Naya Diganta

আবৃত্তি শিল্পের কথা

‘কবিতা নিভৃতচারী শিল্প, কিন্তু কবিতা যখন নির্জনতা ত্যাগ করে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায় তখন তাকে কালের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠস্বরের আশ্রয় নিতে হয়।’ আল-মাহমুদ
কণ্ঠের জাদুতে ভর করেই কবিতা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। এই জাদুর নাম আবৃত্তি। আবৃত্তি মানুষকে আনন্দিত ও পুলকিত করে, আচ্ছন্ন ও মোহগ্রস্ত করে। আবার মনকে বিষাদে ভরিয়ে দিতে আবৃত্তির জুড়ি নেই। তেমন কোনো ইন্সট্রুমেন্ট ছাড়া শুধুই কণ্ঠস্বরের ওপর ভর করে আবৃত্তি নির্মিত হয়। যেহেতু কণ্ঠস্বরই হল আবৃত্তির প্রধান উপজীব্য তাই উপযুক্ত কণ্ঠস্বরের জন্য প্রয়োজন কঠোর অনুশীলন। কন্ঠের পাশাপাশি শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ আবৃত্তির জন্য অপরিহার্য। পরিপক্ব আবৃত্তির জন্য যে ভাষায় আবৃত্তি করা হয় সে ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দকে শুদ্ধতার ছাঁকনিতে ছেঁকে নিতে হয়। কণ্ঠস্বর যতই মধুর হোক অশুদ্ধ উচ্চারণ আবৃত্তির প্রধান শত্র“ যা মূলত আবৃত্তির সুরম্য প্রাসাদকেই ধসিয়ে দেয়। নির্মাণশৈলী যেমন কোন অট্টালিকাকে দৃষ্টিনন্দন ও মজবুত করে তেমনি আবৃত্তির সফলতা অনেকাংশে আবৃত্তি নির্মাণের ওপর ভর করে মাথা উঁচু করে। নির্মাণ বিষয়টা একটু খোলাসার দাবি রাখে। নির্মাণ মূলত কবিতার ছন্দ, ভাব, রস, বিষয়, আবেগ, শিল্পীর অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও কণ্ঠের জাদু সর্বোপরি সব কিছুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। একটা কবিতা যে চিত্রকল্প তৈরি করে সেই চিত্রকল্পকে বাস্তব রূপ দান হলো নির্মাণ। যেমন মেঘ শব্দটি একটা বিষণœ শব্দ। যদি বলা হয় আমার মনের আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে তাহলে এর নির্মাণ বিষণœতার দাবি রাখে। আবার একই শব্দ স্থান কাল পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন অর্থের ও ভাবের হয়ে থাকে। তখন নির্মাণও স্থান, কাল ও পাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়। যেমন:
‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,
বাদল গেছে টুটি।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি’... (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এখানে মেঘের অবসানে রোদের উদ্ভাসিত হবার উচ্ছ্বাস ও ছুটির আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে। তাই এখানে আবৃত্তি নির্মাণে বিষণœতা উপজীব্য নয় বরং আনন্দ প্রকাশ মুখ্য। মূলত সুন্দর ও যথাযথ নির্মাণের জন্য শিল্পীকে কবিতার আবেগ, ভাব ও অনুভূতির অনুগামী হতে হয়। কবি যে ভাব ও অনুভূতি নিয়ে কবিতাটি রচনা করেছেন সে অনুভূতিকে ধারণ করে কণ্ঠে প্রকাশ করতে না পারলে আবৃত্তি তার আবেদন হারায়। শুধু ভারী, গম্ভীর ও সুন্দর কণ্ঠস্বর থাকলেই হয় না বরং কবিতার প্রেক্ষাপটের সাথে সাথে কবিতার ভাব, রস ও বোধ ধারণ করা একজন আবৃত্তিশিল্পীর জন্য আবশ্যক। কবিতার ভাব, রস, ছন্দ, বোধের সাথে কণ্ঠের মিথস্ক্রিয়া এবং শিল্পীর আবেগ ও অনুভূতি মিলেই আবৃত্তির সৃষ্টি হয়। তবে এই আবেগ হতে হবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিশীলিত। আবৃত্তির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ ব্রেকফেল করা যানবাহনের মত যা যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ বলতে আবৃত্তির ক্ষেত্রে শিল্পীর আবেগের প্রকাশভঙ্গি বুঝায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় :
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ (কাজী নজরুল ইসলাম)
এই বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তির শুরুতেই যদি একজন আবৃত্তিকার তার নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান তাহলে তার জন্য সামনে আগানো প্রায় অসম্ভব। আর সামনে আগালেও তার জন্য সেইফ এক্সিট বা নিরাপদে অবতরণ খুব সুখকর নাও হতে পারে। আবৃত্তির জন্য কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ, ভাবরস তথা সাহিত্যরস অনুধাবন করা খুবই প্রাসঙ্গিক। আর সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। ইংরেজিতে একটা কথা প্রচলিত আছে Read between the lines যা আবৃত্তিশিল্পের জন্য বাইবেল তুল্য। কারণ কবিতার আক্ষরিক অর্থের চেয়ে কবিতার রস আস্বাদনের জন্য দুই লাইনের মধ্যবর্তী সাদা অংশ পড়তে পারার যোগ্যতা অর্জন বেশি জরুরি।
কবিতাকে আবৃত্তিতে রূপদানের জন্য কবিতার নিগূঢ় অর্থ বের করতে পারঙ্গম হতে হয়। আর অনুশীলন ও অধ্যবসায় ছাড়া এই পারঙ্গমতা অর্জন অসম্ভব।
আবৃত্তি এমন একটা শিল্প যাতে সামান্যতম খুঁতও গ্রহণযোগ্য নয়।
একটা সাদা কাপড়ে সামান্য কালো দাগ যেমন চোখ এড়াতে পারে না তেমনি অতি সামান্য ভুলও একটা সুন্দর আবৃত্তিকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে যথেষ্ট। সেটি স্বরের প্রয়োগ হোক, উচ্চারণ হোক, বোধ হোক বা ভাব হোক সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই বলা যায় আবৃত্তি হলো শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটি নিখুঁত চিত্রশিল্প। যেখানে থাকবে না রঙের যথেচ্ছ ব্যবহার আবার যা নয় ধূসর রঙহীন।