আগে তথাকথিত নাম, উপনাম বা পদবী ব্যবহার করেননি। যেমন- দেওবন্দ মাদরাসার প্রিন্সিপাল তার নামের আগে কারি শব্দের ব্যবহার করতেন। তিনি নিজের নাম লিখতেন কারি মোহাম্মদ তৈয়ব। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম লালাবাগ মাদরাসার প্রিন্সিপাল শামসুল হক নিজের নামের আগে নাচিজ শব্দ ব্যবহার করতেন। চরমোনাইর বিখ্যাত বুজুর্গ ইসহাক রহ: নামের আগে আহকার শব্দ ব্যবহার করতেন। এভাবে ভারতবর্ষের বেশির ভাগ বুজুর্গানে দ্বীন তাদের নামের আগে আহকার, ফকির ইত্যাদি উপনাম ব্যবহার করেছেন। অথচ বর্তমানে আমরা নামের আগে সৈয়দ, কাজী, খোন্দকার, চৌধুরীসহ নানাবিধ উপনাম ব্যবহার করে চলেছি। এমনকি অনেকে নিজের নামের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সংযুক্ত করে আজহারি, মাদানিসহ অনেক উপনাম ব্যবহার করে নিজেদের পরিচিতি দিয়ে চলেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে নিজের নাম সংযুক্ত করলে হাটহাজারি, লালবাগ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের নামের আগে কী উপনাম ব্যবহার করবে? ঠিক তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের নামের সাথে কিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সম্পৃক্ত করে নিজেদের নাম প্রচার করবে?

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট