Naya Diganta

নীতিবিহীন ভোটের রাজনীতি

নীতিবিহীন ভোটের রাজনীতি।

ভোট শব্দটি শুনলে মনের মধ্যে ফাল্গুনের সুবাতাস শিহরিত হতো। ভোটকেন্দ্রের আশপাশে বাহারি রকমের খাবারের পসরা সাজিয়ে দোকান বসত। বিশেষ করে চায়ের দোকানে আড্ডার উৎসব চলত। ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর আনন্দ মিছিল বের হতো। পাড়ামহল্লায় আনন্দ-উল্লাস বিরাজ করত। কিন্তু এখন ভোট শব্দটি শুনলে গা শিউরে উঠে। মনের মধ্যে ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়। কারণ উৎসবের ভোট বিষাদে পরিণত হয়েছে। এখন ভোট মানে হলো, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি, খুন, ব্যালট ছিনতাই আর পেশিশক্তি প্রদর্শনী। অথচ একটা সময় বিজয়ী প্রার্থী পরাজিত প্রার্থীর বাসায় মিস্টি নিয়ে হাজির হয়ে যেত, সান্ত্বনা দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরত,একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করত। এখন সান্ত্বনা দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করে না। ক্ষমতায় থাকলেই ভোটে জেতা যায়। অর্থাৎ ভোট উৎসবের ঐতিহ্য ক্ষমতার কাছে পরাজিত। ফলে কি সংসদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, কি উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, কি বাজার কমিটির নির্বাচন, কি স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন, কি আইনজীবীদের বার নির্বাচন সবগুলো জায়গা থেকে ভোট উধাও। তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, আইনজীবীদের ঢাকা বার ও সুপ্রিমকোর্ট নির্বাচন। বারের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন না হলেও ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীদের বিজয়ী হতে হবে! সুপ্রিমকোর্ট বার কোনো দল বা গোষ্ঠীর একক কোনো সম্পদ নয়। সুপ্রিমকোর্ট বার নির্বাচন ঘিরে যা ঘটেছে তা সুপ্রিমকোর্ট বারের ভাবমূর্তিকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করেনি; বরং আইনজীবীদের মর্যাদাকেও ভূলুণ্ঠিত করেছে। সুপ্রিমকোর্ট বারের মর্যাদা এভাবে কলঙ্কিত করা ঠিক হয়নি। এ বারের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা প্রয়োজন।

সুপ্রিমকোর্ট বারের নির্বাচন নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, বারকে দলীয়করণ করা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র নেই দীর্ঘদিন। জাতীয় নির্বাচনের অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন হচ্ছে সুপ্রিমকোর্ট বারের নির্বাচন।
একসময় মানুষ অধীর আগ্রহে ভোটের জন্য অপেক্ষা করত। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করত।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে হারিকেন-কুপির মতো ভোট উৎসব হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে গণতন্ত্রের গ-ও থাকবে না। পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ভোট সবচেয়ে বেশি উৎসবমুখর হতো। ভোটের ১০ দিন আগে ভ্যান, সাইকেল, মোটরবাইক ও মিশুক এ মাইক লাগিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চলত। বাড়ির দেয়াল, পথের গাছ ও বাজারের দোকানগুলো পোস্টারে ছেয়ে যেত, একসাথে সারি সারি লাইনে সুতায় টাঙানো বিভিন্ন প্রার্থীদের পোস্টার উড়ত। গ্রামের শিশুরা মাইকের শব্দ শুনলেই পোস্টার নেয়ায় জড়ো হয়ে যেত, তাদের নরম কণ্ঠে স্লোগানে ¯স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠত, তারা ভোট শেষ হওয়ার পর পোস্টার ছিঁড়ে নেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত। এগুলো এখন সবই স্মৃতি! উৎসবমুখর ভোট এখন দূর আকাশের তারার সাথে হারিয়ে গেছে অজানা গন্তব্যে।

উৎসবমুখর ভোট কারা কলঙ্কিত করেছে তা জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে। কিন্তু সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তবে ১৫ ফেব্রæয়ারি গায়েবি ভোট বাদ দিলে ১৯৭৯, ১৯৯৬, ১৯৯১ ও ২০০১ সালের ভোট তুলনামূলকভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল। ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় থেকে যতগুলো নির্বাচন করেছে তার কোনোটিই শতভাগ সুষ্ঠু হয়নি। ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনের ভোট, ১৯৮৬-৮৮ সালের ভোট, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোট, ২০১৪ সালের ভোট ও ২০১৮ সালের ভোট অনেকের মতে প্রশ্নবিদ্ধ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস শীর্ষক প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় যে, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হয়নি। ওই নির্বাচনে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরানো, বিরোধীদলের প্রার্থীদের এজেন্ট এবং ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের খবরে পর্যবেক্ষকরা এ ধারণা পোষণ করেন। পর্যবেক্ষকদের মতে বাংলাদেশে গত সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি- যুক্তরাষ্ট্র, (সূত্র ২১ মার্চ প্রথম আলো)। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে সরকার ও বিরোধীদলগুলোর আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ দেশটা আমাদের সবার। এ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। ভোটের কথা শুনলে মানুষ এখন হাসাহাসি করে। হাসাহাসি বন্ধ করা দরকার। আমাদের সংবিধানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা উল্লেখ থাকলেও জনগণের ভোটের প্রয়োজন পড়ে না। ভোট অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সুষ্ঠু ভোট হয় না। ভোট উৎসবে সহিংসতা বাড়ছে। এর আশু পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।

রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মুখে হাসি ফোটানো। কিন্তু আজ আমরা কী দেখি? হাসি ফোটানো তো দূরের কথা, উল্টো পেশিশক্তির মহড়া চলে, ফলে রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব ও সঙ্ঘাত-সহিংসতা বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের সবক দেয়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা নেই। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরের ভিন্নমতকে গ্রহণ করার মানসিকতা নেই। ফলে গঠনমূলক সমালোচনাও করা যায় না। ভিন্নমতের কথা শুনলেই তাদের গায়ে আগুন ধরে যায়, তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। ভোটকে কেন্দ্র করেই অস্ত্রবাজি, দাঙ্গাহাঙ্গামা,সহিংসতার ঘটনা শাসক গোষ্ঠীর চোখে ধরা পড়ে না। নিকট অতীতে সাতকানিয়া ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গোলাগুলির ছবি প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া চলে। কিন্তু দুষ্টের শাস্তি নিশ্চিত হয় না। যারা অস্ত্রবাজি করে তাদের মনে রাখা দরকার, যে ওঝা সাপের খেলা দেখায় সে ওঝাকেও সাপের দংশনে জীবন দিতে হয়।

আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে এত ঝক্কি-ঝামেলা থাকত না, যদি আমরা নির্লোভ একজন শাসক খুঁজে পেতাম। যারাই ক্ষমতার বাইরে থাকে তারা গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করে। কিন্তু তারাই যখন ক্ষমতায় আসীন হন তখন গণতন্ত্রের কবর রচনা করার সব আয়োজন সম্পন্ন করে। ইতিহাস সাক্ষী পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে আমরা ১৯৭০ সালে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করেছিলাম। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভোট কালিমা মুক্ত ছিল না। জনপ্রতিনিধি বেছে নেয়ার মাধ্যম হচ্ছে ভোট। অথচ সে ভোট আজ প্রশ্নবিদ্ধ! জনগণ পছন্দ অনুসারে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। এই সরকারের আমলে ২০২২ সালের সাত ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১০১ জন মানুষের মৃত্যু হয়। আগামী নির্বাচন একতরফাভাবে হলে হয়তো আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। কিন্তু সুষ্ঠু ভোট না হলে তার পুরো দায় আওয়ামী সরকারকে নিতে হবে। সম্প্রতি কুমিল্লার টাউন হল মাঠে জাতীয় পার্টির কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, এই দেশকে এখন গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। দেশে আদৌ সত্য কথা বলা যায় না। অনেকে গণতন্ত্রের কথা বলেন। অথচ দেশে আজ কোনো গণতন্ত্র নেই। দেশে এখন স্বৈরশাসন চলছে।’ তিনি আরো বলেন, সরকার মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ যে কারণে হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করছে না। সরকার যখন পক্ষ হয় তখন অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন আর হয় না, বরং পক্ষপাতিত্ব হয়। (সূত্র: ১১ মার্চ ২০২৩ মানবজমিন)

জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে বার ও সুপ্রিমকোর্টের নির্বাচনে তারা যে নজির স্থাপন করেছে তাতে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ তো আর চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না তখন তৃণমূল বিস্তৃত সংগঠনটির সহিংসতার দায়ভার কে নেবে?

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যারাই ক্ষমতার মত্তে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জনগণের ওপর জুলুম করেছে তারাই এক সময় না এক সময় কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। মহাযুদ্ধের সময় জাপানকে জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে দেখেছি। জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে আমেরিকা লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান নামে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল তার মাশুল আজো জাপানিরা দিচ্ছে। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নও বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন নানা খণ্ডে বিভক্ত হয়ে এখন অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। সুতরাং আমরা মনে করি, দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়া প্রয়োজন যেন নীতিহীন ভোটের রাজনীতি পিছু টানে চলে যায়, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি রাজনীতিতে এগিয়ে যায়।