Naya Diganta
হার্টের রিং মাত্রাতিরিক্ত দাম

রোগীরা এখন অসহায়

হার্টের রিং মাত্রাতিরিক্ত দাম

আমাদের দেশের চিকিৎসাও শতভাগ বাণিজ্য হয়ে গেছে। মানুষের অসুস্থতা যত বেশি বাণিজ্যের সুযোগও তত বাড়ে। দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে রোগীদের গলা কাটা হয়। হৃদরোগ নিয়ে মানুষের উচ্চ শঙ্কা কাজ করে। এর চিকিৎসায় রোগীদের ভীতিকে কাজে লাগিয়ে একটি শ্রেণী অতি উচ্চমূল্য আদায় করছে। সহযোগী একটি দৈনিকে হার্টে রিং বসানোর ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায়ের একটি বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে একেকটি রিংয়ের দাম ক্ষেত্র বিশেষে ১০ গুণের বেশি রাখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের হাসপাতালগুলো কোনো ধরনের নিয়ম কানুন মানছে না। এর সাথে রয়েছে ভুল চিকিৎসা ও আরো শত রকমের ভোগান্তি।
হার্টের অন্যতম রোগ হচ্ছে, ব্লক হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া। এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় ডাক্তাররা রিং বসিয়ে স্বাভাবিক রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করে দেন। এই রিংয়ের দাম নিয়ে চরম অসাধুতা চলছে। সাধারণত রোগীরা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় হাসপাতালে আসেন। তারা এই সময় চরম উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে থাকা রোগীর দুর্বল অবস্থাকে অনেকে অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ হিসেবে দেখেন। রোগীদের কাছ থেকে একেকটি রিংয়ের দাম ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৫২ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে একই ধরনের একটি রিং ৯ হাজার টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে। দেশটিতে এই রিং সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার ৮০৪ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ ভারতের জীবন যাত্রার মান আমাদের সমপর্যায়ের।
আমাদের দেশে হার্টে ব্যবহৃত রিংয়ের লাগামছাড়া মূল্য কেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ ফতুর হয়ে যাচ্ছে। হার্টে ব্লক শনাক্ত হওয়ার পর ডাক্তারদের পক্ষ থেকে রিং লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়। কিছু হাসপাতালে দেখা যায় একদল ডাক্তার রয়েছেন, এ জন্য রীতিমতো প্রচারণা চালান। রোগীর স্বজনরা কোনো উপায় না দেখে উচ্চমূল্যে রিং বসাতে বাধ্য হচ্ছেন। বাজারে তিন ধরনের রিং পাওয়া যায়। এগুলোর দাম ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। অথচ এগুলোর মান প্রায় একই রকম। আবার এগুলো রোগী সরাসরি কিনতে পারেন না। এর ওপর সেই হাসপাতাল ও ডাক্তারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। সরকারের উচিত, প্রকাশ্য বাজার থেকে রিং কেনার সুযোগ করে দেয়া।
বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ২০১৭ সালে রিংয়ের সর্বনিন্ম মূল্য ২৫ হাজার ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত মূল্য তালিকা হাসপাতালে টানানোর নির্দেশনাও দেয়। প্রশাসনের এই নির্দেশনা নিয়ম অনুযায়ী কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টানিয়েছে, এমনটি দেখা যায়নি। প্রকাশ্যে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করা হলেও এ ব্যাপারে তদারকি করার কেউ নেই। রিংয়ের চড়া দামের কারণ ডাক্তারদের কমিশন গ্রহণ। তারা একেকটি রিংয়ের বিপরীতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বাড়তি পান। তারপরও রিংয়ের দাম এত উচ্চ হওয়ার কথা ছিল না। বাকি বর্ধিত মূল্যটি পায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আগে ডাক্তাররা টেস্ট করানোর জন্য কমিশন পেতেন। তারপরে যুক্ত হলো ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপঢৌকন। এখন সেটি স্পর্শকাতর চিকিৎসা সরঞ্জামের বিক্রি বাট্টা থেকেও হচ্ছে। অথচ চিকিৎসা একটি সেবা। ছোট বেলায় অনেকেই কেবল এই মহান মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডাক্তার হওয়ার বাসনা করেন। জাতীয় ক্ষেত্রে আমাদের যে অবক্ষয় তারই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চিকিৎসাসেবায়। কেউ এখন এটিকে মানবসেবা হিসেবে নিচ্ছেন না। সমাজের আর আট-দশটি পেশার মতো এটিকেই অর্থ কামানোর একটি হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছে।
পত্রিকার প্রতিবেদনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালে রিং বসানো নিয়ে চিকিৎসা বাণিজ্যের খবর দিয়েছে। রোগ নির্ণয়ে নিন্মমানের রাসায়নিক ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ ইকো মেশিন ব্যবহার ও উপযুক্ত সরঞ্জাম না থাকার খবর দিয়েছে। এ ছাড়া টেকনিশিয়ান দিয়ে রিং বসানো, চিকিৎসা অবহেলা, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট, মাত্রাতিরিক্তি বিল আদায়- এ রকম বহু অভিযোগের বিষয় এসেছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এসব অনিয়ম চলছে প্রকাশ্যে। ভুক্তভোগীরাও কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থায় যেতে সাহস পান না। কেউ ব্যবস্থা নিতে চাইলে প্রভাব খাটিয়ে তাদের থামিয়ে দেয়া হয়। এমন অবস্থায় রোগী সাধারণের অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।